প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হয় না নিউমুরিং টার্মিনালে
Published: 7th, July 2025 GMT
চট্টগ্রাম বন্দরের ৪৪ শতাংশ কনটেইনার এককভাবে পরিচালনা করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই টার্মিনালে সাত বছর ধরে প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত দরপত্র হচ্ছে না। ২০১৮ সালের পর সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) অনুসরণ করে ছয় মাসের জন্য ১৩ বার দরপত্র দেওয়া হয়েছে এনসিটিতে। শুধু সাইফ পাওয়ার টেককেই এভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ১২ বার। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে এখন ড্রাইডকের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনা করবে নৌবাহিনী।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ডিপিএম হচ্ছে প্রতিযোগিতাহীন একটি অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতি। যখন কোনো উপায় থাকবে না তখন জরুরি প্রয়োজনে এই পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। তবে বছরের পর সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এমন অস্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতাহীন পদ্ধতিতে ব্যবহার করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে খরচ ও দুর্নীতির সুযোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি-চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি এম সিকান্দার হোসেন বলেন, ‘বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না হওয়া দুঃখজনক। ৪৪ শতাংশ কনটেইনার যে টার্মিনাল হ্যান্ডল করে, সেখানে কেন ডিপিএমের মতো অস্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতাহীন পদ্ধতি অনুসরণ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়– বোধগম্য নয়।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘বিশেষ কারণে এক বা দু’বার ডিপিএম পদ্ধতিতে কার্যাদেশ দিলে এমন বিতর্ক তৈরি হতো না। ২০১৮ সালের পর আর কোনো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না হওয়ায় আমাদের পণ্য পরিবহন খরচও কমছে না। স্বচ্ছতাও ফিরছে না বন্দরের কার্যক্রমে।’
২০০৭ সাল থেকে সাইফ পাওয়ার টেক এনসিটি পরিচালনা করলেও সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ নেয় তারা। সেবার টার্মিনালটির চার জেটিকে দুই প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুটি প্যাকেজে তখন ৯৯ কোটি টাকার কাজ পায় তারা। তিন বছরের এই কার্যকাল শেষ হয় তাদের ২০১৮ সালে। এর পর থেকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় আর কখনও দরপত্র ডাকা হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরে। ডিপিএম অর্থাৎ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ছয় মাস মেয়াদে বারবার কাজ দেওয়া হয়েছে সাইফ পাওয়ার টেককে। আওয়ামী লীগ আমলে সর্বশেষ গত জুলাইয়ে ১১তম বারের মতো সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় গত ৭ জানুয়ারি অর্ন্তবর্তী সরকারের আমলে। এ সরকার তখন একই পদ্ধতিতে মেয়াদ বাড়িয়ে আস্থা রাখে সেই সাইফ পাওয়ার টেকের ওপরেই। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া এভাবে এবার কাজ দেওয়া হয়েছে নৌবাহিনীকে।
গত ১৭ বছরে চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালের কাজও পেয়েছে সাইফ পাওয়ার টেক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ছয় বছরের জন্য প্রায় ৩০৪ কোটি টাকায় টার্মিনালটি পরিচালনার কাজ পায় তারা। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী নভেম্বরে। তবে দরপত্রের মাধ্যমে এ টার্মিনালে কাজ করছে তারা।
সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রেও আমরা এনসিটির কাজ পেয়েছি। আমরা দক্ষতার প্রমাণ দিতে পেরেছি বলেই আমাদের ওপর বারবার আস্থা রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে মন্ত্রণালয়ের সব নিয়ম মেনেই বন্দরে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এনসিটি ও সিসিটিতে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি কনটেইনার এককভাবে হ্যান্ডল করেছি।’
তিনি বলেন, ‘দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে বন্দরে কাজ করছি বলে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তারা নানা বদনাম ছড়ায়। ডিপিএম, নাকি অন্য পদ্ধতিতে কার্যাদেশ দেওয়া হবে, সেটা বন্দর ঠিক করে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। তবে উন্মুক্ত দরপত্র হলে আরও বেশি প্রতিযোগিতা থাকত।’
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বিশেষ কারণে ডিপিএম পদ্ধতিতে দরপত্র দিতে হচ্ছে এনসিটিতে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই আমরা এভাবে কার্যাদেশ দিয়েছি। একক কোনো সিদ্ধান্তে বন্দর এটা কখনোই করেনি।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
পশ্চিমাঞ্চল রেলে ভয়াবহ দুর্নীতি, সাবেক ২ জিএমসহ আসামি ১৮ জন
বাজারে একটি তালার দাম ১৭৩ টাকা, কিন্তু সেটি কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৫৯০ টাকায়। ২৬০ টাকার বালতি কেনা হয়েছে ১ হাজার ৮৯০ টাকায়, ৬৫ টাকার বাঁশির জন্য দেওয়া হয়েছে ৪১৫ টাকা, আর ৯৮ টাকার ঝাড়ু কেনা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ টাকায়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কেনাকাটায় এমন ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ ঘটনায় বুধবার (১৫ অক্টোবর) মামলা করেছে দুদক। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৮ জনকে। এর মধ্যে পশ্চিম রেলের সাবেক দুই মহাব্যবস্থাপকও (জিএম) রয়েছেন।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. রোকনুজ্জামান বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়, রাজশাহীতে মামলা দায়ের করেন।
এতে আসামিদের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় মোট দুই কোটি ১৮ লাখ ১৪ হাজার ১৯৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামিরা হলেন- অবসরে যাওয়া সাবেক মহাব্যবস্থাপক খোন্দকার শহিদুল ইসলাম ও মজিবুর রহমান, সাবেক সিওসি খায়রুল আলম ও বেলাল হোসেন সরকার, সাবেক এসিওএস জাহিদ কাওছার, তৎকালীন ডেপুটি সিসিএম ফুয়াদ হোসেন আনন্দ, তৎকালীন ডিএফএ শ্যামলী রাণী রায়, তৎকালীন উচ্চমান সহকারী আলামিন তালুকদার, সাবেক ডিএফএ (অর্থ) আলমগীর হোসেন;
তৎকালীন সিওপিএস এএমএম শাহনেওয়াজ, তৎকালীন এফএ অ্যান্ড সিএও শরিফুল ইসলাম, তৎকালীন ডেপুটি সিওপিএস হাসিনা খাতুন, সাবেক এফএ অ্যান্ড সিএও মসিহ উল হাসান, সাবেক এসিসিএম শেখ আব্দুল জব্বার, সাবেক অতিরিক্ত এফএ অ্যান্ড সিএও গোলাম রব্বানী, তৎকালীন অতিরিক্ত এফএ অ্যান্ড সিও গোলাম রহমান, সাবেক এফএ অ্যান্ড সিও সরোজ কান্তি দেব এবং সাবেক সিসিএম মিহির কান্তি গুহ।
দুদক জানিয়েছে, এই কর্মকর্তারা বিভিন্ন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে ১৫ থেকে ৩৩ গুণ বেশি দাম পরিশোধ করেছেন। রেলের অভ্যন্তরীণ তদন্তেই এসব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে দেখা যায়- একটি তালা কিনতে ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৯০ টাকা। যেখানে ভ্যাট, আয়কর ও মুনাফাসহ বাস্তবিক মূল্য ছিল মাত্র ১৭৩ টাকা। শুধু তালা কেনাতেই দুর্নীতি হয়েছে ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৪০০ টাকার।
অন্যদিকে, ২৬০ টাকার বালতি ১ হাজার ৮৯০ টাকায়, ৬৫ টাকার বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং ৯৮ টাকার ঝাড়ু ১ হাজার ৪৪০ টাকায় কিনে লুট করা হয়েছে ১৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
একইভাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে অফিসে ৫০টি ভিআইপি পর্দা কিনতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৩০০ টাকা, লাগেজ ফিতাসহ ওয়াগন কার্ড কেনায় ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা এবং ভিজিটিং চেয়ার, পেডাল ডাস্টবিন, লাগেজ ট্রলি, পাপোশ, ফটোকপিয়ার, স্টিল ফ্রেম চেয়ার, লেদার ক্যাশ ব্যাগসহ আরো ১৩ ধরনের পণ্য কেনায় ১ কোটি ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৬ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মোট চারটি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ১৭ ধরনের পণ্য কেনাকাটায় আত্মসাতের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ১৮ লাখ ১৪ হাজার ১৯৬ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক্কলন কমিটি বাজারদর যাচাই না করেই প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৫ থেকে ৩৩ গুণ পর্যন্ত বেশি দর নির্ধারণ করে দরপত্র আহ্বান করে। ১৬৬টি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয় এবং তারাই কার্যাদেশ পায়। মূল্যায়ন কমিটি বাজারদর যাচাই না করেই ইচ্ছাকৃতভাবে অধিক মূল্যের দর গ্রহণ করে।
দুদক বলছে, অনুমোদনকারী কর্মকর্তা দরপত্র বাতিল বা পুনরায় আহ্বান করার ক্ষমতা থাকলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে অনিয়মিতভাবে দরপত্র অনুমোদন দেন এবং ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। প্রাক্কলন কমিটি, মূল্যায়ন কমিটি, অনুমোদনকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা পরস্পর যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ কারণেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে আসামি করা হয়েছে।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, ‘‘মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এখন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, এরপর পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু হবে।’’
ঢাকা/কেয়া/এস