বাদ পড়ল সঞ্চয়পত্রের সুদ, কমল কর্মসূচির সংখ্যাও
Published: 11th, June 2025 GMT
সংস্কারের অংশ হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এক ধাক্কায় কর্মসূচির সংখ্যা ৪৫ কমিয়ে ফেলেছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা ১৪০ থেকে কমিয়ে ৯৫–তে নামিয়ে আনা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদেরা অভিযোগ করে আসছিলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছিল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে শুরু করে পেনশন বাবদ বরাদ্দকেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হতো। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদকে এ খাত থেকে বাদ দিয়েছে। পেনশন বাবদ বরাদ্দের কথাও বাজেট বক্তব্যে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। পেনশন ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।’ পেনশন বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ খাতে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মান অনুযায়ী, একটা দেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৫ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ কমিয়ে ১ লাখ ২ হাজার ১২৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারাও এত দিন ব্যাখ্যা দিয়ে আসছিলেন যে মানুষ ব্যাংকে আমানত হিসেবে অর্থ না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনলে যে বেশি সুদ পায়, তা বহন করতে হয় সরকারকে। ফলে এটাও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ।
উপকারভোগী নির্বাচনে ডিএসআর
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সঠিক ব্যক্তি যাতে উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন, সে জন্য ‘ডায়নামিক সোশ্যাল রেজিস্ট্রি (ডিএসআর)’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএসআরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাতা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি নির্ধারিত হবে বলে জানা গেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত ৩ ফেব্রুয়ারি সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সুবিধাভোগী নির্বাচন, ডেটা সংরক্ষণ এবং বিতরণের ব্যবস্থা অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রযুক্তিনির্ভর ডিএসআর স্থাপনের ব্যাপারে পরিপত্র জারি করেছে।
ডিএসআর এমন একটি তথ্যভান্ডার, যার মাধ্যমে অনলাইনে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং তাঁদের উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহায়তায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তিনটি এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি কর্মসূচিতে ইতিমধ্যে ডিএসআর চালুর কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে আটটি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচিটি হচ্ছে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি।
ভাতা ও উপকারভোগী বাড়ছে
সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দরিদ্র, প্রান্তিক ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাস, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবারের বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং মাথাপিছু বরাদ্দ উভয়ই বৃদ্ধি করার দিকে নজর দিয়েছি।’
সেই অনুযায়ী, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর চলমান বিভিন্ন কর্মসূচির সুবিধাভোগী ও ভাতার পরিমাণ ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগী ৬০ লাখ ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬১ লাখ করা হচ্ছে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার জন বাড়িয়ে করা হচ্ছে ২৯ লাখ। একইভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা বৃত্তির সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী খাতে সুবিধাভোগী ৯৪ হাজার, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সুবিধাভোগী ২ লাখ এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী ১ লাখ ১৬ হাজার বাড়ানো হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সুবিধাভোগীর সংখ্যা দুই লাখ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের উপবৃত্তির সুবিধাভোগী ৯ লাখ ৯০ হাজার, ওএমএস সুবিধাভোগী ১১ লাখ ৪৭ হাজার, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগী ৩ লাখ ৩৭ হাজার বাড়ানো হচ্ছে।
বয়স্ক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে ৬০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকায়, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের ভাতা ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কিছু সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে সরকার। এটা প্রশংসনীয়। যেসব কর্মসূচির মাধ্যমে এত বছর গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছিল, সেগুলোর কিছু এবার বাদ পড়েছে। আবার কিছু কর্মসূচি রয়েও গেছে। যেমন পেনশন কোনোভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে (এনএসএসএস) উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, দ্বৈততা দূর, অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের সুপারিশ ওঠে এসেছিল। এগুলো বাস্তবায়ন করলেও এ খাতের সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর দ দ র র বর দ দ ড এসআর মন ত র প নশন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘১০০ টাকার’ বাজেটের নতুনত্ব কোথায়
ছোটবেলায় নালিতাবাড়ীতে শীতের রাতে যাত্রাগান বা পালাগান শুনতে বসতাম খড়ের ওপর। অপেক্ষা করতাম কখন শুরু হবে আসল কাহিনি। তখন বেরসিক বিবেক আধা ঘণ্টার বন্দনা গাইত, যা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়। একই রকম বিরক্তি অনুভব করেছি, যখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীরা বাজেট বক্তৃতা দিতেন, যেখানে একটি বড় অংশজুড়ে ছিল শুধুই সরকারের বন্দনা। যাত্রাগানে বন্দনা শুধু শুরুতে থাকে।
বাজেটে বন্দনা শুরু, শেষ ও মাঝেমধ্যেই আবির্ভূত হয়, যা শ্রোতাদের জন্য একধরনের অত্যাচার। সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের জন্য ওই দিন বড়ই মায়া হয়—কতবার যে টেবিল চাপড়াতে হয়, তার হিসাব থাকে না। বাজেট অর্থনীতির কল্যাণ বয়ে আনলেও এর আয়তন বাঙালির অতিবাচালতা বিশ্বসভায় তুলে ধরে জাতীয় চরিত্রের ক্ষতি করেছে।
এক–এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র ৫২ পৃষ্ঠায় ২০০৮–২০০৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা শেষ করেছিল, যা ছিল এক চমৎকার দৃষ্টান্ত। আওয়ামী লীগের ২০০৯–২০১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা একলাফে ১১৪ পৃষ্ঠায় উঠে গেল। তার পর থেকে এই বক্তৃতার আয়তন বাড়তে বাড়তে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের ভাষণ সর্বোচ্চ ২০২ পৃষ্ঠায় উঠে গেল, সেই হিসাববিদ অর্থমন্ত্রীর বেহিসাবি আমলে, যিনি পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাত খতম করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই বাচালতা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। অর্থনীতি বড় হলেই বক্তৃতা ক্রমান্বয়ে বড় হবে—এমন কথা নেই। ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে কমপক্ষে আট গুণ বড়। অথচ অর্থনীতিবিদ নির্মলা সীতারমণ মাত্র ২৮ পৃষ্ঠায় বাজেট ভাষণ শেষ করেছেন। পাকিস্তানের শেষ বাজেট ভাষণ ছিল মাত্র ৩৮ পৃষ্ঠার।
বাংলাদেশের এবারের বাজেটের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এর বাচনিক পরিমিতিবোধ। মাত্র ৫৬ পৃষ্ঠায় যে বাংলাদেশের বাজেট শেষ করা যায়, তা দেখিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি আরও ছোট করা যেত, যদি উপদেষ্টা সেখান থেকে বাদ দিতে পারতেন সংস্কারের প্যাচাল, যা ১০ মাস পর অনেকটা রূপকথার কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। বাজেট অর্থনীতির দলিল। এখানে বারো জাতের কথা না আনাই ভালো। অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০০৫-০৯ কালপর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন।
২০০৯ সাল থেকে শাসনামল শুরু করে আওয়ামী লীগ কোনো অর্থনীতিবিদকে কখনো অর্থমন্ত্রী বানায়নি। পেশাদার লোককে ওই জায়গায় বসাতে লীগ সরকার সম্ভবত ভয় পেত—পাছে ধনিক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিটি যদি বেঁকে বসেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এক চাঁদের হাট বসেছে। গভর্নর, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা—সবাই পেশাদার অর্থজ্ঞানী। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা তো ক্ষুদ্রঋণের বিশ্বখ্যাত নাম। সব মিলিয়ে তাই বাজেট নিয়ে মানুষের প্রত্যাশাও ছিল বেশ উঁচুতে। সে তুলনায় অর্থ উপদেষ্টা খুব একটা ভালো ‘হোমওয়ার্ক’ করেছেন বা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের মোট বাজেট তথা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটকে যদি ১০০ টাকা ধরি, তাহলে এর মধ্যে ৭১ টাকা হচ্ছে রাজস্ব আয় এবং বাকি ২৯ টাকা ঘাটতি ব্যয়। এই ঘাটতি মেটাতে ১৩ টাকার বিদেশি ঋণ ও অনুদান এবং ১৬ টাকার দেশি ঋণ ব্যবহার করা হবে। এই কাঠামোয় কোনো চমক বা নতুনত্ব নেই। আওয়ামী সরকার ২০২৪ সালে যে বাজেট বানিয়েছিল, তার পূর্ণ বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছে চলমান সরকার। ২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আয়তন ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। একে ১০০ টাকা ধরলে এখানে রাজস্ব আয় ৭০ টাকা। বাকি ঘাটতির ৩০ টাকা মেটানো হবে ১৪ টাকার বিদেশি ঋণ আর ১৬ টাকার দেশি ঋণের সমন্বয়ে।
শেয়ারবাজার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যে বেহাল চলছে, তাতে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হওয়া যায় না। শেষতক ২০২৫–২৬ সালের সংশোধিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে। অর্থাৎ কাঠামোগতভাবে এটি আওয়ামী লীগের শেষ বাজেটের ধরন থেকে আলাদা নয়। তবে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের কাঠামো থেকে বর্তমান বাজেটের কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে। সেখানে ১০০ টাকার বাজেটে ৬৭ টাকা ছিল রাজস্ব আয়। বাকি ৩৩ টাকার ঘাটতি মেটাতে আওয়ামী সরকার ১৩ টাকার বিদেশি ঋণ ও অনুদান এবং ২০ টাকার দেশি ঋণ নিয়েছিল। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ঋণনির্ভর উন্নয়ন মডেল থেকে সরে আসার চেষ্টা রয়েছে এই বাজেটে।
অর্থ উপদেষ্টা একপর্যায়ে বলেন যে তাঁর বাজেট অতীতের ‘প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিকতা’ থেকে মুক্ত হয়ে ‘সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন’ বা ‘হোলস্টিক ডেভেলপমেন্ট’-এর পথে ধাবিত হয়েছে। অতীতের বাজেটগুলোর একটি বর্ধমান দিক ছিল সামাজিক সুরক্ষা, যা নিছক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিকতা প্রমাণ করে না। উপরন্তু বাজেট প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক হলে দোষটা কিসের?আওয়ামী আমলের শেষ বাজেটের ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমানো হলেও এর সিংহভাগ, অর্থাৎ ৫০ হাজার কোটি টাকাই কমানো হয়েছে উন্নয়ন বাজেট থেকে। এতে দোষের কিছু নেই। বড় বড় উন্নয়নকাজ নতুন নির্বাচিত সরকার গ্রহণ করবে, এটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রত্যাশিত নয় এই সরকারের বিশাল পরিচালন ব্যয়, যা আওয়ামী বাজেটের অঙ্ক অক্ষুণ্ন রেখে অদক্ষতা প্রমাণ করেছে। বাহ্যত, সরকার মন্ত্রিসভা ছোট রেখে কৃচ্ছ্রসাধন করছে এবং বক্তৃতায় সে রকম দাবি করা হচ্ছে। সমাপ্তপ্রায় অর্থবছরে ৫ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার পরিচালন ব্যয় সে দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না। কেননা, আগের অর্থবছরে এই পরিচালন ব্যয় ছিল ৪ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা কিছু পক্ষপাতদুষ্ট কথা বলেছেন বাজেটে। বাংলাদেশকে নিয়ে যত উন্নয়ন স্বপ্ন যেন সেই ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান থেকেই এসেছে—এমন ভাব রয়েছে নানা জায়গায়। উন্নয়ন মানে এক রোম শহর তিলে তিলে গড়ে ওঠার গল্প—এটি রাতারাতি তৈরি হয় না। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি প্রতি দশকেই আগের তুলনায় ১ থেকে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ করে বাড়তে থাকে। আশির দশকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশের প্রবৃদ্ধি শেষতক ২০১০-এর দশকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। এ সময়ে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শাসন করেছে, যারা প্রত্যেকেই এই কৃতিত্বের অংশীজন।
আরও পড়ুনশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ কি কম হয়ে গেল১৪ জুন ২০২৫অর্থ উপদেষ্টা একপর্যায়ে বলেন যে তাঁর বাজেট অতীতের ‘প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিকতা’ থেকে মুক্ত হয়ে ‘সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন’ বা ‘হোলস্টিক ডেভেলপমেন্ট’-এর পথে ধাবিত হয়েছে। অতীতের বাজেটগুলোর একটি বর্ধমান দিক ছিল সামাজিক সুরক্ষা, যা নিছক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিকতা প্রমাণ করে না। উপরন্তু বাজেট প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক হলে দোষটা কিসের? প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের পর্যাপ্ত শর্ত নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় শর্ত। প্রবৃদ্ধি ছাড়া উন্নয়ন করেছে—এমন দেশ ভিন্ন গ্রহেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আশির দশক থেকে প্রবৃদ্ধির এই ঊর্ধ্বধাপগুলো না থাকলে আজকের এই বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যেত না।
এই অর্জন যে সামান্য নয়, তার প্রমাণ একই সময়ে তেজস্বী দেশ পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিতে নিম্নগমন। একই কালপর্বে পাকিস্তান প্রায় সাত ভাগের প্রবৃদ্ধিকে চার ভাগে নামিয়ে ফেলেছে। এই উপমহাদেশে একমাত্র ভারতই বাংলাদেশের চেয়ে কিঞ্চিৎ উচ্চতর প্রবৃদ্ধিযাত্রা দেখাতে পেরেছে। এ জন্য অমর্ত্য সেন বলেছেন, অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকেও পেছনে ফেলেছে। এসব অর্জনের স্বপ্ন শুধু জুলাই থেকে শুরু হয়নি। কথাটি বিডা চেয়ারম্যানের পোষা বাক্যের মতো শোনাচ্ছে। তিনিও দাবি করেন, বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়ার স্বপ্নটি নাকি এই গত জুলাই থেকেই শুরু হয়েছে। এই সরকারের সব উপদেষ্টাই কি কোনো নির্দিষ্ট ‘ন্যারেটিভ’ তুলে ধরতে বাধ্য? এটিই কি ‘নতুন বন্দোবস্ত’?
অর্থনীতিবিদের কাজ নির্মোহভাবে অর্থ খাতের ইতিহাস তুলে ধরা। অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় দুর্নীতির শিকড় খুঁজতে গিয়ে মাত্র ১৫ বছর পেছনে গেলেন কেন? অবশ্যই আওয়ামী আমলের দুর্নীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত নেই। কিন্তু যত দূর মনে পড়ে, দুর্নীতিতে শিরোপা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় ‘হ্যাটট্রিক’ করেছিল ২০০৫ সালের দিকে। তখন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তাই বলে তাঁকে আমরা এককভাবে দায়ী করছি না। দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সহজ কথায় বাঙালির মজ্জাগত সমস্যা। অতি সম্প্রতিও এর সাক্ষ্য মিলছে। উপদেষ্টার উচিত ছিল এ–জাতীয় বিতর্কিত বিষয়ের আলাপ এই বাজেট বক্তৃতায় না এনে একে সম্পূর্ণ অর্থনীতির জ্ঞানভিত্তিক এক নিষ্ঠাশীল দলিলে পরিণত করা। তাহলে এটি অনেক নতুনত্ব পেত। এটিও হতে পারত একটি সংস্কার।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক
* মতামত লেখকের নিজস্ব