বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা হঠাৎ করে জরুরি বৈঠক ও সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন। কারণ, কাতারের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইসরায়েল দোহায় হামাস নেতাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কাতার শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রই নয়, দেশটি গাজার শান্তি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও।

এ হামলার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান দোহায় এসে কাতারের আমিরকে আলিঙ্গন করেছেন। কয়েক বছর আগে যখন এ দুই দেশের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল, তখন এমন দৃশ্য ভাবাও সম্ভব ছিল না।

 এ ছাড়া সৌদি আরব ইসরায়েলি হামলার পর প্রতিক্রিয়া দেখাতে আরব, ইসলামি ও আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে অপরাধ বলে নিন্দা জানিয়েছে।

সম্প্রতি আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে চীনের তিয়ানজিনে একত্র হতে দেখলাম। সেখানে তাঁরা হাসিমুখে কথা বলেছেন। এটি এই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি প্রতিচ্ছবি। এই সমাবেশের পেছনে কারণ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি কিছুটা দূরত্বে চলে গেছেন।

আরও পড়ুনট্রাম্পের ধাক্কায় হতভম্ব মোদি যে কঠিন শিক্ষা নিচ্ছেন০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই যেসব বিদেশি নেতা ওয়াশিংটনে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন, মোদি তাঁদের একজন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়ে ট্রাম্পকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেখানে ট্রাম্প মোদিকে ‘মহান বন্ধু’ বলেছিলেন। সেখানে তাঁরা দুই দেশের মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যবসা দ্বিগুণ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু মাস কয়েক পরই ট্রাম্প ভারতের আমদানি করা পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপান।

ইসরায়েলের দোহা হামলার কয়েক মাস আগে ট্রাম্প কাতারের রাজধানীতে সফর করার সময় বলেছিলেন, ‘আমাদের এই বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্প কাউকে ‘বন্ধু’ বললে তার মানে কিন্তু সম্পর্কের নিশ্চয়তাকে বোঝায় না; বরং এতে সেই ‘বন্ধুর’ বিপদে পড়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে।

আসলে এসব সমাবেশ, নতুন একতার প্রকাশ ও আঞ্চলিক জোটের দৃঢ়তা কিছু ক্ষেত্রে কেবল দেখানোর জন্য। ভারত বা কাতারের ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরাসরি যাওয়ার সত্যিই আগ্রহ নেই। তাদের অসন্তোষ কিংবা বন্ধুত্ব দেখানো মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর জন্য যে তারা বিশ্বাসঘাতক নয় এবং তাদের কাছে অন্য বিকল্পও আছে।

আরও পড়ুনচার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তবে এসব আয়োজনকে সত্যিকারের শক্তিশালী জোট তৈরি করার চেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। ট্রাম্পের মতো সম্ভবত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও মনে করেন, তাঁরা এমন ‘মূল্য নির্ধারক’ হিসেবে থাকতে পারেন, যাঁদের হাতে বাজারে পণ্যের দাম ঠিক করার ক্ষমতা আছে। ইসরায়েল সম্ভবত মনে করে, তারা যাকে ইচ্ছা তাকে বোমা মেরে শেষ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভাবে, তারা যখন-তখন নিরাপত্তাচুক্তি ভঙ্গ করতে পারে এবং নিজের শর্ত যে কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু যদি এটা খুব দীর্ঘ সময় ধরে চলে, তখন যুক্তি মেনে চলা দেশগুলো এই অসংগত পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে শুরু করবেই। এটা এ কারণে নয় যে তারা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইসরায়েলকে শক্তিধর দেখতে অপছন্দ করে। উপসাগরীয় দেশগুলোও এর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করেছে এবং সেখানকার কোনো কোনো দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। এখন এই দেশগুলোও মনে করছে, ট্রাম্প খামখেয়ালি এবং ইসরায়েল লাগামহীন। এ কারণে দেশগুলো তাদের নিজেদের ক্ষমতা যাচাই করছে এবং কীভাবে এক হওয়া যায়, সে চেষ্টা করছে। যখন কোনো ঘনিষ্ঠ মিত্রকে ধোঁকা দেওয়া হয়, তখন সবাই বুঝতে পারে, কেউ নিরাপদ নয়।

উদাহরণস্বরূপ, আব্রাহাম চুক্তির অংশীদার সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারে হামলার পর ইসরায়েলের প্রতি আগের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষায় কথা বলেনি। তারা এর তীব্র সমালোচনা করছে। এই চুক্তিগুলোর ভবিষ্যৎ ইতিমধ্যে সন্দেহের মুখে পড়ে গেছে।

ট্রাম্পের বিদেশনীতি এখন যেভাবে চলছে, তাতে তাঁর খামখেয়ালি ধরনটিকে বোঝা জরুরি। ট্রাম্পের এখন খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই এবং তাঁর অতিরিক্ত বিনিয়োগ সেই আস্থা ফেরাতে খুব একটা কাজে দেবে না।

নাসরিন মালিক দ্য গার্ডিয়ান–এর কলামিস্ট

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পকে ইউক্রেনের পাশে থাকার আহ্বান রাজা চার্লসের

বিশ্বের সবচেয়ে জটিল কিছু সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস। একই সঙ্গে তিনি ‘স্বৈরাচারের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন’ দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান। খবর বিবিসির।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের প্রথম দিনে উইন্ডসর ক্যাসলে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে দেওয়া বক্তৃতায় এ কথা বলেন রাজা।

আরো পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৩ পুলিশ নিহত

সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন ট্রাম্প

জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্কের প্রশংসা করে বলেন, এ সম্পর্ককে ‘বিশেষ’ শব্দ দিয়ে যথাযথভাবে বোঝানো যায় না।

উইন্ডসর ক্যাসলে ১৬০ জন অতিথির জন্য আয়োজিত জাঁকজমকপূর্ণ এই নৈশভোজে রাজার বক্তৃতায় দুই দেশের গভীর বন্ধন এবং সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়।

ট্রাম্পের রাষ্ট্রীয় এ সফর চলবে আজ বৃহস্পতিবারও। এদিন নানা অনুষ্ঠানে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে অংশ নেবেন ব্রিটিশ রানি ক্যামিলা ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস।

রাজকীয় অ্যাপায়ন শেষে ট্রাম্পের আজকের কর্মসূচি রাজনৈতিক আলোচনায় রূপ নেবে। আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার সরকারি বাড়ি চেকার্সে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনও হবে। 

বুধবারের (১৭ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় ভোজ ছিল আড়ম্বর ও রাজনীতির সমন্বয়ে সাজানো এক বিশেষ আয়োজন। ভোজে রাজা, রানি ও রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো হয় উইন্ডসরে।

উইন্ডসর ক্যাসলের মনোরম প্রাঙ্গণে পৌঁছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মেলানিয়া রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো সেনাদলের অভিবাদন গ্রহণ করেন তারা। 

যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।

যুক্তরাষ্ট্রের অতিথিকে স্বাগত জানাতে প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলসও উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রেসিডেন্ট ও মেলানিয়ার সঙ্গে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ এক বৈঠকও করেন।

ভোজসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রিন্স উইলিয়ামের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তিনি হবেন ‘অসাধারণ সফল নেতা’। প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথরিনকে তিনি আখ্যা দেন ‘উজ্জ্বল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সুন্দরী’ হিসেবে।

ট্রাম্পের ঐতিহাসিক এ দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর প্রমাণ করেছে রাজা ও তাঁর মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো। সফরে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মুহূর্তও দেখা গেছে।

এরপর রাজপ্রাসাদে ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানান রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা। ট্রাম্প যখন রাজার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ছয়টি কামান থেকে একযোগে ৪১ বার তোপধ্বনি করা হয়। একই সময়ে টাওয়ার অব লন্ডন থেকে একই রকম তোপধ্বনি হয়।

ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানানোর এ আয়োজনে অংশ নেন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ১ হাজার ৩০০ সদস্য। ছিল শতাধিক ঘোড়া।

যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।

বিবিসি বলছে, রাজকীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থাকবে।

যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় সফর হলো একধরনের নরম শক্তির কূটনীতি, যা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাজকীয় আকর্ষণ ব্যবহার করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক সেবা, প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় গড়ে তুলে যুক্তরাজ্যকে আমেরিকান বিনিয়োগের প্রধান গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে চাইছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর শুরু হওয়ার সাথে সাথে, মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের একটি বড় প্রযুক্তি চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে মাইক্রোসফট থেকে ২২ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা দেখা যাবে। 

ট্রাম্পের সফরের আগে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট যুক্তরাজ্যের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-স্টারমারের বৈঠক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক চুক্তির ঘোষণাও আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ