যুক্তরাষ্ট্র তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের বার্ষিক আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে অনুপস্থিত। ফলে নেতৃত্বের জায়গা ছিল শূন্য। বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় নেতৃত্বের জায়গায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে চীন।

ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত ‘কপ৩০’ সম্মেলনস্থলের প্রবেশমুখে চীনের প্যাভিলিয়ন আধিপত্য বিস্তার করে আছে। দেশটির বৃহত্তম নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা সবুজ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছেন। অন্যদিকে চীনা কূটনীতিকেরা পর্দার আড়ালে গঠনমূলক আলোচনা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। এর আগে এ ধরনের ভূমিকা ছিল ওয়াশিংটনের। এখন সেই ভূমিকা স্থানান্তরিত হয়েছে বেইজিংয়ের হাতে।

আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থার (আইআরইএনএ) মহাপরিচালক ফ্রান্সেসকো লা ক্যামেরা বলেন, ‘যেদিকে শূন্যস্থান থাকে, পানি সেদিকে গড়ায়। কূটনীতিও অনেক সময় ঠিক তেমনভাবেই চলে।’

লা ক্যামেরা আরও বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক যানবাহনে চীনের আধিপত্য জলবায়ু কূটনীতিতে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে।

জাতিসংঘের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ) সম্মেলনগুলোতে একসময় চীনের উপস্থিতি ছিল নীরব। কিন্তু দেশটি এখন বিশ্বের নজর কাড়তে আগ্রহী। এবারের সম্মেলনে তাদের মূল খেলোয়াড়ে রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে।

নতুন বাস্তবতা

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার পর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ে চীনের অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন বাস্তবতার প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে আসছেন ট্রাম্প। বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তি থেকেও সরিয়ে নিয়েছেন। এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধিদলও তিনি পাঠাননি।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র টেইলর রজার্স বলেন, ‘অন্য দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে এমন অস্পষ্ট জলবায়ু লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না।’

কিন্তু সমালোচকেরা সতর্ক করে বলেছেন, এই প্রক্রিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি জলবায়ু আলোচনার ক্ষেত্রে মূল্যবান জায়গা ছেড়ে দেওয়ার শামিল। কারণ, চীন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ হলেও নিজেদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্প দ্রুত বিস্তৃত করছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন নিউসম সম্মেলন পরিদর্শনে গেছেন। তিনি বলেন, ‘চীন বিষয়টা বুঝেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জাগ্রত না হলে প্রতিযোগিতামূলক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে। চীন কী করছে, কীভাবে সরবরাহ শৃঙ্খলে আধিপত্য নিচ্ছে, কীভাবে উৎপাদন খাতে নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, কীভাবে বাজার ছেয়ে ফেলছে—এসব ব্যাপার বুঝতে যুক্তরাষ্ট্রের দেরি হয়ে যাবে।’

সুন্দর পৃথিবী

গত বছর চীনের প্যাভিলিয়ন ছিল খুবই সাধারণ। সেখানে ছিল অল্প কটি আসন। গত বছর প্রযুক্তিগত ও একাডেমিক আলোচনার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমিত ছিল। এবারের সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ব্রাজিলের প্যাভিলিয়নের পাশে চীনের বড় প্যাভিলিয়ন দর্শকদের আকর্ষণ করছে। গত বৃহস্পতিবার সেখানে চীনের ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএটিএলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মেং জিয়াংফেং বলেন, ‘চলুন জলবায়ু সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাই এবং একসঙ্গে একটি পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি।’

এবারের কপের সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো এবং প্রধান নির্বাহী আনা দে টনি উভয়েই পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তিতে চীনের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। দে টনি বলেন, ‘চীন শুধু নিজেদের জ্বালানি বিপ্লবই ঘটায়নি; চীনের বিশাল উৎপাদন ক্ষমতার কারণে আমরা এখন প্রতিযোগিতামূলক দামে কম কার্বন প্রযুক্তি কিনতেও পারছি।’

আড়ালের ভূমিকায়

বর্তমান ও সাবেক আলোচকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করে আলোচনার আড়ালে চীন এখন আরও সূক্ষ্ম ও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আগে ওই ভূমিকা ছিল ওয়াশিংটনের। নাম প্রকাশ না করে এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, ধীরে ধীরে চীন জলবায়ু ব্যবস্থার একটি নিশ্চয়তা দানকারী (গ্যারান্টর) হিসেবে কাজ করছে। তারা সবুজ অর্থনীতিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এই ব্যবস্থায় কোনো ধরনের পশ্চাদপসরণ হলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এক ব্রাজিলিয়ান কূটনীতিক বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর আলোচনা শুরুর আগেই কপ৩০-এর এজেন্ডায় ঐকমত্য আনতে চীন বড় ভূমিকা রেখেছে। আগের বছরগুলোতে তারা কেবল কোনো গুরুতর ইস্যু থাকলেই সামনে আসত।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জলবায়ু দূত ও প্যারিস চুক্তির অন্যতম স্থপতি সু বিনিয়াজ বলেন, চীন উন্নয়নশীল দেশ থেকে শুরু করে বড় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে একত্র করতে সক্ষম। তারা শেষ পর্যন্ত এমন ফলাফল দাঁড় করায়, যেটিকে কেউই সহজে ভেটো দিতে পারে না। বিনিয়াজ অবশ্য চীনের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, চীন যদি সত্যিই নেতৃত্ব দেখাতে চাইত, তবে তারা আরও কার্বন নির্গমন কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করত।

জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় চীনের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক এবং এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের চায়না ক্লাইমেট হাবের প্রধান লি শুও অবশ্য পাল্টা যুক্তি দেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি খাতে চীনের অবস্থানই প্রমাণ করে যে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ, চীনা কোম্পানিগুলো এমন প্রযুক্তি তৈরি করছে, যা জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে সম্ভব করে দিচ্ছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র জলব য় ক টন ত

এছাড়াও পড়ুন:

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার দাবি নাগরিক কোয়ালিশনের

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দাবি জানিয়েছে নাগরিক কোয়ালিশন। শনিবার কোয়ালিশনের এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কোয়ালিশন। বিবৃতিতে এই কোয়ালিশন বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়াত সম্মেলনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। দেশের কিছু বড় ও মূলধারার রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে ভোটের প্রতিযোগিতায় তুষ্টিবাদী রাজনীতির অংশ হিসেবে আহমদিয়াদের প্রতি বিষোদ্‌গার করছে। এটি খুবই আশঙ্কাজনক ব্যাপার।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুরোধ করছি, এই সংকটকালে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন যেকোনো গোষ্ঠীর ব্যাপারে উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে; বিশেষ করে যারা ধর্মকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।’

দেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই সংবিধানে আহমদিয়াদের ধর্ম পালনের অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রয়েছে বলে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য এই অধিকার রক্ষায় আমরা অবিচল থাকব।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং ধর্মীয় পরিচয়–নির্বিশেষে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা বিষয়ে সরব থাকা। আমরা বিশ্বাস করি, এই মৌলিক সাম্যই হতে হবে জুলাই ২০২৪–পরবর্তী বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর।’

আরও পড়ুনখতমে নবুওয়তের মহাসম্মেলন থেকে ১ দফা দাবিতে বছরজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা৮ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ