আমিনুল সুযোগটা কাজে না লাগালে সেটি হবে ‘পাপ’
Published: 9th, October 2025 GMT
বিসিবি নির্বাচন তো নয়, যেন নেটফ্লিক্স অরিজিনাল রুদ্ধশ্বাস কোনো থ্রিলার সিরিজ। ঘটনার ঘনঘটা, বিতর্ক, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ...এসবের মধ্যেই আবার নিয়মিত বিরতিতে ‘কোর্ট সিন’। আদালত থেকে আজ এই রায় আসছে তো কয়েক দিন পরই অন্য রায়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রতিটি দিনই যেন চমকে ভরা নতুন একেকটি পর্ব।
কিন্তু শুরুতে দর্শক-মনে প্রবল উত্তেজনা ও ‘কী হয়-কী হয়’ অনিশ্চয়তার রেশ শেষ পর্যন্ত টেনে নিতে ব্যর্থ হলে থ্রিলার সিরিজ যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, বিসিবি নির্বাচনেরও শেষ পর্যন্ত সেই দশা। শেষ দৃশ্যে কোনো চমক তো নেই-ই, তা যে থাকবে না, সেটিও অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। সেটি কোন দিন? বিসিবির ইতিহাসে এই প্রথম ‘সভাপতি কে হচ্ছেন’ আলোচনায় চায়ের কাপে ওঠা ঝড় যেদিন হঠাৎই থেমে গেছে।
শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটিকে অনায়াসে ‘নামকাওয়াস্তে’ নির্বাচন বলতে পারেন। ‘সাজানো নির্বাচন’ও বলছেন কেউ কেউ।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত এত পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা কারও মনে পড়তেই পারে। সেবার ১৫৩টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলের প্রার্থীই ছিলেন না। বিএনপি সেই নির্বাচন বর্জন করে যে ‘ভুল’ করেছিল, এখানে তামিম ইকবালের নেতৃত্বে ঢাকার ক্লাবগুলোর বড় অংশও তা করেছে।
এ নিয়ে তামিমের ছায়াতলে দাঁড়ানো ক্লাব সংগঠকেরা মনে মনে হয়তো আফসোসও করছেন। মনে মনেই–বা বলছি কেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পরদিনই তো সুর বদলে ক্রীড়া উপদেষ্টাকে ‘ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক’ মেনে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি–মিনতি করেছেন তাঁরা। তাতে কাজ না হওয়ায় বরাবরের মতোই না খেলার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। বিসিবির নতুন কমিটির সামনে তাই ভবিষ্যতে হঠাৎ কোনো ঝামেলা চলে এলে তাতে অবাক হবেন না যেন।
আরও পড়ুনএই স্বপ্নভঙ্গের ক্রিকেট কি আমরা চেয়েছিলাম০৬ নভেম্বর ২০২১বিসিবি পরিচালনা পর্ষদে জায়গা পেতে যে কামড়াকামড়ি চলল, নির্বাচনের পরও এ নিয়ে মাঠ যেমন গরম, তাতে আপনি মুগ্ধ হতেই পারেন। দেশের ক্রিকেটে অবদান রাখার জন্য কী ব্যাকুলতাই না কাজ করছে সবার মধ্যে! মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি আমোদিতও হয়তো হয়েছেন। নাটকও তো কম হয়নি। হঠাৎই বিসিবির সভাপতি হয়ে যাওয়ার পর ‘শর্ট একটা টি-টোয়েন্টি ইনিংস’ খেলার কথা বলা আমিনুল ইসলাম বুলবুল ‘ক্রিকেট উন্নয়নের প্রেমে’ পড়ে এখন লম্বা টেস্ট ইনিংস খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমিনুলের ‘ফরম্যাট’ বদলে ফেলার চেয়েও নাটকীয় ফারুক আহমেদের প্রত্যাবর্তন।
রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। বিসিবির নির্বাচনেও দেখছি একই কথা প্রযোজ্য। নইলে বিসিবি থেকে ফারুক আহমেদের ওভাবে বিদায়ের দিন কে ভাবতে পেরেছিলেন, মাস চারেক পরই তিনি ফিরে আসবেন সহসভাপতি হয়ে!
ফারুকের সভাপতি হওয়া থেকে বিসিবি থেকে বিদায়, আবার ফিরে আসা—সবকিছুরই নিয়ন্তা ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া; হয়তো ৬ অক্টোবর বিসিবি নির্বাচনেরও। বিএনপিপন্থী ক্রীড়া সংগঠকেরা তো সরাসরিই সেই অভিযোগ করছেন। হয়তো তা মিথ্যাও নয়। কিন্তু বিসিবির গঠনতন্ত্রই কি এই সরকারি হস্তক্ষেপের অবারিত সুযোগ দিয়ে রাখেনি!
ফারুকের সভাপতি হওয়া থেকে বিসিবি থেকে বিদায়, আবার ফিরে আসা—সবকিছুরই নিয়ন্তা ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া; হয়তো ৬ অক্টোবর বিসিবি নির্বাচনেরও। বিএনপিপন্থী ক্রীড়া সংগঠকেরা তো সরাসরিই সেই অভিযোগ করছেন। হয়তো তা মিথ্যাও নয়। কিন্তু বিসিবির গঠনতন্ত্রই কি এই সরকারি হস্তক্ষেপের অবারিত সুযোগ দিয়ে রাখেনি!১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর থেকেই ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা, এত বছর পরও সেটি কাজির গরুর মতো ‘কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ হয়ে থাকার কারণেই না সম্ভব হয়েছে তা। জেলা ও বিভাগীয় ক্রিকেট সংস্থা থাকলে তো কাউন্সিলর নির্বাচনে এতটা সরাসরি ‘সরকারি হস্তক্ষেপের’ সুযোগ থাকত না।
বিসিবির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জেলা–বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন না থাকলে কাউন্সিলর আসবেন জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে। সেই জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা গঠন করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর সভাপতি আবার পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসক, যিনি সরকারি চাকুরে। জেলা ও বিভাগ থেকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বা ক্রীড়া উপদেষ্টার নিজের পছন্দমতো প্রতিনিধি আনার ব্যবস্থা তো তাই নিয়মের মধ্যে থেকেই করা যায়। আসিফ মাহমুদ সেটাই করেছেন।
ফিফার চাপাচাপিতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ডিএফএ বা ডিস্ট্রিক্ট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করতে বাধ্য হওয়ায় ফুটবলে যে সুযোগ কিছুটা হলেও সীমিত। বিসিবি এত বছরেও যে সেই পথে হাঁটেনি, এটিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা। হাঁটেনি ইচ্ছা করেই।
আরও পড়ুনগণতন্ত্র, ক্রিকেট আর ক্রীড়া সংস্থায় গণতন্ত্র০৭ মার্চ ২০১১তাহলে যে বিসিবিতে ঢাকার ক্লাবগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য একটু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ঢাকার ক্লাব কর্মকর্তারাই এত দিন ছড়ি ঘুরিয়ে আসছেন ক্রিকেট বোর্ডে। ক্লাবের স্বার্থ দেখতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থও অনেক সময়ই গৌণ হয়ে গেছে তাঁদের কাছে। ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণও হয়নি নিজেদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার উদগ্র অভিলাষ থেকেই। যে কারণে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখনো কার্যত ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড।
একটা উদাহরণ দিলেই যা আরও পরিষ্কার হবে। বিসিবি নির্বাচনের আগে ঢাকার তৃতীয় বিভাগের ১৪টি ক্লাব নিয়ে এই যে আদালতে এত দৌড়াদৌড়ি হলো, এই ১৪টি ক্লাব তো একটা শহরের চতুর্থ স্তরের একটা লিগে খেলে। বছরে মাত্র দুই–আড়াই মাস সেই লিগ চলে। এটাও কারও অজানা নয় যে বিসিবিতে নাজমুল হাসানের দীর্ঘ রাজত্বের সময় ঢাকার লিগগুলো কেমন পাতানো খেলার মহোৎসবে পরিণত হয়েছিল।
একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশে এটা কীভাবে সম্ভব যে একটা শহরের চতুর্থ স্তরের লিগের দল থেকে একজন বোর্ডের সদস্য (কাউন্সিলর মানে তো তা-ই) হয়ে যাচ্ছেন, একটা পুরো বিভাগ বা জেলা থেকেও একজন। দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগ লিগের একটি ক্লাবের প্রতিনিধি বিসিবির পরিচালক হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকও হয়ে যেতে পারছেন।
বিসিবির পরিচালনা পর্ষদেও তো ঢাকার ক্লাব প্রতিনিধিদের সংখ্যাধিক্য। জেলা আর বিভাগ থেকে ১০ জন পরিচালক, যেখানে ঢাকার ক্লাবগুলো থেকে ১২ জন।
জুলাই বিপ্লব–পরবর্তী সংস্কারের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে এতে পরিবর্তন আনার একটা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার ক্লাবগুলোর হুমকি-ধমকিতে গঠনতন্ত্র সংশোধনের সেই চেষ্টা শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। টেস্ট খেলুড়ে অন্য সব দেশের ক্রিকেট কাঠামো সম্পর্কে যথেষ্টই ধারণা আছে আমিনুলের। তাঁর অবশ্যকরণীয় তালিকায় বিসিবির গঠনতন্ত্রকে একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের উপযোগী করে তোলাটাও তাই অবশ্যই থাকা উচিত।
ঢাকাকেন্দ্রিক ক্রিকেটকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে, তা পূরণের অপরিহার্য পূর্বশর্তও এটি।
ইতিহাস কখনো কখনো কাউকে একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমিনুলকেও দিয়েছে। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার রজতজয়ন্তীতে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরিয়ান বোর্ড সভাপতি এটিকে দৈবনির্ধারিত মনে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়, বলুন! আমিনুল ইসলাম বুলবুল, এই সুযোগ কাজে না লাগালে সেটি হবে ‘পাপ’।
উৎপল শুভ্র প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব স ব র গঠনতন ত র উপদ ষ ট আম ন ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কেন্দ্রীয় সংসদে ২৩, হল সংসদে ৯ পদ রেখে গঠনতন্ত্র অনুমোদন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো