গণ–অভ্যুত্থানের পরে নারীদের কোণঠাসা করতে অনেক পুঁজি খরচ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে নারী অর্জনে থাকলেও উদ্‌যাপনে নেই। দেশের প্রতিটি স্তরে এমনকি সুপ্রিম কোর্টের মতো জায়গায়ও নারী হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। তাই নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে যদি সব মতের নারীরা এক হতে না পারেন, তাহলে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আজ শনিবার রাজধানীর রমনায় বিস মিলনায়তনে এক গোলটেবিল আলোচনায় নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘গণতন্ত্র বিনির্মাণে নারী: আমরা কী পেলাম’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজক ছিল উইমেন ইন ডেমোক্রেসি (উইন্ড)।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখনো দেশে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হয়নি। তিনি বলেন, ‘অনেক আশা ছিল, জুলাইয়ের পরে যেই সনদটা হবে, সেই সনদে আমরা নারীদের একটা অবস্থান দেখতে পাব। কিন্তু আশাহত হয়েছি। জুলাই সনদটা ইন্টিগ্রেট হবে কি না, সেটা নিয়েও আমরা হতাশায় রয়েছি।’

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশে নারীদের কোণঠাসা করার জন্য অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানের পরে আমরা একটা পরিবর্তন দেখেছি, অনেক পুঁজি খরচ করা হচ্ছে, যে নারীরা বাইরে এসে কথা বলতে চাচ্ছেন, তাঁদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক টাকা ইনভেস্ট করা হচ্ছে এটার জন্য।’

নারীদের চাকরির সময় পাঁচ ঘণ্টা হলে বা নারীরা ঘরে থাকলে কাদের সুবিধা হয়—তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘চাকরিদাতারা এসব মানুষকে নিতে চাইবেন না, যাঁরা একটা বিশেষ কারণে কম কাজ করবেন। অনেকে নারীদের অ্যালাউ করবে না, চাকরি করতে আসতে। কারণ, তাঁদের অলরেডি অর্ধেক সময় কাজ করতে দিতে হবে।’

নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে যদি সব মতের নারীরা এক হতে না পারেন, তাহলে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, তিনি নারীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীদের কাছ থেকেই সব থেকে বেশি বাধা পেয়েছেন। পুরুষের দৃষ্টিতে ভালো হওয়ার জন্য আরেকজন নারীকে কীভাবে টেনে নামানো যায়, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন অনেকে।

নারীরা নিজেরা সচেতন না হলে তাঁদের অধিকার আদায় করা কঠিন হবে বলে মনে করেন উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘সচেতনতাটা আমাদের পরিবার, আমাদের অফিস, ক্লাসরুম এমনকি আমাদের পলিটিক্যাল পার্টি, সবগুলোর মধ্যে নারীদের সচেতন হতে হবে। তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব।’

দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘সামনের দিনে আমরা তেমন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিতে চাই, যারা বেশিসংখ্যক নারী প্রার্থীকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেবে।’ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের নেতা–কর্মীদের জন্য নারী অধিকার নিয়ে একটি কোর্স বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে নারী অর্জনে থাকলেও উদ্‌যাপনে নেই বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি মারদিয়া মমতাজ। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা দেখলাম যখন স্টেবল অবস্থা চলে আসে, তখন আর নারীদের লাগে না। কারণ, তখন অনেক শক্তিশালী মানুষ সেখানে কাজ করেন।’

নারীদের কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টা করা প্রসঙ্গে জামায়াতের অবস্থান তুলে ধরে মারদিয়া মমতাজ বলেন, ‘কাজের ক্ষেত্রে মায়েদের জন্য পাঁচ ঘণ্টা কাজের সুযোগ থাকবে, কিন্তু তাঁরা আট ঘণ্টা কাজের সুযোগ পাবেন এবং এই বাড়তিটা ট্যাক্স থেকে দেওয়া হবে।’ এর বাইরে নারীদের জন্য তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পার্ট টাইম কাজের সুযোগ তৈরি ও যে নারীরা কাজ করতে চাইবেন না, তাঁদের সম্মানিত করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টেও অনেক নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী রাশনা ইমাম। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট এমন একটা জায়গা, যেখানে এসব জিনিস হয় না। অহরহ হচ্ছে। সিনিয়রদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এসব হয়রানির শিকার বিশেষত সেই নারীরা, যাদের শক্তিশালী কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি হলেও সেটা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আনফরচুনেটলি আমরা সেটা করতে পরিনি এবং এটার অনেক বড় দায় রাজনীতিবিদদের।.

..যেখানে নারীরা আরও বেশি ভালোভাবে রিপ্রেজেনটেটিভ হতে পারত সংসদে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে ১০০ করার।’

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর পিতৃতান্ত্রিকতা মানসিকতা জোরালোভাবে আবারও এসেছে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসলিমা মির্জা। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি, নারীকে পিঠ চাপড়ে দিতে অনেকে থাকেন, কিন্তু সামনে হাঁটার রাস্তা কেউ তৈরি করে দিতে চায় না।’

অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নিজেও অনলাইনে ‘বট বাহিনী’র আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা বলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। আগে যারা আক্রান্ত ছিল, তারা এখন আক্রমণকারী হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

টিভি উপস্থাপক কাজী জেসিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজ্ঞানী মুনিয়া আমিন; বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী, খান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রোখসানা খান, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামন্তা শারমিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোশরেফা হক অদিতি, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে কারা ভোগকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরা, মানবাধিকারকর্মী তাসলিমা আক্তার, আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন, এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসরিন সুলতানা ও পোশাকশ্রমিক পারুল বেগম।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খরচ কর ক জ কর র জন ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাবি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁবেদার ও অনুগত নাগরিক তৈরি করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথাগত জ্ঞান আহরণের কেন্দ্র না থেকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে সে গৌরব এখন ম্লান হয়ে গেছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে, স্মৃতিতে শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন বক্তারা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম ভূমিকা পালনের দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যে পতাকা ওড়ানো হয়েছে, সেটা আর কখনো নামেনি।

বইটির মুখবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জ্ঞান আহরণ, সৃষ্টি ও বিতরণ। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান আহরণের প্রথাগত কেন্দ্র হিসেবে না থেকে ইতিহাসের ভাঙা–গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে তার রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছে। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সেটার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিং নিয়ে ভিন্নমত জানিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা সেটা ভিন্নভাবে করতে হবে। এখন র‍্যাঙ্কিং নিয়ে আওয়াজ ওঠে। গণপরিসরে যখন আলাপ ওঠে তখন বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে গবেষণা ও প্রকাশনা না হওয়াকে দায়ী করা হয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পৃথিবীর কটা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে, স্মৃতিতে বইটির প্রথম প্রবন্ধ ‘অন্ধকারে আলো, আলোতে অন্ধকার’ শিরোনামের একটা পুরো জীবনদর্শনের সন্ধান মেলে জানিয়ে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার সবকিছু ব্যক্ত করেন সাংঘাতিক যুক্তির মধ্য দিয়ে। ওনার লেখা যখন শেষ করি, তখন মনে হয়, আমি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রমণ শেষ করেছি।’

উপাচার্যদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করছি না। কিন্তু উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়কে সৃজনশীলতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে মূল দায়িত্ব, সেটা পালনে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।’

লেখক ও অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘প্রথম প্রবন্ধটা বইটার সুর তৈরি করে দিয়েছে। স্যার সবকিছুকে ক্রিটিক্যালি দেখেন। যেমন সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে স্যারের পর্যবেক্ষণ। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দু–তিন মাস পরে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। স্যার তাঁর বইয়ে বলছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চমার্গীয় ব্যাপার। সিপাহিরা হচ্ছেন কৃষকের সন্তান।’

খ্যাতিমান নাট্যকার খায়রুল আলম সবুজ বলেন, ‘স্যারের লেখা যখন পড়ি, সেটা অন্তর ছুঁয়ে যায়।’

বিভিন্ন সময়ের লেখাগুলোকে একত্র করে বইটা লেখা জানিয়ে শিক্ষক ও লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের যে চেহারা ছিল, আগের যে গৌরব ছিল, সেগুলো ম্লান হয়ে গেছে, এটা খুবই সত্য কথা এবং সে জন্য যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় দায়ী, সেটা নয়। মূল পরিবেশ, গোটা সমাজের যে পরিবেশ, তাকে বিবেচনা করতে হবে। গোটা ব্যবস্থাটাই এমন পুঁজিবাদী একটা ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ আত্মস্বার্থ ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

বেঙ্গলবুকসের জ্যেষ্ঠ কনটেন্ট ডেভেলপার তৌহিদ ইমামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও হিউম্যানিটিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ফেরদৌস আজিম। আরও বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক কাজী সামিও শীশ।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গলবুকসের প্রকল্প প্রধান আজহার ফরহাদ। এরপর মঞ্চে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। বেঙ্গলবুকসের প্রকাশক মাহমুদুল হাসানের বক্তব্যের পর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ