কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ৩ আগস্ট (২০২৪) শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপের এক দফা ঘোষণা করেন। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে সেদিন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক বৈঠকে রাজনৈতিক শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এই আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিন মধ্যরাতেই ঢাকার অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী দল–সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীরা শক্তির মহড়া দিতে শুরু করেন।

পরদিন (৪ আগস্ট) সকাল থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা আন্দোলন প্রতিরোধে নেমে পড়েন। তাঁদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা, রামদাসহ নানা রকম দেশি অস্ত্র। অনেকে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিও চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষে জড়াতে দেখা যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে সেদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৫০টি জেলায় সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এদিন ঢাকাসহ ২০টি জেলা-মহানগরে ৯৮ জন মানুষ নিহত হন, আহত হন অনেক মানুষ। দেশের অন্তত ৩৮টি জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৩টি স্থানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসভবন ও নিজস্ব কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। ঢাকার শাহবাগে বিএসএমএমইউতে হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন সরকার ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। এ ছাড়া ৫ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনের (৫, ৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়।

শুধু তা–ই নয়, সাত দিনের মাথায় এদিন দুপুর ১২টার পর সরকারি একটি সংস্থার নির্দেশে আবার ফোর–জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবাও বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেলা একটার পর মৌখিক নির্দেশনায় মেটার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বন্ধ রাখতে বলে সরকারি একটি সংস্থা।

রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন, হাইকোর্টে শুনানি

টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ৪ আগস্ট দেশের বিদ্যমান অবস্থায় সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে রাজধানীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা বলেন, ‘রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল (অব.

) ইকবাল করিম ভূঁইয়া। সমাপনী বক্তব্য দেন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নূরউদ্দীন খান।

এক রিটের শুনানিতে এদিন হাইকোর্ট বলেন, মানুষের জীবন ও মর্যাদা সুরক্ষার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং তারপর প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার করতে পারে। যদি আইন লঙ্ঘন না ঘটে বা কোনো দাঙ্গা না হয়, তবে কোনো প্রাণঘাতী গুলি (লাইভ বুলেট) ব্যবহার করা যাবে না।

‘মার্চ টু ঢাকা’

ইন্টারনেট আবারও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখন এই আলোচনা হচ্ছিল। সে জন্য ৪ আগস্ট দুপুরেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরের দিনের (৫ আগস্ট) কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ‘শহীদ স্মরণে’ সারা দেশে নিহতের স্থানগুলোতে শহীদ স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হবে। ঢাকায় বেলা ১১টায় শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ এবং বিকেল ৫টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারী সমাবেশ হবে। পাশাপাশি সারা দেশে বিক্ষোভ ও গণ–অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।

৬ আগস্ট ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা’ স্লোগানে সারা দেশের ছাত্র, নাগরিক ও শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়ে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাহিদ। সেদিন বেলা ২টায় আন্দোলনকারীদের শাহবাগে জমায়েত হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। বলেন, এক দফা দাবিতে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত সবাই রাজপথ দখলে রাখবেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।

কিন্তু সেদিন বিকেলে পৃথক বিবৃতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্তে আমাদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো। অর্থাৎ, ৫ আগস্টই সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।’ কর্মসূচি এগিয়ে আনার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আজ প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতাকে খুন করেছে খুনি হাসিনা। চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার সময় এসে গেছে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত ৪ আগস ট ৫ আগস ট আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘শরিয়াহ ও সরকারি নীতিবিরোধী’: নারী ও ইরানি লেখকদের ১৪০টিসহ ৬৭৯ বই নিষিদ্ধ করল তালেবান

আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচি থেকে নারীদের লেখা বই নিষিদ্ধ করেছে তালেবান সরকার। মানবাধিকার ও যৌন হয়রানি–সম্পর্কিত বিষয়ে পাঠদানের ওপর একটি নতুন নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

শরিয়াহবিরোধী ও সরকারি নীতির পরিপন্থী বলে মনে হওয়ায় ৬৭৯টি বইকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে চিহ্নিত করেছে তালেবান। নিষিদ্ধ এসব বইয়ের মধ্যে ১৪০টি নারীদের লেখা ও ৩১০টি ইরানি লেখকদের লেখা বা ইরানে প্রকাশিত।

নিষিদ্ধ বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠার একটি তালিকা আফগানিস্তানের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।

আফগান সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হয়েছে, তারা এখন থেকে ১৮টি বিষয়ে পাঠদান করতে পারবে না। তালেবানের এক কর্মকর্তা বলেন, এসব বিষয় মূলত ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি ও সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

চার বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ ধরনের নানা নিয়মকানুন জারি করেছে তালেবান সরকার। চলতি সপ্তাহেই তালেবানের সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশে অন্তত ১০ প্রদেশে ‘ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা বলেছেন, অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

আফগান সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হয়েছে, তারা এখন থেকে ১৮টি বিষয়ে পাঠদান করতে পারবে না। তালেবানের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এসব বিষয় মূলত ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি ও সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অনেকের মতে, এসব নিয়মকানুন আফগানিস্তানের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে কিশোরী ও নারীরা এসব নিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির পর থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ। ২০২৪ সালের শেষ দিকে ধাত্রীবিদ্যা বা মিডওয়াইফারি কোর্সও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ১৮ বিষয়ে পাঠদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তার ৬টিই নারীদের নিয়ে, যেমন ‘জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’, ‘দ্য রোল অব উইমেন ইন কমিউনিকেশন’ ও ‘উইমেনস সোসিওলজি’।

আরও পড়ুনআফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে কী কারণে স্বীকৃতি দিল রাশিয়া ১৪ জুলাই ২০২৫

তালেবান সরকার বলেছে, তারা আফগান সংস্কৃতি ও ইসলামিক আইনের ভিত্তিতে নারী অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

তালেবানের এসব নিয়মকানুন দেশটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে কিশোরী ও নারীরা এসব নিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তবে আফগানিস্তানের বই পর্যালোচনা কমিটির একজন সদস্য বিবিসিকে বলেন, নারী লেখকদের সব বই পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নিষিদ্ধ বইগুলোর তালিকায় আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের বিচার মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী জাকিয়া আদেলির বইও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘চার বছরে তালেবান যা করেছে, তাতে পাঠ্যসূচিতে এমন পরিবর্তনে অবাক হইনি। নারীরা পড়াশোনা করতে পারছেন না। তাদের মতামত ও লেখালিখির অধিকারও দমন করা হবে, এটাই স্বাভাবিক।’

আরও পড়ুনরাশিয়ার পর আর কোন কোন দেশ তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে পারে০৫ জুলাই ২০২৫

গত আগস্টের শেষ দিকে বই নিষিদ্ধের অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন তালেবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক জিয়াউর রহমান আরিয়ুবি। তিনি বলেন, আলেম ও বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শুধু নারী লেখকই নয়, নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় ইরানি লেখক ও প্রকাশকদের বইও রয়েছে। বই পর্যালোচনা কমিটির এক সদস্য বলেন, আফগান পাঠ্যসূচিতে ইরানি বিষয়বস্তুর প্রবেশ ঠেকাতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনতালেবান শাসনের তিন বছর, কেমন আছে আফগানিস্তান১৫ আগস্ট ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ