ক্রন্দসী এখন বাংলা। বনলতা, বহুদিন আজ
আমাদের যোগাযোগ নেই। এখনো হাঁটছি আমি
ইতিহাস অন্ধকারে হাজার বছর। শ্যামভূমে
দিনের গভীরে দিন, রাতের আড়ালে রাত। তুমি
শুধু নও শূন্য—কবিতার খাতাও এখন। ভাগ্যে
যদি এই চিঠি পৌঁছে যায় ঠিকানায়, জেনো আজও
একজন বেঁচে আছে—লিখি বেঁচে আছে সে কীভাবে।

এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ—
আমি যে বাংলার কবি আমি এই কষ চেটে খাই
শব্দের বদলে আজ—ছন্দের বদলে আমি এই
কষ টেনে টেনে খাই; ইদানীং ইতিহাস এই।
আকাশের মহাশূন্যতায় এখন কবর খুঁড়ি;
বাংলার মাটিতে আজ মাটি নেই সাড়ে তিন হাত;
আকাশেই হতে পারে তবে স্থানসংকুলান।—ভালো!
যখন আকাশে ফের দেখা দেবে নক্ষত্রসকল—
প্রতিটি নক্ষত্র হবে আমাদের প্রতিটি মৃত্যুর
উজ্জ্বল ফলকচিহ্ন। আকাশেই তবে অবিরাম—খোঁড়ো।

বনলতা, বাড়িঘর শেয়ালেরই গর্ত আজ বটে
কালো সাপ কোলে নিয়ে অবরুদ্ধ বাড়িতে প্রবাসী—
কবিতা এ নয়—আমি লিখে চলি চিঠি তোমাকেই
সুদূর নাটোরে। এখন তোমার চুল শ্রাবস্তীর
দ্রুত কালো হয়ে যাচ্ছে ঘোর অমাবস্যার বুরুশে।
তোমাকেই লিখে চলি, বনলতা, সমূহ সংবাদ।
কিন্তু এ অক্ষর ছাঁদ, এটা কার? নিজেই চিনি না।

হঠাৎ গুলির শব্দ চৌরাস্তায়—নিশ্বাস লুকিয়ে
গর্তে আরও ঢুকে যাওয়া—কিন্তু কী অদ্ভুত, আমি আজ
আমা থেকে এতটা বিচ্যুত—গুলি চলছে সত্ত্বেও
পথে ছুটে যাই, দেখি লাশ; একটি কুকুর একা—
তার লেজ নড়ছে না, সটান উদ্বেগে খাড়া, শুঁকে
চলে মনিবের ঘ্রাণ নাকি মৃত্যুর বুটের ছাপ।
কবি কিম্বা অন্যতর এখন যে আমি সেই লোক
চাপা শিস দিয়ে তাকে কাছে ডাকি: তবে তুই–ই আয়!
কে এখন তুই ছাড়া! সে কি আসে! দৌড়ে ছুটে যায়।
বাঙালি যে আছে আজও মাটি কামড়ে এখনো বাংলায়—
ভীষণ চিৎকার করে উঠি আমি: এ–ই তো কোদাল,
ছুটে এসো ধারালো কোদাল, একটি কবর খোঁড়ো
তোমার মৃতের জন্য রূপসী বাংলায়।—স্তব্ধতাই!
এখন সময় দ্যাখো নষ্ট ধ্বস্ত সময়ে গড়ায়।

এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ।
যুদ্ধ কী করব আমি!—হৃৎপিণ্ডে এতখানি শোক—
নদীবক্ষে ভাসে লাশ—বন্ধ সব জানালা–দরোজা—
বাতাসে উৎকট ঘ্রাণ পেট্রলের সতত অস্থির।
মাংস কি কাঠের মতো চড়চড় পোড়ে? ব্যাবিলন
নিমেষেই হয়ে যেতে পারে কি শ্মশান? এখন যে
যুদ্ধ করে, শত্রুর বিরুদ্ধে যারা এখন সৈনিক
প্রতি হৃৎস্পন্দনে তাদের জানি আমারই স্পন্দন,
অবরুদ্ধ আমারই নিশ্বাস তারা টানছে এখন।
আমি যে বাঙালি, আমি এইভাবে নিজেকেই দ্যাখো
আজ বাঁচিয়ে রাখছি।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এখন স

এছাড়াও পড়ুন:

একাত্তরের চিঠি: প্রাপক বনলতা সেন

ক্রন্দসী এখন বাংলা। বনলতা, বহুদিন আজ
আমাদের যোগাযোগ নেই। এখনো হাঁটছি আমি
ইতিহাস অন্ধকারে হাজার বছর। শ্যামভূমে
দিনের গভীরে দিন, রাতের আড়ালে রাত। তুমি
শুধু নও শূন্য—কবিতার খাতাও এখন। ভাগ্যে
যদি এই চিঠি পৌঁছে যায় ঠিকানায়, জেনো আজও
একজন বেঁচে আছে—লিখি বেঁচে আছে সে কীভাবে।

এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ—
আমি যে বাংলার কবি আমি এই কষ চেটে খাই
শব্দের বদলে আজ—ছন্দের বদলে আমি এই
কষ টেনে টেনে খাই; ইদানীং ইতিহাস এই।
আকাশের মহাশূন্যতায় এখন কবর খুঁড়ি;
বাংলার মাটিতে আজ মাটি নেই সাড়ে তিন হাত;
আকাশেই হতে পারে তবে স্থানসংকুলান।—ভালো!
যখন আকাশে ফের দেখা দেবে নক্ষত্রসকল—
প্রতিটি নক্ষত্র হবে আমাদের প্রতিটি মৃত্যুর
উজ্জ্বল ফলকচিহ্ন। আকাশেই তবে অবিরাম—খোঁড়ো।

বনলতা, বাড়িঘর শেয়ালেরই গর্ত আজ বটে
কালো সাপ কোলে নিয়ে অবরুদ্ধ বাড়িতে প্রবাসী—
কবিতা এ নয়—আমি লিখে চলি চিঠি তোমাকেই
সুদূর নাটোরে। এখন তোমার চুল শ্রাবস্তীর
দ্রুত কালো হয়ে যাচ্ছে ঘোর অমাবস্যার বুরুশে।
তোমাকেই লিখে চলি, বনলতা, সমূহ সংবাদ।
কিন্তু এ অক্ষর ছাঁদ, এটা কার? নিজেই চিনি না।

হঠাৎ গুলির শব্দ চৌরাস্তায়—নিশ্বাস লুকিয়ে
গর্তে আরও ঢুকে যাওয়া—কিন্তু কী অদ্ভুত, আমি আজ
আমা থেকে এতটা বিচ্যুত—গুলি চলছে সত্ত্বেও
পথে ছুটে যাই, দেখি লাশ; একটি কুকুর একা—
তার লেজ নড়ছে না, সটান উদ্বেগে খাড়া, শুঁকে
চলে মনিবের ঘ্রাণ নাকি মৃত্যুর বুটের ছাপ।
কবি কিম্বা অন্যতর এখন যে আমি সেই লোক
চাপা শিস দিয়ে তাকে কাছে ডাকি: তবে তুই–ই আয়!
কে এখন তুই ছাড়া! সে কি আসে! দৌড়ে ছুটে যায়।
বাঙালি যে আছে আজও মাটি কামড়ে এখনো বাংলায়—
ভীষণ চিৎকার করে উঠি আমি: এ–ই তো কোদাল,
ছুটে এসো ধারালো কোদাল, একটি কবর খোঁড়ো
তোমার মৃতের জন্য রূপসী বাংলায়।—স্তব্ধতাই!
এখন সময় দ্যাখো নষ্ট ধ্বস্ত সময়ে গড়ায়।

এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ।
যুদ্ধ কী করব আমি!—হৃৎপিণ্ডে এতখানি শোক—
নদীবক্ষে ভাসে লাশ—বন্ধ সব জানালা–দরোজা—
বাতাসে উৎকট ঘ্রাণ পেট্রলের সতত অস্থির।
মাংস কি কাঠের মতো চড়চড় পোড়ে? ব্যাবিলন
নিমেষেই হয়ে যেতে পারে কি শ্মশান? এখন যে
যুদ্ধ করে, শত্রুর বিরুদ্ধে যারা এখন সৈনিক
প্রতি হৃৎস্পন্দনে তাদের জানি আমারই স্পন্দন,
অবরুদ্ধ আমারই নিশ্বাস তারা টানছে এখন।
আমি যে বাঙালি, আমি এইভাবে নিজেকেই দ্যাখো
আজ বাঁচিয়ে রাখছি।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সম্পর্কিত নিবন্ধ