বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক স্থগিত করেছেন দেশটির একটি ফেডারেল আদালত। গতকাল বুধবার নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক আদালত এক আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানান। আদেশে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে নিজের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছেন ট্রাম্প।

আদালতের এ রায় ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে এবং আদালতের কর্তৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।

যে দুটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গতকাল ওই আদেশ দিয়েছেন, তার একটি করেছে লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার নামের একটি আইনি সংস্থা। ট্রাম্পের শুল্কের নিশানা হওয়া দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি করে, এমন পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তারা মামলাটি করেছে। অপর মামলা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি অঙ্গরাজ্যের পক্ষ থেকে।

দুটি মামলার একটি করেছে লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার নামের একটি আইনি সংস্থা। ট্রাম্পের শুল্কের নিশানা হওয়া দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি করে, এমন পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তারা মামলাটি করেছে। অপর মামলাটি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি অঙ্গরাজ্যের পক্ষ থেকে।

আদালতের তিনজন বিচারকের একটি প্যানেল আদেশে বলেছেন, কংগ্রেসকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। দেশের অর্থনীতির সুরক্ষার জন্য প্রেসিডেন্টের জরুরি ক্ষমতার বলে তা বাতিল করা যায় না।

বিচারক প্যানেল আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট শুল্ককে চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কতটা বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন বা তা কতটা কার্যকর হবে, এ বিষয়ে আদালত কোনো মন্তব্য করছে না। (ক্ষমতার) এ ধরনের ব্যবহার অননুমোদিত। এর কারণ তা অযৌক্তিক বা অকার্যকর বলে নয়, বরং এটি ফেডারেল আইন অনুমোদন দেয় না।’

ম্যানহাটানভিত্তিক ওই আদালত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক আইনসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে। এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সার্কিট আপিল আদালতে (ওয়াশিংটন ডিসি) আপিল করা যেতে পারে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়।

আরও পড়ুনইইউ পণ্যে শুল্ক আরোপ স্থগিত করলেন ট্রাম্প২৬ মে ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছ থেকে বিদেশি পণ্যে শুল্ক আদায়কে ট্রাম্প তাঁর চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নীতি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যপ্রবাহকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে এবং আর্থিক বাজারগুলো অস্থির করে তুলেছে।

পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা, উৎপাদন, কর্মী ব্যবস্থাপনা ও পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় থাকা ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই ট্রাম্পের হঠাৎ শুল্ক আরোপ ও আচমকা নীতিগত পরিবর্তনে সংকটে পড়েছে।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা, যা মার্কিন জনগোষ্ঠীর ভীষণ ক্ষতি করেছে, আমাদের শ্রমিকদের পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষাশিল্পের ভীত দুর্বল করে দিয়েছে, যা আদালত অস্বীকার করেননি।কুশ দেশাই, হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কুশ দেশাই এ বিষয়ে গতকাল বুধবার বলেছেন, ‘অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা, যা মার্কিন জনগোষ্ঠীর ভীষণ ক্ষতি করেছে, আমাদের শ্রমিকদের পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভীত দুর্বল করে দিয়েছে, যা আদালত অস্বীকার করেননি।’

জাতীয় জরুরি অবস্থা মোকাবিলার সঠিক উপায় নির্ধারণ করা অনির্বাচিত বিচারকদের কাজ নয় বলেও বিবৃতিতে মন্তব্য করেন হোয়াইট হাউসের ওই কর্মকর্তা।

এর আগে হোয়াইট হাউসের আরেক কর্মকর্তা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম শীর্ষ উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, বিচারব্যবস্থার অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাণিজ্যযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মানুষেরা২৭ মে ২০২৫

যদি বাণিজ্য আদালতের এ রায় বহাল থাকে, ট্রাম্পের বাণিজ্যকৌশলে তা বড় ধরনের ধাক্কা দেবে। ট্রাম্প উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছ থেকে ছাড় আদায় করতে চাইছেন। সেই সঙ্গে উৎপাদন খাতের চাকরি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা এবং ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যঘাটতি কমানো তাঁর উদ্দেশ্য। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এগুলো তার অন্যতম।

ম্যানহাটানভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক ফেডারেল আদালত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক আইনসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে। এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সার্কিট আপিল আদালতে (ওয়াশিংটন ডিসি) আপিল করা যেতে পারে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়।

গত ২ এপ্রিল বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। এর বাইরে বাণিজ্যঘাটতিকে কারণ দেখিয়ে অনেক দেশের ওপর মাত্রাতিরিক্ত হারে শুল্ক আরোপ করেন তিনি। এর জেরে বিশ্ববাজারে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।

আরও পড়ুনট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আয় কতটা বাড়ল৩০ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প আম দ র আমদ ন ব যবস ক ষমত র একট র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় বিএনপিসহ ১০ নিবন্ধিত দল

বিএনপিসহ ১০টি নিবন্ধিত দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। নির্বাচনের দিনক্ষণ স্পষ্ট করতে রোডম্যাপ চায় নিবন্ধিত চারটি দল। ছয়টি নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দল সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এবং চব্বিশের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ১৮টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল দ্রুত নির্বাচন চায়। বাকি ১১ নিবন্ধিত দলের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। 

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ছিল ৫৫টি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ পাঁচটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। নিবন্ধন স্থগিত আছে আওয়ামী লীগের। ১২ দলীয় জোটসহ বিএনপির মিত্র আরও কয়েকটি অনিবন্ধিত দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তবে এসব দলের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলো।

সংস্কার এবং নির্বাচনের পৃথক রোডম্যাপ দাবি করা জামায়াত বলছে, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলে নির্বাচন হোক। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি বিচার-সংস্কার-নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইছে। সংস্কার এবং বিচার দৃশ্যমান হওয়ার শর্তে গণপরিষদ নির্বাচন চায় দলটি। 

জাপান সফরে থাকা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার নিক্কেই ফোরামের বক্তৃতায় বলেন, একটি মাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। তিনি আবারও বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আগামী বছরের জুনের পর এক দিনও থাকবে না এই সরকার। 

তাঁর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, এক দল নয়; সবাই নির্বাচন চায়। শুধু একজন ব্যক্তি নির্বাচন চান না। তিনি হলেন অধ্যাপক ইউনূস। 
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয় একাধিক উপদেষ্টার কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে; এক দিনও দেরি হবে না। এ নিশ্চয়তার পরও শুধু বিএনপিই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে। তারা সংস্কারের কথা বলে না। শুধু নির্বাচন চায়। অথচ সরকারের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন নয়। সংস্কার এবং বিচারও। এই উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার না করে একটি দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চান না তারা। সব দলই নির্বাচনের আগে সংস্কারের কথা বলছে। শুধু বিএনপি নির্বাচন নিয়ে পড়ে আছে।  

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় যারা
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এতদিন নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে এসেছে বিএনপি। গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তৃতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ করে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান নেতারা। এ ব্যাপারে আশ্বাস না পেয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানান তারা। গত বুধবার ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। 
গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনায় রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ চড়ে। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পদত্যাগের নাটক করা হচ্ছে। 

২৪ এবং ২৫ মে ২২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব বৈঠকের পরও সরকার, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ দলগুলো যে যার আগের অবস্থানে রয়েছে। সরকারের উপদেষ্টাদের ভাষ্য, প্রশাসন কুক্ষিগত হয়ে গেছে। সরকার কাজ করতে পারছে না। 
আগে সরকারকে চাপে রাখলেও রোডম্যাপ নিয়ে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে না দেওয়ায় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। 

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। 
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সমকালকে বলেছেন, সরকার আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এনসিপিঘনিষ্ঠ কিছু উপদেষ্টার মধ্যে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে। দেশকে অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে তপশিল ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।

বাম এবং অন্যরাও নির্বাচন চায়
বাম গণতান্ত্রিক জোট ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে কয়েক দফা কর্মসূচি পালন করেছে। এই জোটে রয়েছে ছয়টি বামপন্থি দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সমকালকে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করছে। সিপিবি, বাম জোটসহ ৫০টিরও বেশি দল এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। বর্তমান সংকট সমাধানে আর বিলম্ব না করে এ বছরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক। 
বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, ভালো নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার দরকার, এ জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। নির্বাচন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হতে পারে। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান যথাযথভাবে ব্যক্ত হয়নি। বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সম্ভব স্বল্পতম সময়ে নির্বাচন চায়। 
এলডিপি ও গণফোরাম গতকাল শুক্রবার দেওয়া বিবৃতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোট গতকাল নির্বাচনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে। এ জোটে নিবন্ধিত দল নেই। অনিবন্ধিত ১১ দলের সমমনা জাতীয়তাবাদী জোটও এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চায়।
এ ছাড়া বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলও (পিডিপি) নির্বাচন চায়।

সুষ্ঠু নির্বাচনে জোর জামায়াতের
বিএনপির সাবেক মিত্র জামায়াত সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে জোর দিচ্ছে। গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান জানিয়েছিলেন, আগামী বছরের রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। কিংবা রোজার পর এপ্রিলেও ভোট হতে পারে। এর চেয়ে বেশি দেরি হলে প্রাকৃতিক কারণে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। 
তবে জামায়াত আমির স্পষ্ট করেন, অর্থবহ নির্বাচনের জন্য অর্থবহ সংস্কার হতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর গত শনিবার রাত ১১টা থেকে দেড় ঘণ্টা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতের আমির। সঙ্গে ছিলেন নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। 

রাজনৈতিক সূত্রগুলোর খবর, সরকার এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে জামায়াত। দলটির নেতাদের ভাষ্য, ৫ আগস্টের পর পুলিশ এবং প্রশাসনে আওয়ামী লীগপন্থি কর্মকর্তাদের বদলে সর্বত্র বিএনপিপন্থিরা এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মনে করে জামায়াত। সরকারেরও একই মনোভাব। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে এসেছে।

আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে না থাকায় বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা জামায়াত নেতাদের সন্দেহ– বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোট করতে পারবে কিনা! এনসিপির মতো এ দলটিও মনে করছে, বিএনপির প্রতি পক্ষপাত রয়েছে কমিশনের।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করে ডা. তাহের সমকালকে বলেছেন, উত্তেজনা প্রশমন করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কথা হয়েছে। জামায়াত কবে নাগাদ নির্বাচন চায়– প্রশ্নে ডা. তাহের বলেছেন, যত দ্রুত নির্বাচন হয়, ততই উত্তম। নির্বাচন বিলম্বিত হওয়া কারও জন্যই ভালো নয়। সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা দরকার। এর জন্য লম্বা সময় নেওয়া উচিত হবে না।
 
এনসিপির অগ্রাধিকারে সংস্কার, বিচার
এখনও নিবন্ধন পায়নি এনসিপি। এ দলটি বারবারই বলছে, নির্বাচনের আগে সংস্কার ও জুলাই হত্যার বিচার হতে হবে। দলটি সংসদের আগে স্থানীয় সরকার এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরও আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়। গঠনের পর প্রায় তিন মাস ঢাকায় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও গত মঙ্গলবার থেকে তারা তৃণমূলে যেতে শুরু করেছে। নিবন্ধনের শর্ত পূরণে ২১ জেলায় কমিটি গঠন এবং কার্যালয় স্থাপনের কাজ করছে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতিরই অংশ। এনসিপি নির্বাচনের বিরোধী নয়। এনসিপি নির্বাচন-বিচার-সংস্কারের সমন্বিত রোডম্যাপ চায়।
এনসিপি নেতারা সমকালকে বলেন, সাংবিধানিক সংস্কারে জোর দিচ্ছেন তারা, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সরকার আওয়ামী লীগের মতো কর্তৃত্ববাদী হতে না পারে। বিএনপি সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও এনসিপি সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে।

সংস্কারে জোর ইসলামী দলগুলোর  
পাঁচ নিবন্ধিত দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস এবং ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনের আগে সংস্কার চায়। এই দলগুলো নির্বাচনী ঐক্য তৈরির চেষ্টা করছে। দলগুলোর নেতারা গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে। 
এ দলগুলো আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। তারাও মৌলিক সংস্কার চায়। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সময়সীমা প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন, এতে তাদের আস্থা রয়েছে। 
নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দল খেলাফত আন্দোলন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নেতৃত্ব বদলের মাধ্যমে এ দলটিকেও ইসলামী দলগুলোর ঐক্যে টানার প্রক্রিয়া চলছে। 

নির্বাচনের স্পষ্ট সময় চায় চার দল
বিএনপির মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের তিন নিবন্ধিত দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি,  নাগরিক ঐক্য এবং গণসংহতি আন্দোলন নির্বাচনের স্পষ্ট দিনক্ষণ বা রোডম্যাপ চায়। একই রকম বক্তব্য এবি পার্টির। এই দলগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিরোধী নয়। আবার ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন হলেও আপত্তি নেই। জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন সমকালকে বলেন, তারা দ্রুত নির্বাচন চান। তবে তিনি সময়সীমা বেঁধে দেননি। গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সমকালকে বলেছেন, তারা সুর্নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চান। 

আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠরা চাপে, জাপা ছাড়া অন্যরা চুপ
শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করা দলগুলো ৫ আগস্টের পর রাজনীতি থেকে অনেকটা ছিটকে গেছে। গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে অংশ নিয়ে, তিনবার প্রধান বিরোধী দল হয়ে স্বৈরাচারের দোসর তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি (জাপা) ছাড়া অন্যরা নীরব রয়েছে। সরকারের কড়া সমালোচকে পরিণত হওয়া জাপা দ্রুত নির্বাচন চায়। 
মামলা এবং ধরপাকড়ে পড়া অন্য দলগুলো নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে না। একটি দলের নেতা সমকালকে বলেন, ‘আমাদের কি কেউ জিজ্ঞেস করে নির্বাচনের কথা? তাহলে মতামত দেব কেন? নিজের মতো করে টিকে আছি। ভোট নিয়ে কথা বলতে চাই না।’ 

নীরব থাকা নিবন্ধিত দলগুলো হলো– জাতীয় পার্টি-জেপি, সাম্যবাদী দল (এমএল), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাকের পার্টি, তরীকত ফেডারেশন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), ইসলামিক ফ্রন্ট ও ইসলামী ফ্রন্ট। 

চুপচাপ রয়েছে– বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), বাংলাদেশ ন্যাপ,  বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি,  বিএমএল,  মুসলিম লীগ,  এনপিপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব, বাংলাদেশ কংগ্রেস, সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট ও গণফ্রন্ট।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ