পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসলে দৃষ্টিটা যেন মাঠের দিকে নামতে চায় না। চলে যায় উল্টো দিকের গ্যালারি আর ড্রেসিংরুমের ছাদের ওপর দিয়ে আরও সামনে, উঁচু পাহাড়ের দিকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজের সমারোহের এমন মনোমুগ্ধকর মাঠ ক্রিকেট বিশ্বে খুব বেশি নেই।
তবে মাঠে আসার উদ্দেশ্য যেহেতু ক্রিকেট, প্রেসবক্সে বসে সেদিকেই মনোযোগ ধরে রাখা কর্তব্য। তার ওপর পাল্লেকেলেতে আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে বাংলাদেশ দল। কলম্বো থেকে পরশু দুই দল ১–১ সমতা নিয়ে পাহাড়ের শহর ক্যান্ডিতে এসেছে। আজ শেষ ম্যাচে যারা জিতবে, সিরিজ তাদের।
কাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলমল করছিল সবুজ পাল্লেকেলে স্টেডিয়াম। পেছনের পাহাড় ততক্ষণে আঁধারে ঢেকে গেছে। শ্রীলঙ্কা দলের অনুশীলন শেষ হয়েছে তার একটু আগে। স্থানীয় সময় রাত ৮টায় অনুশীলনে নামা বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা গা গরম করছিলেন তখনো। তার আগে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলে গেছেন ওপেনার পারভেজ হোসেন।
মাঠে এসে সোজা সংবাদ সম্মেলনে, পারভেজের তাই তখনো ক্যান্ডির উইকেট দেখা হয়নি। উইকেট সম্পর্কে তখন পর্যন্ত তাঁর ধারণা সতীর্থদের কাছ থেকে শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে। ২০২৩ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যান্ডিতে খেলা সাত ক্রিকেটার আছেন এবারের দলেও। তাঁরা বলেছেন, পাল্লেকেলের উইকেট রানপ্রসবা।
সংবাদ সম্মেলনে পারভেজ হোসেন। কাল পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)