পানি সংকট মোকাবিলায় ‘ওয়াটার অ্যাটলাস’ জরুরি
Published: 21st, March 2025 GMT
‘হিমবাহ সংরক্ষণ’– বিশ্ব পানি দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য, যা বিশ্বব্যাপী মিঠাপানির সম্পদ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে হিমবাহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সরাসরি হিমবাহের সঙ্গে যুক্ত না হলেও হিমবাহ গলনের প্রভাব বাংলাদেশ গভীরভাবে অনুভব করছে, বিশেষত হিমালয় থেকে উৎসারিত নদীগুলোর মাধ্যমে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ গলনের গতি দ্রুততর হচ্ছে এবং হিমালয়ের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির জটিল ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
হিমালয়ের হিমবাহ থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীগুলো বাংলাদেশের কৃষি, জীবনযাত্রা এবং নৌপরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ দ্রুত গলতে শুরু করেছে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে হিমালয়ের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ভয়াবহ ও বহুমুখী পানি ব্যবস্থাপনা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। হিমবাহ গলার কারণে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে। এতে বন্যা, নদীভাঙন এবং সম্মিলিত নদী ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি হারিয়ে যাচ্ছে এবং আগামী দিনে এই প্রবণতা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ফলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৪০ শতাংশ উর্বর ভূমি হারিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার হার বেড়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠাপানির প্রাপ্যতার জন্য বড় হুমকি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাতজন বাংলাদেশির একজন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা অনুপ্রবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। এতে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এর ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব আরও বেড়ে যাবে, যা নিরাপদ পানির চাহিদা এবং পানির উৎসগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ভূগর্ভস্থ পানিতে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার লবণের উপস্থিতি রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাদুপানির প্রবাহ ৪০ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে নেমে আসবে। গবেষণায় আরও প্রকাশ পায়, ইন্দো-গাঙ্গেয় অববাহিকা লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা পানির স্তরের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় তুলনায় আরও বিপজ্জনক। গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা সমমূল্যের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এসব তথ্য বাংলাদেশের স্বাদুপানির প্রাপ্যতায় ভয়াবহ পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে হিমবাহ গলনের প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং যা দেশের পানি-জ্বালানি সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অন্যতম। এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো, পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকারের বাজেটের একটি বড় অংশ পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও বন্যা প্রতিরোধে ব্যয় করা হচ্ছে, যেখানে উন্নয়ন অংশীদারদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় ওয়াটারএইড বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন প্রভাব মোকাবিলায় স্থিতিশীল এবং টেকসই নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যাভ্যাস (ওয়াশ) কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ওয়াটারএইড ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করছে, অন্যত্র ও বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়নযোগ্য টেকসই দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে এবং অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করছে।
এ ছাড়াও জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করে জলবায়ুসহিষ্ণু ওয়াশ কার্যক্রম প্রাসঙ্গিক জাতীয় নীতিমালায় সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া ওয়াটারএইড জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু সম্পর্কিত সুশাসন এবং জাতীয় অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল এবং পরিবেশভিত্তিক রূপান্তরমূলক অভিযোজন কার্যক্রমের অধিকতর চর্চার ওপর জোর দিচ্ছে, যা দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু অভিযোজন নীতি– জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২২ এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর আওতায় সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে।
বর্তমানে ওয়াটারএইড পানির ভৌগোলিক/হাইড্রোজিওলজিক্যাল সম্ভাব্যতা মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মনোযোগ দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট সমাধান চিহ্নিত করে এই মূল্যায়নের ফলাফল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ও জাতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে শেয়ার করা হচ্ছে, যাতে জাতীয় ডেটাবেজ সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু এখনও বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি পদ্ধতি, কৌশল ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি ‘ওয়াটার অ্যাটলাস’ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে পানিসম্পদের প্রাপ্যতা, বিতরণ, গুণমান ও ব্যবহার সংক্রান্ত বিশদ তথ্য, মানচিত্র, বিশ্লেষণ সংরক্ষিত থাকবে। পাশাপাশি পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা আঙ্গিক এখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি পানির ব্যবহারের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বিভিন্ন জটিল সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে। নীতিনির্ধারকরা এই অ্যাটলাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিযোজনমূলক কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, সম্পদের সঠিক বরাদ্দ এবং জনগণকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নজরদারি ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।
ওয়াটারএইড এই উদ্যোগে সহায়ক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, প্রযুক্তিগত সংস্থা এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় একটি ওয়াটার অ্যাটলাস প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
এটা স্পষ্ট– ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের কাছে ওয়াটার অ্যাটলাস একটি অপরিহার্য উপকরণ হয়ে উঠবে।
ইয়াসিন আরাফাত, মো.
hasinjahan@wateraid.org
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প র প যত র জন য হ মব হ র ওপর উপক ল জলব য ট কসই সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি