কুকুরে কাছে হাড্ডি যেমন চির আকাঙ্ক্ষিত, আমদানি শুল্ক বা ট্যারিফও তেমনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। আর তিনি এখন তাঁর শুল্ক আক্রমণের জন্য নতুন তালিকা প্রস্তুত করছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা যেমন আছে, তেমনি আছে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব কিছু দেশ। আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন হারের আমদানি শুল্ক এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য প্রযোজ্য হবে।

আচ্ছা, ট্রাম্প কি আবার পিছু হটতেও পারেন? কে জানে! হতেও পারে! তবে তাঁর এহেন যুক্তিহীন বেনিয়াবাদকে প্রশমিত করার জন্য বিভিন্ন দেশ যে দ্রুত এগিয়ে এসে সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হবে, তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমনকি নেই বললেই চলে। কারণ, একজন যুক্তি-বুদ্ধিহীন মানুষ সম্পর্কে কোনো কিছুই আগাম ধারণা করা সম্ভব নয়। হতে পারে, এবার তিনি যা বলছেন, তা–ই করবেন। তা–ই যদি হয়, তাহলে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গড় কার্যকর শুল্কহার ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে আরও বেড়ে যাবে। আমরাও এক নয়া দুনিয়ায় প্রবেশ করব।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক ঝড়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে আমেরিকা০৬ এপ্রিল ২০২৫

একনজরে দেখা যাক যে ট্রাম্প এ দফায় কী হারে শুল্ক আরোপ করতে চাচ্ছেন: ব্রাজিল থেকে পণ্য আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ হারে; লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ; বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ; ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ; দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ৩০ শতাংশ এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ করে।

প্রস্তাবিত শুল্কগুলো এ বছর ২ এপ্রিল এক অভূতপূর্ব সূত্রানুসারে বিভিন্ন দেশের ওপর যে হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল, অনেকটা তার কাছাকাছি। আর এই অভূতপূর্ব সূত্র দিয়ে শুল্কহার নির্ধারণের মূল বিবেচ্য হলো কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতিকে সেই দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি দিয়ে ভাগ করা।

কেন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারসাম্য অবশ্যই থাকতে হবে, তার কোনো নিপাট কারণ নেই। আর তাই নেই বলে এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে বাণিজ্য ভারসাম্য যার অনুকূলে বা যে দেশে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করছে, সে দেশে কোনো প্রবঞ্চনা করছে।

সর্বোপরি, পণ্য বাণিজ্যে বা পণ্য ও সেবা খাতের বাণিজ্যে সার্বিক ভারসাম্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে নির্ধারিত বাণিজ্য ভারসাম্যের সমষ্টি নয়। বরং এটি হলো জাতীয় আয়, পুঁজিপ্রবাহ এবং সামষ্টিক আয় ও ব্যয়ের যুগপৎ মিথস্ক্রিয়ার ফল। [সহজভাবে বললে, বাণিজ্য ভারসাম্য হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) একটি উপাদান। অন্য উপাদানগুলো হলো: ভোগ ব্যয়, বিনিয়োগ ও সরকারি ব্যয়।] তাই এটা বিশ্বাস করা পাগলামিই যে যুক্তরাষ্ট্র বিরাট রাজস্ব ঘাটতি বহন করে চলবে অথচ তার বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি থাকবে না, অন্তত যতক্ষণ বাকি দুনিয়া এই ঘাটতির অর্থায়ন করে চলবে। যদি তা না করা হয়? এক বড় আর্থিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

এমতাবস্থায় অযৌক্তিকভাবে জোড়াতালি দেওয়া শুল্কহার প্রস্তাব করে সম্পদ বণ্টনে বড় ধরনের হযবরল অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা বুঝতে পারছে না (বা চাচ্ছে না), তা হলো কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করার মানে হলো, অন্য কিছু পণ্য উৎপাদনের ওপর কর আরোপ করা। ইস্পাত বা অ্যালুমিনিয়ামের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করার মানে হলো, যেসব উৎপাদক এসব কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্য পণ্য উৎপাদন করে, তাদের ওপর কর আরোপ করা। যদি উৎপাদকেরা আমদানি-বিকল্প পণ্য উৎপাদন করে থাকে, তাহলে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে হয়তো তাদের খরচের কিছুটা মেটানো যেতে পারে। কিন্তু যদি তারা রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন করে, তাহলে তা নয়। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে ট্রাম্পের শুল্ক থেকে দেশের স্বল্প প্রতিযোগিতাসক্ষম অংশ সুবিধা পাবে অধিক প্রতিযোগিতাসক্ষম অংশের ব্যয়ে। এর কোনো মানে হয়? নিশ্চয়ই না।

ট্রাম্পের এসব শুল্ক শুধু বোকামিতে পূর্ণই নয়, বরং ভয়াবহ। আমি দুটো উদাহরণ দেব। প্রথমটি হলো, ট্রাম্প যে ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন সেটি। দেশটির প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এই শুল্ক আরোপ হলো তাঁর ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ মানে ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর বিচার শুরু করার প্রতিক্রিয়া।

আরও বাজে বিষয় হলো, পুরো মনোযোগ অতীতের বিষয়বস্তুর ওপর নিবদ্ধ। অথচ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আগামীর প্রতিযোগিতাসক্ষমতা। ফলে, এখন যা হচ্ছে তা হলো, ডাইনোসরকে আবার সৃষ্টি করার প্রয়াস। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ডেভিড আর্থার এবং হার্ভার্ডের গর্ডন হ্যানসন উল্লেখ করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আজকের চ্যালেঞ্জ হলো, একটি কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান। যদি এই উত্থানের জবাব দিতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার মিত্রদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অধিক সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে এবং মেধাবী অভিবাসীদের স্বাগত জানাতে হবে।

আরও পড়ুনশুল্ক–সুবিধা পেয়েও চীনে কেন আমাদের রপ্তানি বাড়ছে না০৬ জুলাই ২০২৪

তবে এসব কিছুই যে ট্রাম্প এখন যা করছেন, তার বিপরীত! তিনি ‘আমেরিকাকে আবার মহান বানাবেন?’ প্রায় অসম্ভব। হ্যাঁ, আর্থিক বাজারগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের এসব দীর্ঘমেয়াদি বিপদ উপেক্ষা করছে। তারা হয়তো সঠিক। তবে এরপর আর ঠিক না–ও হতে পারে।

ট্রাম্পের এসব শুল্ক শুধু বোকামিতে পূর্ণই নয়, বরং ভয়াবহ। আমি দুটো উদাহরণ দেব। প্রথমটি হলো, ট্রাম্প যে ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন সেটি। দেশটির প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এই শুল্ক আরোপ হলো তাঁর ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ মানে ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর বিচার শুরু করার প্রতিক্রিয়া।

বলসোনারো ব্রাজিলের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল উল্টে দিতে চেয়েছিলেন (নিজের পরাজয় ঠেকাতে)। বিষয়টা পরিচিত ঠেকছে না? পল ক্রুগম্যান একে ট্রাম্পের ‘স্বৈরাচার সুরক্ষা কর্মসূচি’ (ডিটেক্টর প্রটেকশন প্রোগ্রাম) হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্য সব কিছু বাদ দিলেও এই উদ্দেশ্যে শুল্ক ব্যবহার করার কোনো আইনি এখতিয়ার ট্রাম্পের নেই।

অপর উদাহরণটি হলো, লাওসের ওপর নির্মমভাবে শুল্ক আরোপ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুসারে, লাওস অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ যার মাথাপিছু জিডিপি বা আয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের ১১ শতাংশ। আবার ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে লাওসের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ৮০ কোটি ডলার।

এ রকম একটা দেশের ওপর একটা পরাশক্তি শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করবে, এমন চিন্তা করাটাই তো বোকামির সীমা ছাড়িয়ে যায়। এটা ভয়াবহ ব্যাপার। আর যে বিষয়টা এহেন শুল্ক আরোপকে অপূরণীয় পাপ করে তুলেছে, তা হলো; ‘১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র লাওসে ২০ লাখ টন বোমা বর্ষণ করেছিল।.

.ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লাওসের ওপর যে পরিমাণ বোমা ফেলা হয়, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপানের ওপর সমন্বিতভাবে নিক্ষিপ্ত বোমার পরিমাণের চেয়ে বেশি।’ [ট্রাম্প প্রশাসনের] এ লোকগুলোর কি তাহলে কোনো লজ্জা নেই?

হোয়াইট হাউস অবশ্য স্পষ্টই ঘোষণা করেছে যে এই প্রশাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘ইতিহাসের সেরা বাণিজ্য দর-কষাকষিকারী (ট্রেড নেগোশিয়েটর)’ যাঁর কৌশল হলো, ‘আমাদের শুল্কহারের পদ্ধতিগত ভারসাম্যহীনতা ঠিক করা যা দশকের পর দশক ধরে আমাদের বাণিজ্য অংশীদারদের অনুকূলে রয়ে গেছে।’

বস্তুত, আগামী কয়েক মাসে প্রায় ২০০টি দেশের সঙ্গে দূরে থাকে, ১০০টি দেশের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে পারবে না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো দাবি একেবারে অগ্রহণযোগ্য। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাতিল করতে হবে বলে যে দাবি করা হয়েছে। মূসক বা ভ্যাট বাণিজ্যে বিকৃতি ঘটায় না, এটা ইইউর বাজারে বিক্রি হওয়া সব পণ্য ও সেবার ওপর আরোপিত। সর্বোপরি বিভিন্ন দেশের ওপর যথেচ্ছ হারে শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কোনোভাবেই কমাবে না।

তাহলে এই উন্মাদনা ঠেকাতে করণীয় কী? প্রথমত, আমাদের এটা আশা করা উচিত যে ট্রাম্প হুংকার দিয়ে পরে ভীত হয়ে পিছিয়ে আসবেন, এর পুনরাবৃত্তি চলবে। যদিও এর ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মূল্যটাও নেহাত কম নয়। দ্বিতীয়ত, অবশ্যই সমন্বিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করতে হবে। ‍

তৃতীয়ত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সব সদস্যকে এই ঘোষণা দিতে হবে, কোনো একটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করলে তা অন্য সব দেশকেও দিতে হবে আর তা হবে সর্বোচ্চ অনুকূল সুবিধা বা মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) নীতি অনুসারে। সবশেষে, ডব্লিউটিওর সব সদস্যের উচিত হবে একে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা, তাদের পারস্পরিক চুক্তি অনুসারে। যুক্তরাষ্ট্র দুর্বৃত্তায়িত হয়ে গেছে। বাকি দুনিয়ার তাকে অনুসরণ করার দরকার নেই।

মার্টিন উলফ দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) প্রধান অর্থনৈতিক ভাষ্যকার। এফটিতে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র শ ল ক আর প র দ শ র ওপর ভ রস ম য কর ছ ন র জন য আম দ র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন, চ্যাম্পিয়ন পিএসজির গোল উৎসব

বায়ার্ন মিউনিখ ৩–১ চেলসি

২০১২ সালে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ইতিহাস গড়েছিল চেলসি। ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো পরেছিল ইউরোপসেরার মুকুট।

 তবে এরপর থেকে বায়ার্নের সঙ্গে মুখোমুখি সব ম্যাচেই হেরেছে চেলসি। লন্ডনের ক্লাবটি পারল না আজও। হ্যারি কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে ৩–১ ব্যবধানে হারিয়েছে বায়ার্ন।

আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ম্যাচের ২০ মিনিটে বায়ার্ন প্রথম গোলটা পেয়েছে উপহারসূচক। চেলসির সেন্টার–ব্যাক ট্রেভোহ চালোবাহ নিজেদের জালে বল জড়ালে এগিয়ে যায় বাভারিয়ানরা।

কিছুক্ষণ পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কেইন। এবার ভুল করে বসেন চেলসির মইসেস কাইসেদো। নিজেদের বক্সে কেইনকে কাইসেদো অযথা ট্যাকল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি।

নতুন মৌসুমে গোলের পর গোল করেই চলেছেন হ্যারি কেইন

সম্পর্কিত নিবন্ধ