কীভাবে ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের গুলি করা হয়, জিএইচএফের সাবেক নিরাপত্তাকর্মী জানালেন সে কথা
Published: 4th, July 2025 GMT
গাজায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের সাবেক এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, তিনি একাধিকবার এসব কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে দেখেছেন। ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মীরা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর মেশিনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র থেকে গুলি চালিয়েছেন।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) সাবেক এ কর্মী আরও বলেন, একবার নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের একটি দল ত্রাণকেন্দ্র থেকে সরতে দেরি করছিল দেখে এক নিরাপত্তাকর্মী একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন।
তবে জিএইচএফ দাবি করেছে, এসব অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা।
এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, তাদের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে কখনো কোনো বেসামরিক মানুষকে গুলি করা হয়নি।
জিএইচএফ গত মে মাসের শেষ দিকে গাজায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। দক্ষিণ ও মধ্য গাজার কয়েকটি কেন্দ্র থেকে সীমিত পরিমাণে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এর আগে ইসরায়েল টানা ১১ সপ্তাহ গাজা পুরোপুরি অবরোধ করে রেখেছিল। এর ফলে সেখানে কোনো খাবার ঢুকতে পারেনি।
তবে জিএইচএফের এ বিতরণব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কারণ, এ ব্যবস্থার আওতায় হাজার হাজার মানুষকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হয়। জাতিসংঘ ও স্থানীয় চিকিৎসকদের তথ্য বলছে, জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ত্রাণ নিতে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ছয় শর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল দাবি করছে, নতুন এই বিতরণব্যবস্থা চালুর ফলে গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধ হয়েছে।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের ঘটনা বর্ণনা করেন সাবেক ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ঘটনার সময় অন্য একজন নিরাপত্তাকর্মী বিতরণকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পথের পাশে উঁচু একটি জায়গা থেকে নজরদারি করছিলেন। ওই নিরাপত্তাকর্মীই ভিড় লক্ষ্য করে টানা ১৫ থেকে ২০টি গুলি চালান। এতে একজন ফিলিস্তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি নড়াচড়া করছিলেন না।
ওই সময় পাশে থাকা আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী বলে ওঠেন, ‘আরে দেখ, মনে হয় একজনকে নিশানা করে ফেলেছ।’ এরপর তাঁরা এ নিয়ে হাসাহাসি করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে আরও বলেন, ঘটনাটির কথা ব্যবস্থাপকদের জানানো হয়েছিল। তবে তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাঁরা বলছিলেন, ‘লোকটা হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়েছে বা ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে।’
তবে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়া সাবেক ওই নিরাপত্তাকর্মীকে নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে জিএইচএফ। তারা বলেছে, ওই অভিযোগকারী কর্মী খারাপ আচরণের জন্য চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।
তবে সাবেক ওই কর্মী বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বিবিসিকে বেতনের রসিদ দেখিয়েছেন। এতে দেখা যায়, চাকরি ছাড়ার পরও আরও দুই সপ্তাহ তাঁকে টাকা দেওয়া হয়েছে।
ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি জিএইচএফের চারটি ত্রাণকেন্দ্রের সব কটিতেই কাজ করেছেন। তাঁর ভাষায়, সেখানে যেন কোনো নিয়মই নেই—কে কী করছে তা দেখার কেউ নেই, ভুল করলেও কোনো শাস্তি হয় না।
ওই কর্মী আরও বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীরা কীভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মকানুন ছিল না। ত্রাণ সংস্থার এক দলনেতা কর্মীদের বলেছিলেন, ‘নিজেকে হুমকির মধ্যে মনে করলে গুলি করো—মেরে ফেলো, কথাবার্তা পরে হবে।’
ওই কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ভেতরের পরিবেশ ছিল এমন যে ‘আমরা গাজায় যাচ্ছি, সুতরাং এখানে কোনো নিয়ম নেই। যা খুশি তা–ই করো।’
উল্লিখিত কর্মী আরও বলেন, ‘যদি এমন হয় যে কোনো ফিলিস্তিনি শত্রুতাপূর্ণ কোনো আচরণ না দেখিয়েই ত্রাণকেন্দ্র থেকে চলে যাচ্ছেন এবং এর পরও যদি আমরা তাকে লক্ষ্য করে সতর্কতামূলক গুলি ছুড়ি, তাহলে আমরা ভুল করছি, এটা অপরাধ। এর দায় এড়ানো যায় না।’
ওই কর্মকর্তার তথ্য অনুসারে, এলাকার সবকিছু নজরদারির জন্য প্রতিটি ত্রাণকেন্দ্রে সিসিটিভি ছিল। তাই তিনি মনে করেন, জিএইচএফ যদি বলে কেউ আহত বা গুলিবিদ্ধ হননি, তাহলে সেটা একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যা।
গাজায় একটি ত্রাণবাহী গাড়ির সামনে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনির ভিড়। ২৩ জুন, বিত লাহিয়া.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র ণ ব তরণক ন দ র জ এইচএফ র কর মকর ত ব যবস থ ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর গুলি চালানোর দৃশ্য দেখেছেন নিরাপত্তা ঠিকাদার
‘মেশিনগান দিয়ে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর বেশ কয়েকবার গুলি চালাতে দেখেছি, যারা কোনো হুমকিই ছিল না’, গাজায় ইসরায়েল ও মার্কিন-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সাবেক নিরাপত্তা ঠিকাদার এ কথা বলেছেন। বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, একবার একদল নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে, শুধুমাত্র একটু ধীরে চলায় ওয়াচ টাওয়ার থেকে একজন প্রহরী মেশিনগান দিয়ে গুলি চালায়।
এ বিষয়ে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করছে তারা। তারা বিবিসিকে একটি বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে, জিএইচএফ সহায়তা কেন্দ্রের কাছে কোনো বেসামরিক নাগরিক কখনো গুলিবিদ্ধ হননি।
মে মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ ও মধ্য গাজার বেশ কয়েকটি এলাকায় সীমিতভাবে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে গাজায় নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে জিএইচএফ। এরপর গাজার ওপর ১১ সপ্তাহের সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল, এরপর থেকে ওই এলাকায় আর কোনো খাবার প্রবেশ করেনি। শুরু থেকেই সহায়তা বিতরণের এই ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। কারণ এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটে অল্প কয়েকটি জায়গায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল।
জাতিসংঘ এবং স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন, জিএইচএফ শুরু হওয়ার পর থেকে, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা সংগ্রহের চেষ্টার সময় ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। যদিও ইসরায়েল মনে করে, তাদের নতুন এই পদক্ষেপের ফলে হামাসের সাহায্য পাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের একটি দলের ওপর প্রহরীদের গুলি চালানো ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ঠিকাদার বলেন, একজন ঠিকাদার একটি লম্বা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে জনতার ওপর বারবার ১৫ থেকে ২০টি করে গুলি চালাতে শুরু করে। একজন ফিলিস্তিনি নিশ্চল হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য আরেকজন ঠিকাদার বলল, ‘ধুর, আমি ভাবলাম তুমি একজনকে মেরেছো’। আর তারপর তারা এটা নিয়ে হেসে উঠল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসির সাথে কথা বলা ওই ঠিকাদার বলেন, জিএইচএফের পরিচালকরা তার প্রতিবেদনটিকে কাকতালীয় ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয় এবং ফিলিস্তিনি ব্যক্তিটি ‘হোঁচট খেয়ে পড়েছিলেন’ অথবা ‘ক্লান্ত ও অজ্ঞান’ হয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি করে। জিএইচএফ দাবি করেছে, এই অভিযোগকারী ব্যক্তি একজন ‘অসন্তুষ্ট সাবেক ঠিকাদার’ যাকে তারা অসদাচরণের জন্য বরখাস্ত করেছিল।
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ঠিকাদার। বিবিসিকে তিনি বেতনের কয়েকটি স্লিপ দেখিয়েছেন যাতে বোঝা যাচ্ছে, ওই পদ ছাড়ার পরও তাকে দুই সপ্তাহ ধরে বেতন দেওয়া হয়েছে। জিএইচএফ পরিচালিত চারটি বিতরণ কেন্দ্রে কাজ করা ওই ব্যক্তি বিবিসিকে জানান, সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে নিয়ম, নিয়ন্ত্রণ খুবই কম যা দায়মুক্তির সুযোগ করে দেয়।
ঠিকাদারদের কোনো স্পষ্ট নিয়ম বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। একজন টিম লিডার তাদের বলেছিলেন, ‘যদি তুমি হুমকি মনে কর, গুলি কর- হত্যা করার জন্য গুলি কর এবং পরে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর’। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা গাজায় যাচ্ছি, তুমি যা ইচ্ছা কর। এখানে এটিই নিয়ম।
বিবিসিকে ওই ঠিকাদার বলেছিলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সমগ্র এলাকার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং জিএইচএফের দাবি- সেখানে কেউ আহত বা গুলিবিদ্ধ হয়নি। ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
সাবেক ওই ঠিকাদার বলেন, ইসরায়েলের সেনা দলের নেতারা গাজার বাসিন্দাদের ‘জম্বি’' বা ‘মৃত মানুষের দল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘যা এই মানুষগুলোর কোনো মূল্য নেই বলেই ইঙ্গিত দিয়ে।’
ওই ব্যক্তি আরও জানান, জিএইচএফ সাইটগুলোতে ফিলিস্তিনিরা অন্যভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। স্টান গ্রেনেডের ধ্বংসাবশেষের আঘাত কিংবা মানুষের ভিড়কে কাটাতারের মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে উদাহরণ হিসেবে বলেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকবার গুরুতর আহত হতে দেখেছেন তিনি। একবার একজন পুরুষের মুখে পিপার স্প্রের পুরো ক্যানই ঢেলে দেওয়া হয়েছিল বা একজন নারী স্টান গ্রেনেডের ধাতব অংশে আঘাত পেলেন, যা ভুলভাবে ওই মানুষগুলোর দিকে ছোঁড়া হয়েছিল।
ওই সাবেক ঠিকাদার বলছিলেন, ‘এই ধাতব টুকরোটি সরাসরি তার মাথায় আঘাত করে এবং সে নড়তে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। আমি জানি না তিনি মারা গেছেন কিনা। আমি কেবল দেখলাম, অজ্ঞান ও সম্পূর্ণরূপে নিস্তেজ ছিলেন।’
এ সপ্তাহের শুরুতে জিএইচএফ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ১৭০টিরও বেশি দাতব্য সংস্থা এবং অন্যান্য এনজিও। অক্সফাম এবং সেভ দ্য চিলড্রেনসহ সংস্থাগুলো বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ‘নিয়মিতভাবে’ সাহায্যপ্রার্থী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়। সাহায্য নিতে আগতদের ওপর নিজের সৈন্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। তারা বলছে, জিএইচএফ এর ব্যবস্থাপনা হামাসের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে, সাহায্য প্রার্থীদের সরাসরি সহায়তা প্রদান করে।
জিএইচএফ বলছে, পাঁচ সপ্তাহে পাঁচ কোটি ২০ লাখেরও বেশি খাবার তারা সরবরাহ করেছে এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো ‘অসহায়ভাবে তাদের সাহায্য লুট হওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়েছে’। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। যেখানে প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
হামাসের এই হামলার জবাবে গাজায় একটি অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তখন থেকে গাজায় কমপক্ষে ৫৭ হাজার ১৩০ জন নিহত হয়েছেন।