বিএনপির সঙ্গে সরকারের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সব দলই কিছুটা বিব্রত: জামায়াত
Published: 18th, June 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে হওয়া বৈঠককে জামায়াতে ইসলামী স্বাগত জানায়। কিন্তু পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরকারের যৌথ সংবাদ সম্মেলন ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এই ঘটনায় দেশের বাকি সব দলই কিছুটা বিব্রত। এখানেই আমাদের আপত্তি ছিল।
আজ বুধবার জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকের বিরতিতে এমন কথা বলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর অংশ না নেওয়ার কারণ হিসেবে এসব কথা বলেন।
নিরপেক্ষতা হারালে সরকার প্রধান ও ঐক্যমত্য কমিশন বেশিদূর এগুতে পারবেন না বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, গতকাল দূপুরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের আমিরের সাথে কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এরপরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী বুধবারের আলোচনায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা কখনই সরকারকে ব্যর্থ করতে চাই না। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই।
বুধবারের আলোচনা প্রসঙ্গে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী এনসিসি গঠনের পক্ষে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এনসিসির গঠন ও আওতা নিয়ে ভিন্নমতের কথা জানান তিনি।
এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে না রাখার পক্ষে মত দেয় জামায়াতে ইসলামী। সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, তিন বাহিনী প্রধানের নিয়োগও এই কমিটির আওতায় না রাখার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী। তবে বিষয়টি আরো আলোচনার দাবি রাখে।
গত শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে আগামী রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়েও আসেন অর্ন্তবর্তী সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিরা।
ওই বৈঠকের পরদিন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়; যৌথ বিবৃতি দেওয়া দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয়। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তাঁর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে যে জামায়াত থাকবে না—এ বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। কারণ হিসেবে দলটি বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে জামায়াতকে ‘ইগনোর’ করা হয়েছে বলে মনে করে দলটি।
তবে গতকাল বৈঠকের পর বিকেলে সংবাদ সম্মেলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা মনে করছি, আগামীকালের (আজ বুধবার) আলোচনায় তারা অংশ নেবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র ক রহম ন র র জন ত ক ব এনপ র ইসল ম র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের ঋণ হবে সাড়ে ২৩ লাখ কোটি টাকা
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ কোটি টাকায়। সেই হিসাবে আগামী বছর ঘোষিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচিত সরকারের কাঁধে শুরুতেই বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা চাপবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে দেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা; আর বিদেশি ঋণের স্থিতি ১০ লাখ ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত তিন বছর মেয়াদি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিবৃতিতে অর্থ বিভাগ প্রাক্কলন করেছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ লাখ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তার পরের বছর শেষে ঋণ ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
অর্থ বিভাগ যখন এই প্রাক্কলন করছে, তখন দেশের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো নয়। রাজস্ব-জিডিপির হার ৮ শতাংশের ঘরে। আবার ২০২৬ সালের শেষে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তখন বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে উচ্চ সুদে। ঋণ পরিশোধের সময়ও কমবে অর্থাৎ স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ আর পাওয়া যাবে না।
■ গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ধরা হয়েছিল ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ■ ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৯ লাখ কোটি টাকা।অর্থ বিভাগের নীতি-বিবৃতির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের জন্য ঋণে স্থিতি প্রাক্কলন করা হয় ২২ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা সংশোধন করে ২১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে।
বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে।
ঋণঝুঁকিতে বাংলাদেশনীতি-বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখন পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। এ পর্যন্ত বৈদেশিক ও সামগ্রিক ঋণ ‘নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থানে রয়েছে। তবে বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে, বহিঃশক অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া চাপের কারণে আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে।
এদিকে সদ্য প্রকাশিত সরকারের মধ্যমেয়াদি (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৬-২৭) ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পরিমাণ বেশি হওয়ায় নিম্ন থেকে প্রায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
বিদ্যমান বাস্তবতায় অর্থ বিভাগের বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি অনুপাত। অর্থ বিভাগ বলছে, এ অনুপাত এখন ১৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে মধ্য মেয়াদে ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার গত অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছিল। তবে গত আগস্টে সরকার বদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে; আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রাক্কলন করেছে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। পরের বছর মূল বাজেটে তা বেড়ে ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়। যদিও সংশোধিত বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার তা কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৪১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
নীতি-বিবৃতির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর থেকে ঋণ-জিডিপির অনুপাত একটু একটু করে বাড়বে। যেমন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সাড়ে ৩৭ শতাংশ, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩৭ দশমিক ৬৩ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ৩৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।
সুদাসল পরিশোধে বিপুল ব্যয়নীতি-বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ করা হয় ২০২ কোটি মার্কিন ডলার। গত অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৬১ কোটি ডলারে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২৯০ কোটি, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩১২ কোটি এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৩৩৪ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধে। বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল যোগ করলে এ অঙ্ক আরও বাড়বে।
সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঋণ-জিডিপির অনুপাত যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তাতে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ আছে। কয়েক বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণের বড় অঙ্কের আসল পরিশোধ করতে হবে। এখন দরকার ঋণ নেওয়ার দর-কষাকষি করার সক্ষমতা অর্জন করা। আবার কর-জিডিপির অনুপাত যে দুষ্টচক্রে আটকে গেছে, তা থেকে বের হওয়াও জরুরি।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, আইএমএফের হিসাবে ঋণ-জিডিপির অনুপাত নির্ধারিত সীমার মধ্যে আছে বাংলাদেশ—এই কথা বলে আগের সরকার বাছবিচারহীনভাবে ঋণ নিয়েছে। এ ছিল অনেকটা অন্ধকারে শিস দিয়ে নিজেকে সাহস দেওয়ার মতো। এ অবস্থার অবসান চাইলে ভবিষ্যতে সরকারকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।