যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে ভেনেজুয়েলার কি ঠেকানোর ক্ষমতা আছে, কী প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা
Published: 16th, November 2025 GMT
নিজস্ব উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার সারা দেশে বড় পরিসরে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয় ভেনেজুয়েলা।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রও ‘সাউদার্ন স্পিয়ার’ নামে একটি অভিযান ঘোষণা করেছে। তারা বলছে, পশ্চিম গোলার্ধে ‘মাদক চোরাচালানকারীদের’ লক্ষ্য করে এ অভিযান চালানো হবে।
উত্তেজনা দ্রুত বাড়তে থাকায় কারাকাসে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অজুহাত হিসেবে এমন তৎপরতা চালাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার কারাকাসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল বলেন, ‘আমরা মার্কিন সাম্রাজ্যকে বলব, তারা যেন দুঃসাহস না করে: আমরা প্রস্তুত আছি।’
কিন্তু ভেনেজুয়েলা কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের হামলা বা আগ্রাসন ঠেকাতে প্রস্তুত? তাদের সামরিক সক্ষমতাই বা কতটুকু? আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো—দুজনের সিদ্ধান্তের পেছনে কী ধরনের কৌশল বা হিসাব-নিকাশ কাজ করছে?
গত কয়েক সপ্তাহ কী ঘটেছে
ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্যারিবীয় সাগরে একের পর এক নৌযানে হামলা শুরু করলে এমন উত্তেজনা শুরু হয়। খুব সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও হামলা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী এসব নৌযানকে পাচারকারীরা মাদক পাচারের কাজে ব্যবহার করছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি সপ্তাহে ২০তম হামলাটি হয়েছে। সর্বশেষ হামলায় চারজনসহ এসব হামলায় সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ জন নিহত হয়েছেন। বোমা হামলার শিকার নৌযানগুলোতে সত্যিই মাদক বা মাদক কারবারিরা ছিল কি না কিংবা নৌযানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছিল কি না, তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।
এ ছাড়া মার্কিন কর্মকর্তারা তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো ধরনের আইনি যুক্তি উপস্থাপন করেননি। বিশেষজ্ঞদের অনেকে একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।
মূলত ওয়াশিংটনের অভিযোগ হলো, মাদুরো মাদকচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেয়নি।
এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় এবং লাতিন আমেরিকার পানিসীমায় ‘ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড’ নামের বিমানবাহী রণতরি পাঠিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক এবং সবচেয়ে বড় বিমানবাহী এ রণতরিকে ঘিরে একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলা হয়েছে।
বিমানবাহী রণতরি হলো সমুদ্রে ভাসমান বিমানঘাঁটি। সেখান থেকে যুদ্ধজাহাজ উড়তে পারে, আবার সেখানেই অবতরণ করতে পারে, জ্বালানি ভরতে পারে এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারে।
ফোর্ড হলো পারমাণবিক শক্তিচালিত রণতরি। এটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ। এতে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র এবং সহায়ক জাহাজ থাকে। যেকোনো সময় প্রয়োজন হলে মোতায়েনের জন্য ৪ হাজার সেনাসদস্য এবং বেশ কিছু যুদ্ধবিমান প্রস্তুত থাকে।
ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটন সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার বিষয়ে বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুরুতে তারা যে লক্ষ্যের কথা বলেছিল, তা এখন আরও বিস্তৃত হয়েছে। মোতায়েন করা সেনাদের সক্ষমতার সঙ্গে লক্ষ্যগুলো পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক কানসিয়ান গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এ–সংক্রান্ত একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘(ট্রাম্প) প্রশাসন বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ মাদক পাচার বন্ধ করা এবং মাদকচক্রকে দুর্বল করার উদ্দেশে তারা সেনা মোতায়েন করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যগুলো মাদুরো সরকারের কর্মকাণ্ডবিরোধী লক্ষ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।’
ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্যারিবীয় সাগরে একের পর এক নৌযানে হামলা শুরু করলে এমন উত্তেজনা শুরু হয়। খুব সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও হামলা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী এ নৌযানগুলোকে মাদক পাচারকারীরা মাদক পাচারের কাজে ব্যবহার করছে।মার্ক কানসিয়ানের মতে, বিমানবাহী রণতরি ফোর্ড এই অভিযানের জন্য পুরোপুরি উপযোগী না–ও হতে পারে। মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য ফোর্ড খুব একটা উপযোগী নয়…এটি সমুদ্রপথ বা স্থলপথে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য বেশি উপযোগী।
কানসিয়ান আরও বলেন, অনির্দিষ্টকাল ধরে ফোর্ডকে মোতায়েন রাখা সম্ভব নয়। এটি একটি শক্তিশালী সামরিক সম্পদ হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এর উপস্থিতির চাহিদা রয়েছে। একসময় না একসময় এটিকে দেশে ফিরে যেতে হবে। এটি ব্যবহার করা হবে, নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে, সেটি সাউদার্ন কমান্ডকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাউদার্ন কমান্ড ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা সহযোগিতা দেয় ও অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
ভেনেজুয়েলা কি হামলার জন্য প্রস্তুত
গত মঙ্গলবার ভেনেজুয়েলার সরকার বলেছে, তারা যেকোনো ধরনের সম্ভাব্য মার্কিন পদক্ষেপ মোকাবিলায় সেনা ও সাধারণ মানুষদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।
ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ তাঁদের ‘ইনডিপেনডেন্স প্ল্যান ২০০’-এর একটি ‘উচ্চতর ধাপ’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরক্ষাশক্তি জোরদার করতে এ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ভেনেজুয়েলা।
পাদ্রিনো বলেন, এই মহড়ার জন্য প্রায় ২ লাখ সেনাকে দেশের সব জায়গায় মোতায়েন করা হয়েছে।
এই মহড়া গত মঙ্গলবার শুরু হয়ে বুধবার শেষ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
পাদ্রিনো লোপেজ জোর দিয়ে আরও বলেন, দেশের সামরিক বাহিনী ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ভেনেজুয়েলাবিরোধী যেকোনো ধরনের আগ্রাসনকে প্রত্যাখ্যান করে। আর বিরোধী গোষ্ঠীকে ‘সংখ্যালঘু, বিদ্রোহী এবং ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, তাঁরা জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে আর নেই।
ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো (ডানে) কারাকাসে সামরিক মহড়া চলার সময় ক্ষেপণাস্ত্র হাতে অনুশীলনকারী এক সেনাসদস্যকে পর্যবেক্ষণ করছেন.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ব ম নব হ প রস ত ত উপস থ ত লক ষ য র জন য ধরন র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
লাতিন আমেরিকায় নতুন সামরিক অভিযানের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের
লাতিন আমেরিকায় নতুন করে সামরিক অভিযান চালাবে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার এই ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। তাঁর দাবি, লাতিন আমেরিকা থেকে তৎপরতা চালানো ‘মাদক-সন্ত্রাসীদের’ নির্মূল করতে ওয়াশিংটন নতুন অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার জলসীমায় সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিছু সামরিক অভিযানও চালিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলটিতে স্থলপথে হামলা চালাতে পারে ও এটা হলে সংঘাতের বিস্তৃতি বাড়বে এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই নতুন অভিযানের ঘোষণা দিল ওয়াশিংটন।
পিট হেগসেথ এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ আমি অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ারের ঘোষণা দিচ্ছি। এ অভিযান আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করবে, আমাদের সীমানা থেকে মাদক-সন্ত্রাসীদের নির্মূল করবে। যেসব মাদক আমাদের মানুষকে মেরে ফেলছে, সেসবের প্রবেশও রোধ করবে।’
অভিযানের ঘোষণা দিলেও কবে থেকে শুরু হবে, সে বিষয়ে কিছুই জানাননি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ ছাড়া এই অভিযানের পরিসর কেমন হবে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার জলসীমায় যেসব অভিযান চালিয়েছে, সেসব থেকে এর পার্থক্য কী হবে, তা-ও জানানো হয়নি।
নতুন যে অভিযানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে জানতে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এএফপি। অবশ্য পেন্টাগনের মুখপাত্র মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দেওয়া তথ্য ছাড়া আর কিছু জানাতে রাজি হননি। তবে একাধিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিবিএস এ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ভেনেজুয়েলায় নতুন করে অভিযানের বিস্তারিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে স্থলপথে হামলা চালানোর বিষয়টি আছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এদিকে সূত্রের বরাতে রয়টার্স গতকাল শুক্রবার জানায়, ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযান কীভাবে চালানো হবে, এ নিয়ে আলোচনা করতে এই সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তিন দফায় বৈঠক করেন। হোয়াইট হাউসে হওয়া এসব বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, লাতিন আমেরিকায় অভিযান চালাতে যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি গত সপ্তাহে ওই অঞ্চলে পাঠিয়েছে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি জেরাল্ড ফোর্ড। এই রণতরিতে ৫ হাজার সেনা ও ৭৫টি যুদ্ধবিমান রয়েছে।
মাদক চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে ক্যারিবীয় সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিক থেকে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ২০টি নৌযানে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর হামলায় ৭৬ জন নিহত হয়েছেন।