প্রভাবশালীদের কবজায় অস্থায়ী পশুর হাট
Published: 4th, June 2025 GMT
ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই গড়ে উঠেছে অস্থায়ী পশুর হাট। প্রশাসনিক স্থবিরতা, রাজনৈতিক দখল, ইজারা প্রক্রিয়ায় অনিয়মের কারণে বসেছে এসব হাট। এতে বাড়ছে জনদুর্ভোগ, তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা সংকট।
জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ১৯টি অস্থায়ী হাটের অধিকাংশই এবার ইজারা পেয়েছেন বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠনের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা উত্তরের ৯টির মধ্যে ৮টি কোরবানির হাট বিএনপির হাতে: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ১২টি কোরবানির হাটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯টির ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। স্থায়ী গাবতলী হাটও ঈদসহ এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।
খিলক্ষেতের মস্তুল চেকপোস্ট সংলগ্ন হাটটি পেয়েছে 'সুরমি ইন্টারপ্রাইজ' নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার পেছনের হাল ধরেছেন মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতার হোসাইন।
তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন হাট পরিচালনা করছেন ‘জায়ান এন্টারপ্রাইজ’ এর মনিরুজ্জামান, যিনি যুবদলের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা ইউনিটের সদস্যসচিব।
মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং হাট পেয়েছেন রতন মিয়া। তিনি বলেন, “বিএনপির কিছু সিনিয়র ভাইয়ের সহায়তা পেয়েছি, তবে নিয়ম মেনেই ইজারা নিয়েছি।”
তবে নিয়ম মানা হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠছে দিয়াবাড়ি হাটকে ঘিরে। অভিযোগ উঠেছে, সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েও একজন দরপত্রদাতা কার্যাদেশ পাননি শুধু মূল পে-অর্ডার দাখিল না করায়। দ্বিতীয় দরদাতা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক চাপের কারণেই তাকেও কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি।
দক্ষিণেও দৃশ্যপট এক: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯টি হাটের মধ্যে আটটিই এবার গেছে বিএনপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের হাতে। যেখানে গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন, এবার সেই নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বদলে গেছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, শাহজাহানপুরের মৈত্রী সংঘ মাঠ, আমুলিয়া, পোস্তগোলা, দনিয়া ক্লাব, রহমতগঞ্জ মাঠসহ অন্তত ছয়টি হাটের ইজারাদাররা বিএনপির সাবেক নেতা বা তাদের ঘনিষ্ঠ।
সবচেয়ে আলোচিত নারিন্দার ‘সাদেক হোসেন খোকা মাঠ’ ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালের যৌথ হাট। সরকারি দর ছিল ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, কিন্তু এটি মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ টাকায় পেয়েছেন সৈয়দ মাসুদ রেজা, যিনি সাবেক মেয়র খোকার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবসংলগ্ন হাটটি ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূল্যের হলেও তা মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ইসমাইল হোসেন।
প্রশাসনিক অচলাবস্থা: ডিএসসিসির নগর ভবনে ইজারা ও অর্থ বিভাগ কার্যত অচল। অনেক বিভাগে তালা ঝুলছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাজির হচ্ছেন না।
ডিএসসিসির প্রশাসক মো.
এই বিলম্বের সুযোগেই গড়ে উঠছে বেআইনি হাট। কলাবাগান, কামরাঙ্গীরচর, বনশ্রী, শ্যামপুর, বাংলামোটর, মেরাদিয়া—নগরজুড়ে বিভিন্ন স্থানে অনুমোদনহীন হাট বসেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “অবৈধ হাট চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তালিকা না থাকায় উচ্ছেদে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশন তালিকা দিলে পুলিশ অভিযান চালাবে।”
জনদুর্ভোগ ও নিরাপত্তাহীনতা: নগরবিদরা বলছেন, হাট ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে নগরবাসীকে ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, “এসব হাটে রাজনৈতিক দখলের কারণে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পশু চুরি ও যানজট বেড়ে যায়। এতে নগরবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। উত্তরণের একমাত্র পথ হলো স্বচ্ছ ইজারা প্রক্রিয়া ও কার্যকর সমন্বয়।”
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, “আগে আওয়ামী লীগের লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করত, এখন বিএনপিরা করছে। কিন্তু দুর্ভোগ তো আমাদেরই পোহাতে হয়। রাস্তাঘাট বন্ধ, মলমূত্রে দুর্গন্ধ, চাঁদাবাজি—এসব আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।”
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন ত ক ব এনপ র ঘন ষ ঠ
এছাড়াও পড়ুন:
মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে
চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছেন নগরবাসী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এ রোগের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রামে এভাবে জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য এখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। এই দুই জরিপের তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে—এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, যা এবার আইইডিসিআরের গবেষণায় পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান যেখানে ২০ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রামের এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। বাসাবাড়িতেও লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে। গত বছর ৩৭ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলেও এবার তা প্রায় ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবার ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছরেই ৭৬৪ জনের চিকুনগুনিয়া ও ৭৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন এই জুলাই মাসে।
সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম দাবি করছেন যে মশকনিধনে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো এ উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? লার্ভার ঘনত্ব যেখানে তিন-চার গুণ বেশি, সেখানে গতানুগতিক কর্মসূচির ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে সিটি করপোরেশনকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে নানা জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিও এডিস মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। ফলে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শহরকে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, নগর কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; নগরবাসীকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।