‘হিমবাহ সংরক্ষণ’– বিশ্ব পানি দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য, যা বিশ্বব্যাপী মিঠাপানির সম্পদ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে হিমবাহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সরাসরি হিমবাহের সঙ্গে যুক্ত না হলেও হিমবাহ গলনের প্রভাব বাংলাদেশ গভীরভাবে অনুভব করছে, বিশেষত হিমালয় থেকে উৎসারিত নদীগুলোর মাধ্যমে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ গলনের গতি দ্রুততর হচ্ছে এবং হিমালয়ের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির জটিল ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

হিমালয়ের হিমবাহ থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীগুলো বাংলাদেশের কৃষি, জীবনযাত্রা এবং নৌপরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ দ্রুত গলতে শুরু করেছে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে হিমালয়ের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ভয়াবহ ও বহুমুখী পানি ব্যবস্থাপনা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। হিমবাহ গলার কারণে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে। এতে বন্যা, নদীভাঙন এবং সম্মিলিত নদী ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি হারিয়ে যাচ্ছে এবং আগামী দিনে এই প্রবণতা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ফলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৪০ শতাংশ উর্বর ভূমি হারিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার হার বেড়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠাপানির প্রাপ্যতার জন্য বড় হুমকি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাতজন বাংলাদেশির একজন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা অনুপ্রবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। এতে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এর ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব আরও বেড়ে যাবে, যা নিরাপদ পানির চাহিদা এবং পানির উৎসগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ভূগর্ভস্থ পানিতে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার লবণের উপস্থিতি রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাদুপানির প্রবাহ ৪০ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে নেমে আসবে। গবেষণায় আরও প্রকাশ পায়, ইন্দো-গাঙ্গেয় অববাহিকা লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা পানির স্তরের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় তুলনায় আরও বিপজ্জনক। গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা সমমূল্যের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এসব তথ্য বাংলাদেশের স্বাদুপানির প্রাপ্যতায় ভয়াবহ পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে হিমবাহ গলনের প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং যা দেশের পানি-জ্বালানি সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অন্যতম। এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো, পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকারের বাজেটের একটি বড় অংশ পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও বন্যা প্রতিরোধে ব্যয় করা হচ্ছে, যেখানে উন্নয়ন অংশীদারদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় ওয়াটারএইড বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন প্রভাব মোকাবিলায় স্থিতিশীল এবং টেকসই নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যাভ্যাস (ওয়াশ) কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ওয়াটারএইড ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করছে, অন্যত্র ও বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়নযোগ্য টেকসই দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে এবং অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করছে।

এ ছাড়াও জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করে জলবায়ুসহিষ্ণু ওয়াশ কার্যক্রম প্রাসঙ্গিক জাতীয় নীতিমালায় সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া ওয়াটারএইড জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু সম্পর্কিত সুশাসন এবং জাতীয় অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল এবং পরিবেশভিত্তিক রূপান্তরমূলক অভিযোজন কার্যক্রমের অধিকতর চর্চার ওপর জোর দিচ্ছে, যা দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু অভিযোজন নীতি– জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২২ এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর আওতায় সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে।
বর্তমানে ওয়াটারএইড পানির ভৌগোলিক/হাইড্রোজিওলজিক্যাল সম্ভাব্যতা মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মনোযোগ দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট সমাধান চিহ্নিত করে এই মূল্যায়নের ফলাফল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ও জাতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে শেয়ার করা হচ্ছে, যাতে জাতীয় ডেটাবেজ সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু এখনও বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি পদ্ধতি, কৌশল ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি ‘ওয়াটার অ্যাটলাস’ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে পানিসম্পদের প্রাপ্যতা, বিতরণ, গুণমান ও ব্যবহার সংক্রান্ত বিশদ তথ্য, মানচিত্র, বিশ্লেষণ সংরক্ষিত থাকবে। পাশাপাশি পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা আঙ্গিক এখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি পানির ব্যবহারের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বিভিন্ন জটিল সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে। নীতিনির্ধারকরা এই অ্যাটলাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিযোজনমূলক কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, সম্পদের সঠিক বরাদ্দ এবং জনগণকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নজরদারি ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।
ওয়াটারএইড এই উদ্যোগে সহায়ক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, প্রযুক্তিগত সংস্থা এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় একটি ওয়াটার অ্যাটলাস প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। 

এটা স্পষ্ট– ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের কাছে ওয়াটার অ্যাটলাস একটি অপরিহার্য উপকরণ হয়ে উঠবে।

ইয়াসিন আরাফাত, মো.

তাহমিদুল ইসলাম ও হাসিন জাহান: লেখকবৃন্দ ওয়াটারইএড বাংলাদেশে কর্মরত
hasinjahan@wateraid.org

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র প র প যত র জন য হ মব হ র ওপর উপক ল জলব য ট কসই সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ