অকালে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য মায়ের আকুতি নিয়ে গান
Published: 25th, July 2025 GMT
‘লুকোচুরি শেষ হলো, আয় রে আয় খোকা/ খুঁজে তোকে ঘুরে ঘুরে, ক্লান্ত এবার তোর মা’—উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় অকালে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য মায়ের আকুতি গানে তুলে এনেছেন তরুণ সংগীতশিল্পী মল্লিক ঐশ্বর্য। গানটিতে উঠে এসেছে সন্তানহারা মায়ের হাহাকার আর কষ্ট। ‘আয় রে আয় খোকা’ শিরোনামের গানটি বলিউডের রং দে বাসন্তী সিনেমার ‘লুকাছুপ্পি’ গানের ভাবানুবাদ। যার মূল সুরকার এ আর রাহমান। হিন্দি গানটির লেখক প্রসূন যোশী ও নাসিম। সেই লেখাটিকেই ভাবানুবাদ করেছেন মল্লিক ঐশ্বর্য। তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন তরুণ সংগীতশিল্পী ইন্নিমা রশ্মি। গানটির শব্দ প্রকৌশলে ছিলেন শুভ। ফেসবুকে প্রকাশের ২১ ঘণ্টায় গানটির ভিউ ছাড়িয়েছে ১১ লাখ, আর শেয়ার হয়েছে ৭ হাজার।
আরও পড়ুন‘জুলাই বিপ্লবে আমার পুরোনো একটা গানকে সবাই আপন করে নিয়েছে’২৫ মার্চ ২০২৫গানটি নিয়ে মল্লিক ঐশ্বর্য বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার পর শুধু আমি কেন, দেশের কোনো মানুষই স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। পরদিন গানটিকে এভাবে লেখার বিষয়টা মাথায় আসে। “লুকাছুপ্পি”র আক্ষরিক অর্থ লুকোচুরি, তবে আমার দেওয়া নাম “আয় রে আয় খোকা”। এক দিনেই লেখা, পরিকল্পনা ও রেকর্ড। প্রতিভাবান তরুণ সংগীতশিল্পী ইন্নিমা রশ্মিকে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে গানটি তুলে আমাকে পাঠায় ও। গানটিতে বাচ্চাদের অংশগ্রহণ চেয়েছিলাম। আমার গানের স্কুল জাদুর কাঠির বাচ্চারা গানটিতে অংশ নিয়েছে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই গানটি সাড়া ফেলেছে। তবে মল্লিকের কথা, জনপ্রিয়তা পেতে নয়, গানটির মাধ্যমে মানুষের ভেতরের হাহাকার তুলে ধরতে চেয়েছেন। মল্লিক বলেন, ‘গানটি সবার হৃদয় ছুঁতে পেরেছে, এটাই প্রাপ্তি। মাইলস্টোনের দুর্ঘটনায় নিহত সবার আত্মা শান্তি পাক।’
গানটিতে রশ্মির গায়কি শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়েছে। এ তরুণ সংগীতশিল্পীও মনে করছেন, এ গান একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। রশ্মি বলেন, ‘মল্লিক দাদা গানের কথাগুলো পাঠানোর পর সারা রাত কেঁদেছি। মন এতটা ভার হয়েছিল, গান কি রেকর্ড করব, একেকটা লাইন পড়ার পর চোখ ভিজেছে। এরপর গানটি রেকর্ড ও ভিডিও করে দাদাকে পাঠাই। প্রকাশের পর থেকেই অনেকেই কল দিচ্ছেন, তাঁদের ভেতরের কষ্ট ও যন্ত্রণা শেয়ার করছেন। এ গানের মাধ্যমে এ ঘটনায় একজন শিল্পীর দায় পূরণ করার চেষ্টা করেছি।’
ফেসবুকে গানটি প্রকাশের পর অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, নাজনীন হাসান চুমকি, সংগীতশিল্পী পান্থ কানাইসহ শোবিজের অনেকেই মন্তব্য করেছেন। একেকটা মন্তব্য যেন একেকটা শোকবার্তা। চঞ্চল চৌধুরী ও পান্থ কানাই কান্নার ইমোজি দিয়েছেন, আর নাজনীন চুমকি লিখেছেন, ‘ওরে কলিজার সন্তানেরা।’ অভিনেত্রী পারভীন পারু লিখেছেন, ‘উফফফ, বুকের ভেতর বাতাস বন্ধ হয়ে যায়, চোখের পানি শুকায় না, আহ সন্তান আগুনে পোড়া ছোট পাখিগুলো! ওরা তো পাপ করার বয়সেও পৌঁছাতে পারেনি।’ সংগীতশিল্পী অন্তু দাস লিখেছেন, ‘ফুলগুলো ছিল আমাদের।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ নট ত গ নট র প রক শ
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ