গহিন সুন্দরবনে বাঘ বসবাসের স্থান হিসেবে পরিচিত শেখেরটেক। সেখানে ঘন গাছের সারির ভেতর ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইট-পাথরের প্রাচীন এক মন্দির। সেটি ৩৫০ বছরের পুরোনো বলে মনে করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। মন্দিরের আশপাশে দেখা যায় বাঘের আনাগোনা। পাওয়া যায় বাঘের টাটকা পায়ের ছাপও। এ কারণে জেলেরা এ স্থানের নাম দিয়েছেন ‘বাঘের বাড়ি’। সময়ের ব্যবধানে ক্ষয়ে যাওয়া বাঘের বাড়িখ্যাত মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কারের ছোঁয়ায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের শেখেরটেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরটির স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রথমবারের মতো সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরের চারদিকের দেয়ালের বাইরে পুরোনো নকশার আদলে নতুন ইটের গাঁথুনি তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরেও কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে মজবুত করা হয়েছে। বন বিভাগের অর্থায়নে সংস্কারকাজে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

তবে গত বছরের ২ মার্চ সেখানে গিয়ে মন্দিরটির ভঙ্গুর অবস্থা দেখা গিয়েছিল। তখন মন্দিরের ওপরটা আগাছায় ভরা ছিল। গাছের শিকড় প্রবেশ করায় ফাটল ধরেছিল দেয়ালে। মন্দিরের দেয়াল থেকে খসে পড়া ইটের অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারপাশে। মনে হয়েছিল, যেকোনো সময়ে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ভেঙে যেতে পারে।

মন্দিরটি সংস্কারকাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজমিস্ত্রি সোহানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের জন্য আমরা পুরোনো ইটের আদলে নতুন ইট তৈরি করে নিয়ে এসেছিলাম। তারপর সেই ইটের ওপর পুরোনো নকশার আদলে হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে নতুন করে নকশা তৈরি করি। আগের নকশা হুবহু রেখে আমরা মন্দিরটির অবকাঠামো পুনরায় সংস্কার করেছি।’

মন্দিরটি সংস্কারকাজে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন দাকোপ উপজেলার বানিয়াসান্তা গ্রামের বাপ্পি সরদার। তিনি বলেন, ‘এখানে বাঘের আনাগোনা বেশি। আমি ১৫ থেকে ২০ হাত দূর থেকে বাঘ দেখেছি। আমার সঙ্গে আরও একজন ছিল। আমরা মন্দিরের কাজ শেষে ফেরার সময় দেখি, পাকা পথের ওপর বসে আছে বাঘ। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা বাজি ফুটিয়ে বাঘটি তাড়িয়েছিলাম।’

‘বাঘের বাড়ি’খ্যাত প্রাচীন মন্দিরের অবস্থান সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন ১৬ নম্বর কম্পার্টমেন্টে। শিবসা নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শেখের খাল ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনের শেখেরটেক এলাকায় অবস্থিত মন্দিরটি। ইতিহাসবিষয়ক বিভিন্ন বইয়ে সুন্দরবনের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরোনো স্থাপনা হিসেবে মন্দিরটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু বছর ধরে মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও এবার তা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে বন বিভাগ।

শেখেরটেক খাল থেকে মন্দিরের চারপাশ দিয়ে পাকা পথ তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকদের সুন্দরবন দেখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। আর চারপাশে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে এক থেকে দেড় কিলোমিটারের দীর্ঘ পাকা পথ ধরে বনের মধ্যে অনায়াসে হেঁটে হেঁটে দেখা যায় সুন্দরবনের সৌন্দর্য। বনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশ্রামঘর। আর শেখেরটেক মন্দিরে যাওয়ার পথেই দেখা মেলে মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। চোখে পড়ে কোনোরকমে টিকে থাকা বাড়ির দেয়াল ও ইটের স্তূপ।

সংস্কারের আগে গহিন সুন্দরবনের ভেতরে যেমন ছিল মন্দিরটি। গত বছরের ২ মার্চ সুন্দরবনের শেখেরটেক এলাকায়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র মন দ র র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে 

দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।

সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।

বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় 

২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।

জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’

‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।

জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।

২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।

কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।

জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।

কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।

কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে হবে সুরক্ষাবলয়: পরিবেশ উপদেষ্টা
  • চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের আহ্বান উপদেষ্টার 
  • বাঙালির বাঘ সংস্কৃতি: ‘যে বনে বাঘ নেই সে বনে শিয়ালই রাজা!’
  • বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে
  • পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ
  • এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে