উপমহাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬৪ বছরের মধ্যে (১৮৫৭-১৯২১) প্রতিষ্ঠিত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশে ১২তম, অবিভক্ত বাংলায় দ্বিতীয় আর পূর্ববঙ্গে প্রথম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ভারতভাগ পর্যন্ত আরও অন্তত ২৬ বছর ব্রিটিশরা শাসন করে। এই ২৬ বছরে (১৯২২-১৯৪৭) তারা আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করে। সব শেষ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি হলো: দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় (দিল্লি ১৯২২), নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় (মহারাষ্ট্র ১৯২৩), অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় (বিশাখাপত্তম, অন্ধ্রপ্রদেশ ১৯২৬) ও আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় (উত্তরপ্রদেশ ১৯২৭)।
ঢাকা ছাড়া ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ঘটেনি, এমনকি পাকিস্তান অঞ্চলেও না। সর্বশেষ আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার (১৯২৭) পর ইংরেজ শাসন আরও ২০ বছর স্থায়ী হয়। এ সময়ে (১৯২৭-১৯৪৭) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্য সবকিছুর তুলনায় স্বরাজ-স্বায়ত্তশাসন-স্বাধীনতার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে। আন্দোলন-সংগ্রামের নানা কর্মসূচিতে সরকারও থাকে ব্যতিব্যস্ত। ভারতকে ভাগ করে কীভাবে পৃথক দুই নেতৃত্বের হাতে তুলে দিয়ে সসম্মানে বিদায় হওয়া যায়, এটি তাদের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। তা না হলে ইংরেজ শাসনের শেষের দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এমন ছেদ পড়ার কথা নয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয় এই ভূখণ্ডে বহু ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনকারী হলেও এটি নিজেই এখনও বিভিন্ন কাঠামোগত সংকট, রাজনৈতিক দলীয়করণ, আবাসন সংকট ও প্রশাসনিক অদক্ষতার মতো মৌলিক সমস্যায় জর্জরিত। বিশেষ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে রূপ দেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তার বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ১ হাজার ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের মতে, এই বরাদ্দ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গত ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড.
শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন, একটি মুক্ত, সৃজনশীল এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। তাদের প্রত্যাশা– আধুনিক ল্যাব, মানসম্মত আবাসন, সময়োপযোগী পাঠদান ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ হোক। তাদের মত, ‘রাজনীতির ভয় নয়, জ্ঞানের আধিপত্য চাই। গেস্টরুম কিংবা গণরুমের পরিবর্তে গ্রন্থাগার হোক আমাদের নির্ভরতার জায়গা।’
সেই ব্রিটিশ আমলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ অভিধায় ভূষিত হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির এগিয়ে চলা। চলার পথে অনেক ক্ষেত্রে গতিও হারিয়েছে কখনও কখনও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়, এটি একটি জাতির আত্মবিকাশের কাহিনি। প্রধানত এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা লোকেরাই বাংলাদেশ চালাচ্ছে। বিশেষত পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তা কেন, সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও একই ভূমিকা রেখেছে গর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত
কলেজ শিক্ষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহনে ‘অচলাবস্থা’
দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দ মোহন কলেজ। ১১৭ বছরের পুরোনো এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘জ্ঞানের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে নানা সংকটে ধুঁকছে।
বর্তমানে কলেজটিতে ২১ বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও ২০ বিভাগে স্নাতকোত্তর চালু আছে। আছে উচ্চমাধ্যমিকও। সব মিলিয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪১ হাজার ৮৮৩ জন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮০ জন। যদিও শিক্ষকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২০৮।
এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষের অভাব, আবাসনসংকট রয়েছে। পরিবহনও অপ্রতুল। এর বাইরে প্রায় দুই মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।
বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম। মোরসালিন মিয়া, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি বিভাগশ্রেণিকক্ষের সংকট
ইংরেজি বিভাগে শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র দুটি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আজ (২১ অক্টোবর) এক ক্লাস শেষ হতেই রুম ছেড়ে দিতে হয়েছে, মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। অন্তত পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ দরকার, কিন্তু আছে মাত্র দুটি।’
কলেজে ৪১ হাজার ৮৮৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬টি শ্রেণিকক্ষ। গড়ে ৫৫১ শিক্ষার্থীর জন্য একটি কক্ষ। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, আরও অন্তত ৫০টি শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ। পরীক্ষার সময় অন্য বিভাগের কক্ষ ব্যবহার করতে হয়। আরও দুটি কক্ষ থাকলে ভালো হতো।’
এদিকে বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শৌচাগারের সংকট। ইংরেজি বিভাগের একমাত্র শৌচাগারে কল নষ্ট, পানি নেই। শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে সবাই একই টয়লেট ব্যবহার করি, ফ্লাশ কাজ করে না।’
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নেসার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শৌচাগারই নেই, অন্য বিভাগে যেতে হয়।’
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম সিদ্দিকী বলেন, ‘সিঁড়ির পাশে থাকা শৌচাগার ব্যবহার করা হয়, স্থায়ী সমাধান দরকার।’
পর্যাপ্ত নয় পরিবহন
৪২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজের নিজস্ব বাস আছে মাত্র তিনটি। মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট রুটে চলে সেগুলো। ভালুকা-ময়মনসিংহ রুটে একটি ভাড়ায় নেওয়া বাস রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী হাফিজা আক্তার বলেন, ‘বাসে ৪০ জনের সিট, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে ৮০ জন যাতায়াত করি। বাস মিস করলে ১৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। পরিবহন বাড়ানো খুব দরকার।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার ১৩ উপজেলার শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না থাকায় রুট বাড়ানো যাচ্ছে না।
নিয়ম এখন ‘অতিরিক্ত সিট’
কলেজে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের চারটি হল আছে। ধারণক্ষমতা ছেলেদের ৩৫০ ও মেয়েদের ৪৫০, কিন্তু বাস্তবে থাকেন আরও বেশি।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘চারজনের রুমে এখন পাঁচজন থাকা নিয়ম হয়ে গেছে।’
খালেদা জিয়া হলের ছাত্রী আঞ্জুমান নাহার বলেন, ‘ছয়জনের রুমে থাকি ১২ জন। বছরে ৬ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়, প্রতিদিন ৬০ টাকা মিল খরচ। কিন্তু ঠাসাঠাসিতে পড়াশোনা করা যায় না।’
যদিও হলের সুপার ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ঝরনা বেগম দাবি করেন, ‘রুমে ১০ জনের বেশি কেউ নেই, পুরোনো সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়েছে।’
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ছেলেদের নতুন পাঁচতলা হলের কাজ প্রায় শেষ। আরও একটি নতুন হল নির্মাণাধীন। তবে শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন এখনো অপ্রতুল।
ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন মিয়া বলেন, ‘বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম।’
রিডিং রুম নেই, গ্রন্থাগারও অচল
মেয়েদের চারটি হলে (সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, তারামন বিবি, খালেদা জিয়া ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম) কোনো রিডিং রুম নেই। তাঁরা ডাইনিং রুমেই পড়াশোনা করেন।
অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী সালিহা জাহান বলেন, ‘ডাইনিংয়ে কেউ খাবার না খেলে সেখানে বসেই পড়ি।’
গ্রন্থাগারে আছে প্রায় ৫০ হাজার বই, কিন্তু ভবন নির্মাণের কারণে দুই বছর ধরে অস্থায়ী কক্ষে চলছে কার্যক্রম। সেখানে বই থাকলেও নেই পাঠের জায়গা। নিবন্ধিত পাঠক মাত্র ৪২০ জন।
গ্রন্থাগারের কর্মী লাকি আক্তার বলেন, আগে সবাই এসে পড়ত, এখন জায়গা নেই বলে বই নিতে আসে কম।
তিন হলে এক ডাইনিং
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, আবু সালেহ হল (তরুণ হল) ও জসীমউদ্দীন হল—ছেলেদের এ তিন হলের জন্য একটি ডাইনিং রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৫ জনের খাবার রান্না হয়। তিন বেলা খাওয়ার জন্য লাগে ৭০ টাকা।
শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘প্রতিদিন একেক রুম থেকে মিল ম্যানেজার দায়িত্ব নেয়। টাকাটা আমরা নিজেরাই তুলি।’
ডাইনিংয়ের কর্মী আলাল উদ্দিন বলেন, ‘৭০ টাকায় তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। টাকার হিসাবে খাবার খারাপ নয়। কিন্তু টাকা ভালো হলে খাবারও ভালো হতো।’
সংকট সুরাহার দাবি
কলেজের অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে গত ৩১ জুলাই ওএসডি করা হয়। এরপর ৩ আগস্ট উপাধ্যক্ষ সাকির হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তবে ১২ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে নামেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে চেয়ার বাইরে ফেলে দেন তাঁরা।
এখনো অফিসে যেতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষার্থীরা ২১ অক্টোবর সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অনতিবিলম্বে অধ্যক্ষ পদায়ন করতে হবে; হিন্দু হল দ্রুত চালু করতে হবে; প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে একটি পুলিশ বক্স চান শিক্ষার্থীরা।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাকির হোসেন বলেন, এত বড় কলেজে সমস্যা থাকবেই, পর্যায়ক্রমে সমাধান হবে। তবে কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসুর নামে ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। তবে কার্যক্রম শুরু হয় পরের বছর, ১৯০৯ সালে। একসময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল আনন্দ মোহন কলেজ। কিন্তু এখন শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, গ্রন্থাগার, পরিবহন—সব ক্ষেত্রেই সংকটে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ তার পুরোনো মর্যাদা ফিরে পাক, এটাই শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের চাওয়া।