সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় নাট্যকার এহসানুল আজিজ দুই দিনের রিমান্ডে
Published: 19th, March 2025 GMT
দেশ নাটকের কর্ণধার নাট্যকার এহসানুল আজিজকে (বাবু) সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের পর আজ বুধবার তাঁকে গাজীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেন তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার সময় জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। ঘটনাটি তখন লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় হুমকিদাতা আলামিন হোসেন নামের এক যুবলীগ কর্মীকে ১৫ ফেব্রুয়ারি নগরের শিমুলতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশের কাছে তিনি স্বীকারোক্তি দেন। তাঁর স্বীকারোক্তিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সদর মেট্রো থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ আনোয়ার আকন্দ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এ থানায় একটি মামলা করেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে রনি সরকার, সাইফুর রহমান ও সিয়াম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্য ও মুঠোফোন পরীক্ষা করে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এহসানুল আজিজকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি এলাকা থেকে গতকাল রাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন মোবাইল ফোন ও তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গোপন সূত্রে পুলিশ জানতে পারে, আলামিন হোসেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জননিরাপত্তা বিপন্ন করতে অন্যান্য আসামির যোগসাজশে কাজ করছেন। পরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সদর থানার শিমুলতলী এলাকা থেকে আলামিনকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর স্মার্টফোন ও ব্যবহৃত সিম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আলামিন হোসেন তাঁর ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘চুমকি আপার সৈনিক’ থেকে পোস্ট দেয়, ‘আগামীকাল গাজীপুরে জঙ্গি হামলা হবে জুমার নামাজের পর এমন তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। গাজীপুরে যাঁরা আছেন, এই মেসেজটি সবাইকে জানিয়ে দেন।’ জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি রনি সরকারসহ কতিপয় ব্যক্তির নাম বলেন। রনি সরকার ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘মুজিব ভাই’, ‘আওয়ামী যুব লীগ’ এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘জুম ব্রিগেড’ (আমেরিকান প্রবাসী রাব্বি ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর ওই গ্রুপের অ্যাডমিন ও অর্থদাতা) এবং ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’সহ কয়েকটি সাব-গ্রুপের ক্রিয়েটর এবং আসামি আলামিনের সহযোগী। এই গ্রুপের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন সাইবার অপরাধ করছিলেন। গ্রুপগুলো বিশ্লেষণ করে আলামিনকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে রনি সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলামিন ও অন্য আসামিরা অনলাইন গ্রুপগুলো পরিচালনা করে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ করার নির্দেশনা দেয় এবং নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক ভিডিও বার্তা প্রচার করেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, ‘আলামিনের মোবাইল থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, আসামিরা ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেজ ব্যবহার করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে ও গাজীপুর মহানগরের সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতি ঘটিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য অনলাইনভিত্তিক অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে, অর্থায়ন করে, অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করে আসছে, যা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬ /৭ / ১০ ধারার অপরাধ।’
এদিকে নাট্যব্যক্তিত্ব এহসানুল আজিজকে গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি পোস্ট দিয়েছেন। তাঁরা তার মুক্তি দাবি করেছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর আল ম ন সরক র অপর ধ ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।