পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের ‘কবর’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। ১৯২৫ সালে লেখা অমর এ কবিতার শতবর্ষ এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ‘কবর’ কবিতা তৎকালীন সময়ের সমাজের চিত্রকে তুলে ধরেছে।

‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে এ কথা বলেন বক্তারা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মফিজ ইমাম মিলন। ৪৮ জন লেখকের লেখা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থ প্রকাশ করেছে নয়নজুলি প্রকাশনাী।

অনুষ্ঠানে অতিথিদের বক্তব্যে উঠে আসে জসীমউদ্‌দীনের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার নানান প্রসঙ্গ। কবিতাটি ১৯২৫ সালে ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায়।

আলোচকেরা বলেন, ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। কবিতাটি দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এমনকি ‘কবর’ পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট’ শিরোনামে একটি আলোচনাও লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আববার বলেন, ‘কবর’ কবিতার শত বছর পূর্তির ঘটনা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কবিতাটির শতবর্ষ নিয়ে বই প্রকাশ ব্যতিক্রমী প্রয়াস।

এ সময় শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, প্রতিটি শহরে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের মতো সংগঠন থাকা উচিত। একটা বৃহত্তর পরিবারের মতো কাজ করে তারা। তিনি বলেন, এ ধরনের নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের বাইরে থেকে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে ভাবে। এটা বিশাল শক্তি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফরিদপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জালাল আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক আন্দালিব রাশদী, পক্ষিবিশারদ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈন উদ্দীন। গবেষক, সাংবাদিক ও ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মফিজ ইমাম মিলনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন নয়নজুলি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী খান, অধ্যাপক এম এ সামাদ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায়, ডেইলি স্টারের সাহিত্য সম্পাদক ইমরান মাহফুজ প্রমুখ।

‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘কবর’ কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। স্বাগত বক্তব্য দেন ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আলতাফ হোসেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র শতবর ষ অন ষ ঠ ন গ রন থ প রক শ

এছাড়াও পড়ুন:

শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহনে ‘অচলাবস্থা’

দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দ মোহন কলেজ। ১১৭ বছরের পুরোনো এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘জ্ঞানের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে নানা সংকটে ধুঁকছে।

বর্তমানে কলেজটিতে ২১ বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও ২০ বিভাগে স্নাতকোত্তর চালু আছে। আছে উচ্চমাধ্যমিকও। সব মিলিয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪১ হাজার ৮৮৩ জন। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮০ জন। যদিও শিক্ষকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২০৮।

এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষের অভাব, আবাসনসংকট রয়েছে। পরিবহনও অপ্রতুল। এর বাইরে প্রায় দুই মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।

বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম। মোরসালিন মিয়া, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ

শ্রেণিকক্ষের সংকট

ইংরেজি বিভাগে শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র দুটি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আজ (২১ অক্টোবর) এক ক্লাস শেষ হতেই রুম ছেড়ে দিতে হয়েছে, মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। অন্তত পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ দরকার, কিন্তু আছে মাত্র দুটি।’

কলেজে ৪১ হাজার ৮৮৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬টি শ্রেণিকক্ষ। গড়ে ৫৫১ শিক্ষার্থীর জন্য একটি কক্ষ। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, আরও অন্তত ৫০টি শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ। পরীক্ষার সময় অন্য বিভাগের কক্ষ ব্যবহার করতে হয়। আরও দুটি কক্ষ থাকলে ভালো হতো।’

এদিকে বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শৌচাগারের সংকট। ইংরেজি বিভাগের একমাত্র শৌচাগারে কল নষ্ট, পানি নেই। শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে সবাই একই টয়লেট ব্যবহার করি, ফ্লাশ কাজ করে না।’

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নেসার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শৌচাগারই নেই, অন্য বিভাগে যেতে হয়।’

বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম সিদ্দিকী বলেন, ‘সিঁড়ির পাশে থাকা শৌচাগার ব্যবহার করা হয়, স্থায়ী সমাধান দরকার।’

পর্যাপ্ত নয় পরিবহন

৪২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজের নিজস্ব বাস আছে মাত্র তিনটি। মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট রুটে চলে সেগুলো। ভালুকা-ময়মনসিংহ রুটে একটি ভাড়ায় নেওয়া বাস রয়েছে।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী হাফিজা আক্তার বলেন, ‘বাসে ৪০ জনের সিট, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে ৮০ জন যাতায়াত করি। বাস মিস করলে ১৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। পরিবহন বাড়ানো খুব দরকার।’

কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, জেলার ১৩ উপজেলার শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না থাকায় রুট বাড়ানো যাচ্ছে না।

নিয়ম এখন ‘অতিরিক্ত সিট’

কলেজে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের চারটি হল আছে। ধারণক্ষমতা ছেলেদের ৩৫০ ও মেয়েদের ৪৫০, কিন্তু বাস্তবে থাকেন আরও বেশি।

কাজী নজরুল ইসলাম হলের শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘চারজনের রুমে এখন পাঁচজন থাকা নিয়ম হয়ে গেছে।’

খালেদা জিয়া হলের ছাত্রী আঞ্জুমান নাহার বলেন, ‘ছয়জনের রুমে থাকি ১২ জন। বছরে ৬ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়, প্রতিদিন ৬০ টাকা মিল খরচ। কিন্তু ঠাসাঠাসিতে পড়াশোনা করা যায় না।’

যদিও হলের সুপার ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ঝরনা বেগম দাবি করেন, ‘রুমে ১০ জনের বেশি কেউ নেই, পুরোনো সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়েছে।’

কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ছেলেদের নতুন পাঁচতলা হলের কাজ প্রায় শেষ। আরও একটি নতুন হল নির্মাণাধীন। তবে শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন এখনো অপ্রতুল।

ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন মিয়া বলেন, ‘বাইরে মেসে থাকতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। হলে সুযোগ পেলে খরচ বাঁচত, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতাম।’

রিডিং রুম নেই, গ্রন্থাগারও অচল

মেয়েদের চারটি হলে (সৈয়দা নাফিসা ইসলাম, তারামন বিবি, খালেদা জিয়া ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম) কোনো রিডিং রুম নেই। তাঁরা ডাইনিং রুমেই পড়াশোনা করেন।

অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী সালিহা জাহান বলেন, ‘ডাইনিংয়ে কেউ খাবার না খেলে সেখানে বসেই পড়ি।’

গ্রন্থাগারে আছে প্রায় ৫০ হাজার বই, কিন্তু ভবন নির্মাণের কারণে দুই বছর ধরে অস্থায়ী কক্ষে চলছে কার্যক্রম। সেখানে বই থাকলেও নেই পাঠের জায়গা। নিবন্ধিত পাঠক মাত্র ৪২০ জন।

গ্রন্থাগারের কর্মী লাকি আক্তার বলেন, আগে সবাই এসে পড়ত, এখন জায়গা নেই বলে বই নিতে আসে কম।

তিন হলে এক ডাইনিং

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, আবু সালেহ হল (তরুণ হল) ও জসীমউদ্‌দীন হল—ছেলেদের এ তিন হলের জন্য একটি ডাইনিং রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৫ জনের খাবার রান্না হয়। তিন বেলা খাওয়ার জন্য লাগে ৭০ টাকা।

শিক্ষার্থী আহমেদ জুনাইদ বলেন, ‘প্রতিদিন একেক রুম থেকে মিল ম্যানেজার দায়িত্ব নেয়। টাকাটা আমরা নিজেরাই তুলি।’

ডাইনিংয়ের কর্মী আলাল উদ্দিন বলেন, ‘৭০ টাকায় তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। টাকার হিসাবে খাবার খারাপ নয়। কিন্তু টাকা ভালো হলে খাবারও ভালো হতো।’

সংকট সুরাহার দাবি

কলেজের অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে গত ৩১ জুলাই ওএসডি করা হয়। এরপর ৩ আগস্ট উপাধ্যক্ষ সাকির হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তবে ১২ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে নামেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে চেয়ার বাইরে ফেলে দেন তাঁরা।

এখনো অফিসে যেতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষার্থীরা ২১ অক্টোবর সাত দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অনতিবিলম্বে অধ্যক্ষ পদায়ন করতে হবে; হিন্দু হল দ্রুত চালু করতে হবে; প্রশাসনিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে একটি পুলিশ বক্স চান শিক্ষার্থীরা।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাকির হোসেন বলেন, এত বড় কলেজে সমস্যা থাকবেই, পর্যায়ক্রমে সমাধান হবে। তবে কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও রাজনীতিক আনন্দ মোহন বসুর নামে ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। তবে কার্যক্রম শুরু হয় পরের বছর, ১৯০৯ সালে। একসময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল আনন্দ মোহন কলেজ। কিন্তু এখন শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, গ্রন্থাগার, পরিবহন—সব ক্ষেত্রেই সংকটে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ তার পুরোনো মর্যাদা ফিরে পাক, এটাই শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের চাওয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিশ্বের প্রথম ৫ লাখ কোটি ডলারের কোম্পানি এনভিডিয়া
  • শতবর্ষী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহনে ‘অচলাবস্থা’