রাজনীতির সঙ্গে ন্যায্যতা-চিন্তার দূরত্বের কারণে আমাদের কতগুলো জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। কতগুলো ভুল সিদ্ধান্ত, কিছু ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব ও দলগুলোর অসহিষ্ণুতার কারণে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে না। ইতিহাসবিদ ভ্যান শ্যান্ডেল একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, সমকালীন বাংলাদেশকে অনুধাবন করতে হলে আগের কয়েক দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক অভিঘাতগুলো গভীরভাবে বোঝা প্রয়োজন।

বতর্মানে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ, যা রাশিয়া ও জাপানকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মতো সীমিত ভৌগোলিক পরিসরে এত বিচিত্র ও বহুধাবিভক্ত একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল। সুতরাং অতিমাত্রার জনঘনত্ব এখানকার জটিলতার একটি দিক। আর অন্যদিকটি নিয়ে কথা বলেছেন আমাদের কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক এ এফ সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নবীন হলেও তার সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি সহস্র বছর পুরোনো। আর তা ছাড়া এ অঞ্চলের রয়েছে পরিবেশ, জলবায়ু ও ভূমির বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যার সঙ্গে বাংলা ভাষার শক্তি মিলেমিশে এক স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় দিয়েছে।

এই লেখায় আমি তিনটি দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর আলোকপাত করব: প্রথমত, রাজনৈতিক দর্শনের অনুবীক্ষণ; দ্বিতীয়ত, নৈতিকতা ও ন্যায্যতা-চিন্তার বিকাশপথ এবং তৃতীয়ত, চলমান সমস্যার উত্তরণে সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি টানব।

রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি: হবস ও সামাজিক চুক্তি

সপ্তদশ শতকের দার্শনিক থমাস হবস তাঁর লেভিয়াথান গ্রন্থে প্রথমবারের মতো ‘সামাজিক চুক্তি’র ধারণা প্রস্তাব করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষে-মানুষে নিরবিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধ করে সমাজকে সুরক্ষিত করা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধরত’, এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে একটি সামাজিক চুক্তির ধারণার কার্যকর প্রয়োগ কীভাবে সমাধান দিতে পারে, তা তিনি দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘কমন পাওয়ার’ বা ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র অভাবেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘যেখানে প্রত্যেক মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, সেখানে এ-ও অনিবার্য যে অন্যায় বলে কিছু থাকতে পারে না। ন্যায়-অন্যায় কিংবা সঠিক-ভুলের যে ধারণা, তা সেখানে অস্তিত্বহীন। কারণ, যেখানে কোনো কমন পাওয়ার নেই, সেখানে আইনও নেই; আর যেখানে আইনই নেই, সেখানে অন্যায়ের কথাও অনুপস্থিত।’ (লেভিয়াথান, অধ্যায়-১৩,১৬৫১)

মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের কিছু অধিকার রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করে, যাতে সমাজে শান্তি, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাসহ বণ্টনমূলক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমাজের সদস্যরা স্বেচ্ছায় নিজের ক্ষমতার একটি অংশ ছাড় দিয়ে সম্মিলিতভাবে এই কমন পাওয়ার বা সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অর্পণ করে। রাষ্ট্র এই ক্ষমতা নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করে সমাজকে পরস্পর হানাহানির সমূহ বিপদ থেকে সুরক্ষা দেয় একটি সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হয়ে। রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে কতগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের দরকার পড়ে, কারণ, মানুষ সাধারণত কোনো কাজে নিজের স্বার্থ সর্বোচ্চ আদায় করতে চান, যা তাঁকে বিশৃঙ্খলা বা মব সন্ত্রাস সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। আর তাই নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দুই বা ততোধিক পক্ষের ভেতর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক সময়ে সম্ভবত স্কুলই সামাজিক চুক্তির আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করে। আরও বড় হয়ে সেই শিক্ষার্থী যখন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তখন তাঁর সামনে আরও বৃহত্তর পরিধির সমাজের সঙ্গে এই চুক্তির নবায়ন ঘটে ও তাঁর বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়।

সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ থেকে সমাজকে বাঁচাতে হবসের এই ধারণার প্রেক্ষাপট হলেও বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর প্রকাশিত সংবাদ দেশে যে ‘বিশৃঙ্খলা’ ও ‘ছায়াযুদ্ধে’র কথা বলছে, তার সঙ্গে এর মিল-অমিল দুটিই আছে। বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তাহীনতার বোধ ক্রমবর্ধমান, ‘দলীয় মব সন্ত্রাস’ কিংবা অরাজকতার খবর যখন নিত্যসঙ্গী, তখন হবসের এই তত্ত্ব নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা, উপদেষ্টাদের বিতর্ক ও তাদের টেবিলে ‘সমন্বয়ক’দের তদবিরের উঁচু ফাইল, আদালতের গুণমানের ক্রমাবনতি এবং সেনা-অবস্থান ইত্যাদি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সামাজিক চুক্তি কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অসাড় হয়ে পড়েছে সমাজে নাগরিকদের সমদর্শিতারূপে গণ্য করার দৃষ্টিভঙ্গিটির।

কেন এই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণটি অনুধাবন করা খুব কঠিন নয়। কারণ, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার, তা এই সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠার একটি দিক মাত্র। গণতন্ত্রের এই পুরোনো ও আনুষ্ঠানিক দিকটি যেখানে নির্বাচন ও ব্যালটকেই গুরুত্ব দেয়। কিন্তু যাঁরা পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশমান ধারাটি অনুসরণ করেন, তাঁরা এর অন্যদিকটি আলাপ–আলোচনাভিত্তিক শাসনের ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গিটি, এ দেশে যে নেই সেটি জেনে থাকবেন। অগ্রসর পাঠক উপলব্ধি করবেন যে এক মাথা, এক ভোটের দাবি হিসেবে গণতন্ত্রকে এখন আর গণ্য করা হয় না, বরং দেখা হয় তার চেয়ে ব্যাপক প্রশস্ত আকারে।

স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতে, গণতন্ত্রের সারবস্তু হলো অবাধ, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা এর অপরিহার্য অঙ্গ। হান্টিংটন-উত্তর সময়ে অনেক পরিবর্তন হলেও এখনো অনেকে গণতন্ত্রকে, সাংগঠনিক রূপের বাইরে অর্থাৎ ব্যালটের আরেক নাম গণতন্ত্র হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, এর বাইরে ভাবতে রাজি নন। গুরুত্ব বিবেচনায় ভোট কম কিছু নয় বরং প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিপ্রয়োগকে কার্যকর করতে গেলেও ভোটের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটি প্রয়োজনীয় শর্ত মাত্র, কিছুতেই তা এর ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। আর তা ছাড়া ভোটের কার্যকারিতা তখনই থাকে, যখন নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের অধিকার, জীবনরক্ষাকারী প্রাথমিক দ্রব্যের সমঅধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে।

ন্যায্যতা চর্চার অন্য ধারা রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন

রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় দেশের বুকের ওপর যে দুর্দশার পাহাড় চেপে বসে আছে, তার প্রধান ভিত্তিই হলো শিক্ষার অভাব। (ইজভেস্তিয়া, ১৯৩০)। আমাদের জীবনের বহুবিধ সমস্যাকে একটি মাত্র বিন্দুতে আনার কারণে কেউ হয়তো তাঁকে অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট বলতে পারেন, তবে রবীন্দ্রনাথের বিচারটি যে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, সে বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্র অমর্ত্য সেন এই নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাকে মূল সূত্র ধরে সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গির নতুন তত্ত্বায়ণ করেছেন। সামাজিক প্রগতির ক্ষেত্রে ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার ভূমিকার কথা রবীন্দ্রনাথ বহু বছর আগে বলে গেলেও বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের মতো অন্যান্য উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানও উন্নয়ন-চিন্তায় শিক্ষার ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অর্থনৈতিক সুযোগ ও কর্মসংস্থানে শিক্ষাগত সক্ষমতা ও দক্ষতা কী ভীষণভাবে নির্ভরশীল, তা আজকাল আর আমাদের বোঝানোর দরকার পড়ে না। অমর্ত্য সেনের মতে, শিক্ষা মানুষকে কতগুলো মৌলিক স্বাধীকার দেয়, যার মধ্যে রয়েছে পৃথিবীকে বোঝা, একটি ওয়াকিবহাল জীবন যাপন করা, অন্যদের সঙ্গে ভাববিনিময় এবং সাধারণভাবে আমাদের চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত থাকার ক্ষমতা। কারণ, আধুনিক সমাজ লিখিত ভাববিনিময়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। (ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা, দ্রেজ ও সেন)

অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ বা সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে জীবনটাকে যাপন করতে চায়, সেভাবে সে যাপন করতে পারছে কি না, সেটিই বর্তমানে তাদের স্বাধীনতার বা সক্ষমতার প্রশ্ন। তিনি ন্যায্যতাকে বুঝেছেন সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি দিক হলো সক্ষমতার বা স্বাধীনতার দিক এবং অন্যটি হলো শিক্ষা ও দক্ষতার দিক। সেনের এই দর্শনকে কেন্দ্রে রেখে আমাদের গণতন্ত্রকে কীভাবে প্রকাশ্য যুক্তি প্রয়োগের ভিত্তিতে ‘আলোচনাভিত্তিক শাসনে’ রূপান্তরিত করা যায়, সেটিই এখানে মুখ্য হওয়া উচিত। কারণ, এই নবতর ধারণা আমাদের জ্ঞানভিত্তিকে সমৃদ্ধ করে ও পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা কমাতে সাহায্য করে। আমাদের সংকটটি কিন্তু শুধু স্থিতিশীলতার নয়, বরং সমাজে নয়েজ বা কোলাহল কমিয়ে কীভাবে উচ্চতর সমাজ নির্মাণ করা যাবে, সেটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

এই কাজ করতে হলে রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেনের মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ক্রমবর্ধমান ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সংবেদনশীল মানবিক বোধের প্রয়োগ ও আলাপ-আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের গতিশীল অভিযাত্রা। রবীন্দ্রনাথের আত্মানুসন্ধানমূলক দর্শন ও ‘বিচ্ছিন্নতা-বিরুদ্ধ’ চর্চা আমাদের শেখায়, কীভাবে ব্যক্তি তার সীমিত পরিধির খোলস থেকে ক্রমে সমাজ-সত্তার সঙ্গে এবং সমাজ-দেহ থেকে বিশ্ব মানবতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি সহনশীল ন্যায্যতা-চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়। আমাদের সমাজে যেখানে প্রতিনিয়ত উঁচু উঁচু সাংস্কৃতিক-দেয়াল নির্মিত হচ্ছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথের সংবেদনশীল আত্মশক্তি এই বিভাজনের বিপরীতে সংযোগ নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করে। অন্যদিকে, অমর্ত্য সেনের মতে, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অর্থ কোনো নিখুঁত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কাঠামো নির্মাণ নয়, বরং যেসব অন্যায় যা আমাদের একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সবার আগে সেগুলো দূর করার পথ খোঁজা জরুরি। এই তুলনামূলক-বিচার আমাদের দেশে আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আমরা অন্তত দৃশ্যমান ও প্রকট অনিয়ম ও বৈষম্য রোধে কার্যকর বিকল্প গ্রহণ করতে পারি।

চলমান সমস্যা উত্তরণে সম্ভাব্য করণীয়

চিন্তাশীল মানুষের লেখা পড়লে খুব বড় মাপের গঠনমূলক অভিজ্ঞতা হয়, তা সে যত পুরোনোই হোক না কেন। মে মাসের শেষের ১০ দিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে যেসব খবর বেরিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরস্পরের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস স্পষ্ট। এখানে সমাজের চাওয়া আর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের ভেতর দূরত্ব রয়েছে। ফলে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এটি অনেকটা হবসীয় সময়ের ‘সকলের সঙ্গে সকলের স্বার্থ-সংঘাতে’র ফলে সৃষ্ট অস্থিরতাকেই যেন অনুসরণ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভেতর ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য পেলেও তা এখন আর তার পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না সমদর্শি দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের অভাবে। আবার কখনো সমদৃষ্টিতে দেখা হলে বড়রা তা গ্রহণ করতে পারছেন না বোধের অভাবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আকর্ষণ ছিল তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও তরতাজা আইডিয়াগুলো। সময় যত গড়িয়েছে, সেগুলোতে কিছুটা ধুলা পড়েছে ও ম্লান হয়ে গেছে জনসম্পৃক্ততার অভাবে। অন্যদিকে, বিবদমান সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর ঐক্যের জায়গা নষ্ট হয়ে সেই জায়গায় পুরোনো পেশিশক্তি–ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় পরস্পর লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক সেনের কথা ধার করে বলা যায়, দলগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, যে বিষয়টি তারা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারছেন না, সেটিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রবণতা বেশ স্পষ্ট। আমাদের রাজনৈতিক দলের ভেতর লেখাপড়ার চর্চা ও পাঠচক্রের অনুশীলন শূন্যের কোঠায় নেমেছে, যা তাদের কর্মীদের আচরণে স্পষ্ট। শিক্ষার যে কি প্রচণ্ড-রূপান্তর ক্ষমতা রয়েছে, সেটি বোধ হয় আমদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় জানেই না!

নইলে বিগত ৫৪ বছরেও আমাদের কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধির দাবি দূরে থাক, সাধারণভাবে শিক্ষার কথাটি কোনো জায়গা পেল না কেন? যদিও আমরা জানি, উচ্চতর সমাজ বিনির্মাণে একমাত্র শিক্ষাই পারে এ দেশের মানুষের সক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে। পরিশেষে বলতে হয়, হবস থেকে আমরা শিখেছি কেন আমাদের আইন মানা জরুরি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করাচ্ছেন, ন্যায়ের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি শুধু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই হয় না, দরকার রূপান্তরিত মানুষের যার অন্তর্জগৎ হবে সুন্দর। আর অমর্ত্য সেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিষ্ঠানের প্রায়োগিক মূল্য সত্ত্বেও, আমাদের ধাপে ধাপে নৈতিক উন্নয়নেও মনোযোগী হতে হবে, কারণ, ন্যায্যতার মূল বাহক প্রতিষ্ঠান নয়, মানুষ।

আহমেদ জাভেদ প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন। তিনি বর্তমানে সিটি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অমর ত য স ন র গণতন ত র র র র জন ত ক পর স থ ত ন য য যত স ব ধ নত র ক ষমত ক ষমত র প রক শ অন য য় র ভ তর আম দ র কতগ ল দলগ ল দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
  • এমন কিছু করবেন না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়: মির্জা ফখরুল
  • সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
  • বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব‍্যবস্থা না হলে গণতন্ত্র আবার হুমকিতে পড়বে: এবি পার্টি
  • মানুষ ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, পিআর বুঝবে কী করে: মির্জা ফখরুল