একসঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়
Published: 23rd, July 2025 GMT
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে নতুন বিধান প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের।
প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান (একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অভিন্ন অবস্থানে আসতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকবেন না, এ বিষয়ে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দল একমত হয়েছে। এ বিষয়ে যেসব দল ও জোটের আপত্তি আছে, তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) দিতে পারবে।
মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ১৭তম দিনে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। একই ব্যক্তি একসঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এই প্রস্তাবে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও জোটের আপত্তি আছে। কমিশন এ দলগুলোকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে।
এর আগে এ বিষয়ে দুই দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা হয়। তবে এ নিয়ে মতভিন্নতা থেকে যায়। বিএনপির পক্ষ থেকে কমিশনকে অনুরোধ করা হয়, জাতীয় সনদে ভিন্নমত উল্লেখ করার সুযোগ রেখে যেন এ বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে। দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে একটি সমন্বিত প্রস্তাব দেয় ঐকমত্য কমিশন। এতে একটি সংসদীয় বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করা হয়। এটি নিয়ে দলগুলোকে মতামত জানাতে বলা হয়েছিল। ওই প্রস্তাবের কিছু বিষয় নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দলের মতভিন্নতা আছে। বিএনপি সোমবার রাতে লিখিতভাবে কমিশনকে তাদের মতামত জানায়।
এদিনের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন। বাছাই কমিটির গঠনপ্রক্রিয়া এবং বাছাইয়ে র্যাঙ্কড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে দলটির মতভিন্নতা আছে। বিএনপি র্যাঙ্কড চয়েজ পদ্ধতির বিপক্ষে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের শেষ ধাপ এটি। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, বাছাই কমিটি আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসতে না পারলে র্যাঙ্কড চয়েজ ভোটিং পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান হলো, কমিটি প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করতে না পারলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে যে রূপরেখা ছিল, সেটি হবে সর্বশেষ ধাপ। ওই রূপরেখায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান ছিল। পাশাপাশি কিছু বিকল্পও ছিল।
র্যাঙ্কড চয়েজ পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতে ইসলামীরও নীতিগত মতভিন্নতা আছে। তবে এনসিপি এ পদ্ধতির পক্ষে।
গতকালের আলোচনা শেষে বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, আবার আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে বলে তিনি আশা করেন।
ইসি, পিএসসি গঠনে নতুন প্রস্তাব
সংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। কিন্তু এ বিষয়ে বিএনপিসহ কিছু দলের আপত্তি থাকায় এনসিসি বাদ দিয়ে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু সেটা নিয়েও বিএনপিসহ কিছু দলের আপত্তি ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এতে নির্বাচন কমিশন (ইসি), সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
গতকাল নতুন প্রস্তাবটি আলোচনায় উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে শুধু নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের বিধান নিয়ে আংশিক আলোচনা হয়। প্রস্তাবিত বিধানে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে। এই অনুচ্ছেদে আইনের বিধান সাপেক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
এর বদলে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হলো, সংসদীয় একটি বাছাই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে উপযুক্ত ব্যক্তিদের বাছাই করবে। কমিটিতে থাকবেন স্পিকার (কমিটির প্রধান), ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত), সংসদ নেতা, বিরোধী দলের নেতা, তৃতীয় বৃহত্তম দল বা প্রধান বিরোধী দল ছাড়া অন্য বিরোধী দলগুলোর একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি (নির্দলীয় ব্যক্তি) এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে ঐকমত্য কমিশন।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ছ ই কম ট র প রস ত ব দলগ ল র ব চ রপত র আপত ত কম ট র র পর খ সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
সংস্কার প্রশ্নে বাড়াবাড়িতে না গিয়ে দ্রুত নির্বাচনমুখী কর্মসূচির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে শিগগিরই নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন এবং প্রার্থী বাছাইয়ের দিকেও মনোযোগ দেবে দলটি।
গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর এসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের যৌথ কর্মসূচি ঘোষণা, জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য না হলে এর প্রতিক্রিয়ায় কী হতে পারে, অথবা সরকারের দিক থেকে অমীমাংসিত সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া হলে এর পরিণতিতে কী হতে পারে—এসব বিষয়ে নেতারা আলোচনা করেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সভায় অংশ নেন। তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল সভায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
ওই সূত্র বলছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মনে করেন, জুলাই জাতীয় সনদ বা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির দিক থেকে যে অবস্থান প্রকাশ করা হয়েছে, এর বাইরে আর তেমন কিছু করার নেই। এখন বিএনপির অপেক্ষায় থাকাই ভালো যে এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি বিএনপির উচিত হবে এ নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়িতে না গিয়ে দ্রুত নির্বাচনমুখী কর্মসূচির দিকেই যাওয়া—যাতে অন্য শক্তি নির্বাচনমুখী পরিবেশ সৃষ্টির পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকব। সংস্কারের ব্যাপারে সরকার যা খুশি করুক, ভবিষ্যতে যাতে এটা নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জ না হয়, সেটাই বিএনপির চাওয়া।’
এর আগে স্থায়ী কমিটির একটি সভায় সারা দেশে জাতীয় নির্বাচনের ঢেউ সৃষ্টি এবং মানুষকে নির্বাচনমুখী করে তুলতে মাঠের কর্মসূচি শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলটির নেতারা। কিন্তু সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার সমাপ্তি না হওয়ায় বিএনপি মাঠের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকে।
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজনসহ কয়েকটি দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিএনপি মনে করে, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা অমীমাংসিত রেখেই দলগুলো কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সে কারণে বিএনপিরও কর্মসূচি শুরু করা উচিত বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
অবশ্য জামায়াতসহ কয়েকটি দলের কর্মসূচির বিষয়ে সোমবার রাতে প্রথম আলোকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় কর্মসূচি ঘোষণা স্ববিরোধিতা। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এই আন্দোলন কাদের বিরুদ্ধে, সেটা দেখতে হবে। এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে, নাকি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে, নাকি বিএনপির বিরুদ্ধে? এটা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার কোনো কৌশল কি না, সেটাও দেখতে হবে।
সোমবার স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপির নেতারা বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক কৌশলের বিপরীতে মাঠের কর্মসূচি দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে জবাব দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মনে করছেন, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া উঠে গেলে বিরোধীদের সব চক্রান্ত এবং অযৌক্তিক দাবি হারিয়ে যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একাধিকবার এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং দেশবাসীকে দৃঢ়ভাবে আশ্বস্ত করেছেন। সে অনুযায়ী নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ভোটের হাওয়া তৈরি করার কথা ভাবছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনী অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি হিসেবে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির বিষয়েও নেতারা স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা করেন। ইশতেহার তৈরির জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ-বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সভায় জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নীতিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের মতো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। সেটি তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও বলেছিল।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে জনপ্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকারের পাশাপাশি সংস্কার বাস্তবায়নমুখী ইশতেহার হবে।