একসময়ের ক্যারিশমেটিক ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খান পাকিস্তানে সংস্কার ও পুনর্জাগরণের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নিয়ে এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, তিনি রাওয়ালপুরির আদিয়ালা কারাগারে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন।

২০২৩ সাল থেকে ইমরান এই কারাগারেই বন্দী। তাঁর ছেলে কাসিম খান এখন বাবার ‘জীবিত থাকার প্রমাণ’ এবং মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন। ইমরান খানের বয়স ৭২ বছর।

ইমরানের মৃত্যু যদি সত্য হয়, তবে এটি হবে এমন এক জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি, যেখানে ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নিপীড়ন।

লাহোরে ১৯৫২ সালে এক সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্ম নেওয়া ইমরান খান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি পড়েছেন আইচিসন কলেজ, রয়্যাল গ্রামার স্কুল, উস্টার এবং অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে।

আরও পড়ুন‘আর্মির দেশ’ পাকিস্তান ও ইমরান খানের লড়াই২৯ মে ২০২৩

খেলোয়াড় হিসেবে ইমরানের উত্থান শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে। আর তাঁর চূড়ান্ত সাফল্য আসে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ের মধ্য দিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে তিনি কৌশলগত দীক্ষা, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব এবং ভেতরে ভাঙন ধরা দলকে একত্র করার সক্ষমতার জন্য প্রশংসিত ছিলেন।

ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর ইমরান খান মানবসেবায় মনোনিবেশ করেন। তিনি তাঁর মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেন শওকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজারো মানুষ বিনা মূল্যে চিকিৎসা পেয়েছে। এই হাসপাতাল গড়ে ওঠে মূলত সাধারণ মানুষের অনুদানে। এটি ইমরানের জনপ্রিয়তা ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগের প্রমাণ দেয়।

এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মোড়

কিন্তু ইমরানের জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ পুরোপুরি রাজনীতিতে নিমজ্জিত ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল গঠন করেন। শুরুতে দলটি রাজনীতির প্রান্তেই ছিল। কিন্তু ২০১০-এর দশকে এসে হঠাৎ করেই এর ব্যাপক উত্থান ঘটে। দুর্নীতিবিরোধিতা, জাতীয় মর্যাদা এবং ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র—এই তিনটি তাঁর মূল স্লোগান ছিল।

রাজতন্ত্রসুলভ রাজনীতি ও সামরিক হস্তক্ষেপে বিরক্ত এক নতুন প্রজন্মের মধ্যে এসব কথা গভীর প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হন এবং ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাঁর শাসনামল ছিল অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানের সর্বদা উপস্থিত ছায়ার সঙ্গে এক কঠিন লড়াইয়ে পরিপূর্ণ। এই ‘ডিপ স্টেট’ শেষ পর্যন্ত তাঁর পথচলাকেই থামিয়ে দেয়।

আমি ইমরান খানকে তাঁর জীবনের তিনটি ভিন্ন পর্যায়ে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা নিউইয়র্কে, জাতিসংঘে কাজ করার সময়। তাঁর বোন (যিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তা ছিলেন) নিজের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ইমরান খানও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট তারকা। আমি তাঁর উষ্ণতা, সহজ ভঙ্গি এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি কোনো দূরত্ব রাখা নায়ক নন, বরং ছিলেন কৌতূহলী ও বন্ধুবৎসল এক মানুষ।

ইমরানের মৃত্যুর গুজব এখনো স্পষ্ট নয়। নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, সামরিক গোয়েন্দা কাঠামোর ভেতরের কোনো অংশ তাঁকে হত্যা করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এই নীরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়।

বছর কয়েক পরে ইমরান যখন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে ভারতে আসতেন, তখন আরও কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমরা একই সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতাম, এমনকি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন আলোচনাতেও মুখোমুখি হতাম।

ক্রিকেট, রাজনীতি বা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক—সব বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, তর্কপ্রবণ এবং চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী। আমাদের দুই দেশের উত্তেজনার মাঝেও তিনি ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁর ক্রীড়া-উত্তরাধিকার আর ব্যক্তিগত ভদ্রতা তাঁকে মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।

এক ঘণ্টার কথোপকথন

ইমরান খানের সঙ্গে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎ হয় ২০১৭ সালে। তখন আমি ভারতীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ইসলামাবাদে এশীয় সংসদ সদস্যদের এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। তখন ইমরান খান ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাকে হোটেলের বাইরে যেতে দেয়নি। এতে তিনি দমে যাননি। উল্টো তিনি নিজেই আমার কাছে আসার প্রস্তাব দেন।

তিনি ছয়-সাতজন সহযোগী নিয়ে আমার হোটেলে আসেন। আমি তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানাই। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন বিজেপির দুই সহকর্মী—স্বপন দাশগুপ্ত ও মীনাক্ষী লেখী, যাতে কেউ এই বৈঠক নিয়ে কোনো অনৈতিকতার অভিযোগ তুলতে না পারে।

এরপর প্রায় এক ঘণ্টা আমরা কথা বলি। আশ্চর্যের বিষয়, সেই আলোচনা রাজনীতি নিয়ে ছিল না; ছিল ইতিহাস নিয়ে। ইমরান তখন আমার লেখা বই অ্যান এরা অব ডার্কনেস পড়া শেষ করেছেন। তিনি আমাকে জানালেন, বইটি তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। তিনি বইয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ধৃতি দেন, নানা তথ্য নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং অবিভক্ত ভারতের সময়কার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর নিজের ভাবনাও ভাগ করে নেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তানে তাঁর অতিথি হয়ে এসে এই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলি। বিষয়টি আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবু ওই সাক্ষাৎ আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে।

আমি দেখলাম, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও ইমরান একজন চিন্তাশীল মানুষ। উপমহাদেশের যৌথ ইতিহাস বিষয়ে তিনি গভীর আগ্রহ ও আবেগ পোষণ করেন।

আরও পড়ুনপাকিস্তানে রাজনৈতিক ঝড় ও ইমরানের ‘বাংলাদেশ দর্শন’২৫ মে ২০২৩বিরুদ্ধতায় ভরা নেতৃত্ব

সেনাবাহিনীর সক্রিয় সমর্থনে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল একধরনের বিরোধাভাসের উদাহরণ। তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তি চেয়েছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর কৌশলগত চিন্তার কারণে সে পথে এগোনো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও ঋণের ভার সামলাতে পারেননি। তিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। অথচ তাঁকেও নানা দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছে।

২০২২ সাল থেকে তাঁর পতন শুরু হয়। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে তিনি মুখোমুখি সংঘর্ষে যান। এর ফলেই অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার এবং একঘরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি কারাগারে চলে যান এবং একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। অনেকের কাছে এই মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়েছে।

আরও পড়ুনযে পাঁচ কারণে ইমরানের পিটিআই ব্যর্থ হলো০৩ এপ্রিল ২০২২

গত কয়েক বছর পাকিস্তানে দমন-পীড়ন আরও বেড়েছে। ইমরান খানকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে কঠোর অবস্থায় রাখা হয়েছে। দল থেকে তাঁকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।

অনেক পাকিস্তানির কাছে তিনি তখন প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তাঁর বোনেরা যখন আদিয়ালা কারাগারের বাইরে প্রতিবাদ করছিলেন, তখন নাকি পুলিশ তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এটি দেখায়, রাষ্ট্র তাঁর প্রভাব মুছে ফেলতে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

ইমরানের মৃত্যুর গুজব এখনো স্পষ্ট নয়। নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, সামরিক গোয়েন্দা কাঠামোর ভেতরের কোনো অংশ তাঁকে হত্যা করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এই নীরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়।

যদি এটি সত্য হয়, তাহলে কারাগারে তাঁর মৃত্যু পাকিস্তানের অন্ধকার ও যন্ত্রণাদায়ক রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটি মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে।

আরও পড়ুনগদিহারা ইমরানের জন্য রাজপথে এত মানুষ কেন১২ এপ্রিল ২০২২ভাঙা স্বপ্ন

ইমরান খানের উত্তরাধিকার জটিল। তিনি একাধারে জাতীয় নায়ক, বৈশ্বিক আইকন, সংস্কারক নেতা এবং একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন, অনেককেই হতাশ করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা নত করেননি। তাঁর জীবন উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাক্ষ্য দেয়—কি খেলায়, কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রে, কি রাজনীতিতে।

ইমরানের মৃত্যু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং সবার জন্যই এক বড় ট্র্যাজেডি। বিশেষ করে যাঁরা অস্থির সময়ে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁদের জন্য তাঁর মৃত্যু গভীর বেদনার বিষয় হবে।

ইমরানের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয় আরেক পাকিস্তানি নেতার কথা। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনিও ভেবেছিলেন, তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন। কিন্তু সেই ভুল ধারণার মূল্য তাঁকে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়েছিল।

আমার কাছে ইমরান খান সব সময় সেই মানুষটিই হয়ে থাকবেন, যিনি ইসলামাবাদে আমার হোটেলে এসেছিলেন—রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে নয়, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে। চিন্তা, আবেগ ও বিশ্বাসে দৃঢ় একজন মানুষ। তিনি যে ‘ডিপ স্টেট’-এর সহায়তায় ক্ষমতায় উঠতে চেয়েছিলেন, পরে সেটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিকে জয় করতে পারেননি। আর সেখানেই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়।

শশী থারুর ভারতের কেরালা রাজ্যের তিরুঅনন্তপুরম থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য।

এনডিটিভি থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইমর ন র ম ত য ইমর ন খ ন র র জন ত ক ন র জন র জন য ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করায় কী প্রভাব পড়বে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ‘তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করবেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রশাসনের অভিবাসন দমননীতি আরও কঠোর হলো।

বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাশনাল গার্ডের দুই সদস্যকে গুলি করা হয়। তাঁদের একজন পরে মারা গেছেন। এ ঘটনার পরদিনই ট্রাম্প ওই বক্তব্য দেন। ঘটনাটির প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে একজন আফগান নাগরিকের নাম এসেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিকমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমি তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ থেকে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করব, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয় এবং বাইডেন প্রশাসনের আমলে লাখ লাখ মানুষকে দেওয়া অবৈধ প্রবেশের সুযোগ বন্ধ করা যায়।’

‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলতে ট্রাম্প কোন কোন দেশকে বোঝাচ্ছেন, তা স্পষ্ট করেননি। সাধারণত এ শব্দগুচ্ছ দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল ‘গ্লোবাল সাউথ’ দেশগুলোকে বোঝানো হয়।

এ নিষেধাজ্ঞা দরিদ্র দেশগুলোকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে, আর যেসব দেশ বিনিময়ে কিছু দিতে পারে, যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ বা কৌশলগত সুবিধা-তাদের ক্ষেত্রে হয়তো শিথিল থাকবে। এমন ঘোষণার মূল লক্ষ্য হলো, সরকারকে কঠোর দেখানো, রাজনৈতিক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি বদল, অভিবাসীদের ভয় দেখানো ও তাঁদের মানুষ হিসেবে কম মূল্যবান ভাবার পরিস্থিতি তৈরি করা; বাস্তবে এটি কার্যকর করা যাক বা না যাক এবং আইনগত ফলাফল যা-ই হোক।

ট্রাম্প বলেন, যেকেউ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্পদ নয় বা আমাদের দেশকে ভালোবাসতে অক্ষম, তাঁকে এ দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন কাউকে আর কোনো ফেডারেল সুবিধা বা ভর্তুকি দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা অভ্যন্তরীণ শান্তি নষ্ট করেন, এমন অভিবাসীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে। আর যাঁরা সরকারিভাবে নির্ভরশীল, নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত বা পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নন—এমন বিদেশিদের বহিষ্কার করা হবে।’

চলতি বছর ট্রাম্প ১২টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন এবং আরও সাতটি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা সীমিত করেছেন। বছরজুড়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর আরও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলো—

ট্রাম্প প্রশাসন কী বলছে

বুধবার ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ২৯ বছর বয়সী আফগান নাগরিক রহমানউল্লাহ লাখানওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ট্রাম্প ঘটনাটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে আখ্যা দেন।

সেদিন রাতে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের সময় আফগানিস্তান থেকে যেসব বিদেশি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারে আমাদের সবাইকে আবার নতুন করে পরীক্ষা করতে হবে।’

পরের দিন বৃহস্পতিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও অভিবাসন দপ্তর (ইউএসসিআইএস) আফগানদের সব ধরনের অভিবাসন আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।

ইউএসসিআইএসের পরিচালক জোসেফ এডলো পরে এক্সে লেখেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে ‘উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত সব দেশের নাগরিকদের দেওয়া প্রতিটি গ্রিন কার্ড আবার কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করার’ আদেশ দিয়েছেন তিনি।

তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে অভিবাসন স্থগিতের ঘোষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকা স্বামী-স্ত্রী, সন্তান বা মা–বাবার দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ হতে পারে—যত দিন না এ সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। এতে দীর্ঘ দূরত্বে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি, পরিবারভিত্তিক অভিবাসন আবেদন বিলম্বিত ও পারিবারিক পুনর্মিলন কর্মসূচি ব্যাহত হবেঅভিষেক সাক্সেনা, আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক পরামর্শক

এডলোর দপ্তর জানায়, যেসব দেশের নাগরিকদের গ্রিন কার্ড আবার পরীক্ষা করা হবে, সেগুলো জুন মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষিত ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে।

‘এ দেশ ও মার্কিন জনগণের সুরক্ষা সর্বাগ্রে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ পূর্ববর্তী প্রশাসনের বেপরোয়া পুনর্বাসন নীতির মূল্য বহন করবে না’, বলেন এডলো।

জুনে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে রক্ষায়’ ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর পূর্ণ বা আংশিক ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে।

পূর্ণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, চাদ, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, মিয়ানমার, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। আংশিক নিষেধাজ্ঞায় আছে (এখনো কিছু সাময়িক ভিসা দেওয়া হয়)–বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।

বৃহস্পতিবার রাতে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে বলেন, তিনি ‘তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ’ থেকে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করবেন।

‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করার অর্থ

এর অর্থ পরিষ্কার নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করা আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক পরামর্শক অভিষেক সাক্সেনা আল–জাজিরাকে বলেন, সাধারণভাবে ‘স্থায়ী বিরতি’ শুনতে চূড়ান্ত বলে মনে হলেও অভিবাসন আইনে এর নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই।

সাক্সেনা বলেন, বাস্তবে ‘স্থায়ী বিরতি’ বলতে সাধারণত এমন নিষেধাজ্ঞা বোঝায়; যার কোনো শেষ তারিখ নেই। কিন্তু এটি আইনের দিক থেকে অপরিবর্তনীয় অবস্থা নয়।

মার্কিন অভিবাসন ও নাগরিকত্ব আইন (আইএনএ) অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট সময় কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য অভিবাসীদের প্রবেশ স্থগিত করতে পারেন; যতক্ষণ না তিনি নিজে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা বাতিল করেন। তবে এটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। সাক্সেনা বলেন, ‘যদি এ অনির্দিষ্ট স্থগিতাদেশ কংগ্রেসের পাস করা কোনো আইনের বিরোধী হয়, তবে আদালতে এর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তারেক রহমান না এলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এমন নয়: তৌহিদ হোসেন
  • কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হলো বুক অলিম্পিয়াড
  • কেমন ছিলেন সাহাবি যুগের নারীরা
  • ‘সালাতুল হাজাত’ নামাজে যে দোয়া পড়বেন
  • মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কর্মবিরতি, রোগী ভোগান্তি চরমে
  • সাখাওয়াত স্যার, আপনার কাছে জাতির যত ঋণ
  • ঘাম ঝরে একজনের, নম্বর জোটে সবার
  • ৯ ক্রিকেটারের বিপিএলের নিলাম থেকে বাদ পড়ার ৩ কারণ
  • তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’ করায় কী প্রভাব পড়বে