Prothomalo:
2025-10-15@04:20:20 GMT

যে ইস্যুতে তালেবান ও আরএসএস এক

Published: 15th, October 2025 GMT

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নে যে চুক্তি হয়ে গেল, সেটিকে অনেকে ‘শত্রুর শত্রুই বন্ধু’ নীতির বাস্তব রূপ হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে। তাই ভারত পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও সম্প্রতি দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংযত, কিন্তু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সাধারণত যখন কোনো দেশ অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে, তখন প্রকাশ্যে অনেক ‘কূটনৈতিক ভাষা’ বা সৌজন্যমূলক ভান ব্যবহার করে, যাতে অন্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কিন্তু ভারত ও আফগান—দুই পক্ষের প্রকাশ্য বক্তব্যে সূক্ষ্ম কোনো কূটনৈতিকতার ভানও দেখা যায়নি। এটি ইসলামাবাদকে ক্ষুব্ধ করে এবং এ ঘটনার পরপরই আফগান সীমান্তে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হয়। এটিকে অনেকেই দিল্লির ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন।

আরও পড়ুনভারত–আফগানিস্তান: ‘হিন্দুবাদী’ ও ‘ইসলামি’ দুটি দেশের সম্পর্কের রসায়ন১১ জানুয়ারি ২০২৫

কিন্তু এই চুক্তি কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, সময়ের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, চুক্তিটি এমন একসময় হলো, যখন ভারতের দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। মার্ক্সবাদীরা একসময় এ ধরনের মানসিক সখ্যকে ‘তমসাচ্ছন্ন ঐক্য’ (ইউনিটি ইন অবসকিউর‍্যানটিজম) বলতেন। এ ধারণা এখন তালেবান ও আরএসএসের মতো দুই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে প্রযোজ্য।

পেছন ফিরে দেখলে মনে হবে, তালেবান–আরএসএস সখ্য আসলে তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তখন, যখন পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসক জিয়াউল হকের হাতে।

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন। তাই আজ যখন ভারত তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন সেটিকে শুধু ‘কূটনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখা ভুল হবে; বরং এটি এক ‘অদ্ভুত আত্মীয়তা’। এখানে দুই ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ একই রকম রক্ষণশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।

জিয়াউল হক ওই সময় তাঁর দেশকে বিতর্কিত ইসলামি আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক অন্ধকার যুগে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর জিয়াউল হকের সেই গণতন্ত্র হত্যাকে যিনি নৈতিক বৈধতা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরএসএসের আজীবন সদস্য অটল বিহারি বাজপেয়ী।

ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে গণতন্ত্র স্থগিত করার পর তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইর সরকার। ১৯৭৮ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ী যখন পাকিস্তান সফরে যান, তখন তিনি প্রকাশ্যে জিয়াউল সরকার ও জনতা পার্টির বন্ধুত্বের প্রশংসা করেছিলেন।

ওই জনতা পার্টিরই একটি বড় অংশ ছিল আরএসএস। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের বিভিন্ন নেতা যেখানে জিয়াউলের কাছে আবেদন করছিলেন যেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়, সেখানে বাজপেয়ী সেই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাচনে পরাজিত কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ভুট্টোর প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত জিয়াউল হক মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার দিয়েছিলেন। এটি ছিল ভারত–পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। পরবর্তী কোনো ভারতীয় সরকার সেই রকম সৌহার্দ্য দেখাতে পারেনি।

আরও পড়ুনতালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে ২৯ এপ্রিল ২০২৫

আরেক প্রসঙ্গে আসা যাক। বিদেশি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ১০ বছরব্যাপী উদ্যোগে মোদির এক সফর বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। সেটি ছিল তাঁর উজবেকিস্তান সফর। সেখানে তিনি উজবেক নেতাদের সঙ্গে হাসিমুখে মেলামেশা করেছেন। এটিকে একধরনের ঐতিহাসিক বিদ্রূপ হিসেবে ধরা হয়। কারণ, মোদি যে উজবেকিস্তানে গিয়েছিলেন হাসিমুখে, সেই উজবেকিস্তানে তৈমুর লং ও জহিরউদ্দিন বাবর জাতীয় বীর হিসেবে পূজিত হন। অথচ ভারতে এই দুই ঐতিহাসিক চরিত্রকে হিন্দুত্ববাদীরা ‘আক্রমণকারী’ ও ‘অসভ্য মুসলমান’ হিসেবে গালি দেন।

ভারতে সংঘ পরিবারের অনুসারীরা মুসলমানদের অপমান করতে ‘বাবরের আওলাদ’ বলে গালি দেন। এ ঘৃণায় আরএসএস এবং পশতু তালেবান উভয়েই যেন একমত। কারণ, দুই পক্ষই বাবর ও মোগলদের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে।

তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। পরের সম্মেলনে অবশ্য তিনি সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং বলা হয়, তখন নারী সাংবাদিকের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি ছিল।

আরও পড়ুনভারত কি পাকিস্তান–তালেবান দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে১৫ জানুয়ারি ২০২৫

কিন্তু এর মধ্যেই অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে আরও একটি তীব্র বিদ্রূপ। সেটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোনো সংবাদ সম্মেলনই আয়োজন করেননি—না নারী সাংবাদিকদের জন্য, না পুরুষদের জন্য।

তবে এটা বলার মানে এই নয় যে তালেবানদের নারীদের প্রতি বর্বর আচরণকে হালকা করে দেখা উচিত। কাবুল একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ‘ফ্যাশন রাজধানী’। সেখানে নারীরা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, আধুনিক ও সংস্কৃতিমনা। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবিত্ত নারীরা যখন পোশাকের বিধিনিষেধে জর্জরিত, তখন কাবুলের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন প্যারিসীয় ডিজাইনারদের তৈরি স্কার্ট পরে।

ভারতের সেতারশিল্পী ওস্তাদ বিলায়েত খান আফগান রাজা জহির শাহর দরবারে সেতার বাজাতেন। আবার আফগান সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ সরহাং ছিলেন ভারতীয় ঘরানা বিখ্যাত গায়ক। তিনি ফারসি কবিতা ও ভারতীয় রাগ—দুই ক্ষেত্রেই পারদর্শী ছিলেন।

আরও পড়ুনতালেবান কার ভয়ে এবং কেন রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে রাখছে২৬ আগস্ট ২০২৩

আজকের দিনে তালেবান নারীদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করে, ভারতেও ধর্মীয় শুদ্ধতাবাদীরা নারীদের প্রতি প্রায় একই রকম মনোভাব পোষণ করেন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা (যা তালেবান মতাদর্শকে অনুপ্রাণিত করেছে) এবং হিন্দুত্ববাদীরা উভয়ই ভ্যালেন্টাইনস ডে, মেয়েদের জিনস পরা, মুঠোফোন ব্যবহার বা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা—এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে প্রচারণা চালাতে পারে।

আরএসএসের প্রভাবশালী নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বিশ্বাস করতেন, আধুনিকতা নারীদের বিপথে নিচ্ছে। দ্য কারাভান পত্রিকা ২০১৭ সালে মোদির তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আরএসএস নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে গোলওয়ালকরের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, ‘একজন সচ্চরিত্র নারী তার দেহ আড়াল করে রাখে।’ তিনি আরও আফসোস করেছিলেন যে আধুনিক নারীরা মনে করেন, ‘আধুনিকতা মানে শরীর যত বেশি প্রকাশ করা যায়, তত ভালো।’ এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘কী অবনতি!’

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কোন দিকে০৮ অক্টোবর ২০২৫

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন। তাই আজ যখন ভারত তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন সেটিকে শুধু ‘কূটনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখা ভুল হবে; বরং এটি এক ‘অদ্ভুত আত্মীয়তা’। এখানে দুই ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ একই রকম রক্ষণশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।

জাভেদ নকভি ডনের দিল্লি প্রতিনিধি

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরর ষ ট রমন ত র আফগ ন স ত ন র আরএসএস র ক টন ত ক প রক শ ই রকম উজব ক

এছাড়াও পড়ুন:

যে ইস্যুতে তালেবান ও আরএসএস এক

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নে যে চুক্তি হয়ে গেল, সেটিকে অনেকে ‘শত্রুর শত্রুই বন্ধু’ নীতির বাস্তব রূপ হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে। তাই ভারত পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও সম্প্রতি দিল্লিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংযত, কিন্তু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সাধারণত যখন কোনো দেশ অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে, তখন প্রকাশ্যে অনেক ‘কূটনৈতিক ভাষা’ বা সৌজন্যমূলক ভান ব্যবহার করে, যাতে অন্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কিন্তু ভারত ও আফগান—দুই পক্ষের প্রকাশ্য বক্তব্যে সূক্ষ্ম কোনো কূটনৈতিকতার ভানও দেখা যায়নি। এটি ইসলামাবাদকে ক্ষুব্ধ করে এবং এ ঘটনার পরপরই আফগান সীমান্তে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হয়। এটিকে অনেকেই দিল্লির ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন।

আরও পড়ুনভারত–আফগানিস্তান: ‘হিন্দুবাদী’ ও ‘ইসলামি’ দুটি দেশের সম্পর্কের রসায়ন১১ জানুয়ারি ২০২৫

কিন্তু এই চুক্তি কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, সময়ের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, চুক্তিটি এমন একসময় হলো, যখন ভারতের দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। মার্ক্সবাদীরা একসময় এ ধরনের মানসিক সখ্যকে ‘তমসাচ্ছন্ন ঐক্য’ (ইউনিটি ইন অবসকিউর‍্যানটিজম) বলতেন। এ ধারণা এখন তালেবান ও আরএসএসের মতো দুই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে প্রযোজ্য।

পেছন ফিরে দেখলে মনে হবে, তালেবান–আরএসএস সখ্য আসলে তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তখন, যখন পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসক জিয়াউল হকের হাতে।

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন। তাই আজ যখন ভারত তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন সেটিকে শুধু ‘কূটনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখা ভুল হবে; বরং এটি এক ‘অদ্ভুত আত্মীয়তা’। এখানে দুই ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ একই রকম রক্ষণশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।

জিয়াউল হক ওই সময় তাঁর দেশকে বিতর্কিত ইসলামি আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক অন্ধকার যুগে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর জিয়াউল হকের সেই গণতন্ত্র হত্যাকে যিনি নৈতিক বৈধতা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরএসএসের আজীবন সদস্য অটল বিহারি বাজপেয়ী।

ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে গণতন্ত্র স্থগিত করার পর তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইর সরকার। ১৯৭৮ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ী যখন পাকিস্তান সফরে যান, তখন তিনি প্রকাশ্যে জিয়াউল সরকার ও জনতা পার্টির বন্ধুত্বের প্রশংসা করেছিলেন।

ওই জনতা পার্টিরই একটি বড় অংশ ছিল আরএসএস। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের বিভিন্ন নেতা যেখানে জিয়াউলের কাছে আবেদন করছিলেন যেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়, সেখানে বাজপেয়ী সেই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাচনে পরাজিত কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ভুট্টোর প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত জিয়াউল হক মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার দিয়েছিলেন। এটি ছিল ভারত–পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। পরবর্তী কোনো ভারতীয় সরকার সেই রকম সৌহার্দ্য দেখাতে পারেনি।

আরও পড়ুনতালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে ২৯ এপ্রিল ২০২৫

আরেক প্রসঙ্গে আসা যাক। বিদেশি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ১০ বছরব্যাপী উদ্যোগে মোদির এক সফর বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। সেটি ছিল তাঁর উজবেকিস্তান সফর। সেখানে তিনি উজবেক নেতাদের সঙ্গে হাসিমুখে মেলামেশা করেছেন। এটিকে একধরনের ঐতিহাসিক বিদ্রূপ হিসেবে ধরা হয়। কারণ, মোদি যে উজবেকিস্তানে গিয়েছিলেন হাসিমুখে, সেই উজবেকিস্তানে তৈমুর লং ও জহিরউদ্দিন বাবর জাতীয় বীর হিসেবে পূজিত হন। অথচ ভারতে এই দুই ঐতিহাসিক চরিত্রকে হিন্দুত্ববাদীরা ‘আক্রমণকারী’ ও ‘অসভ্য মুসলমান’ হিসেবে গালি দেন।

ভারতে সংঘ পরিবারের অনুসারীরা মুসলমানদের অপমান করতে ‘বাবরের আওলাদ’ বলে গালি দেন। এ ঘৃণায় আরএসএস এবং পশতু তালেবান উভয়েই যেন একমত। কারণ, দুই পক্ষই বাবর ও মোগলদের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে।

তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। পরের সম্মেলনে অবশ্য তিনি সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং বলা হয়, তখন নারী সাংবাদিকের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি ছিল।

আরও পড়ুনভারত কি পাকিস্তান–তালেবান দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে১৫ জানুয়ারি ২০২৫

কিন্তু এর মধ্যেই অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে আরও একটি তীব্র বিদ্রূপ। সেটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোনো সংবাদ সম্মেলনই আয়োজন করেননি—না নারী সাংবাদিকদের জন্য, না পুরুষদের জন্য।

তবে এটা বলার মানে এই নয় যে তালেবানদের নারীদের প্রতি বর্বর আচরণকে হালকা করে দেখা উচিত। কাবুল একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ‘ফ্যাশন রাজধানী’। সেখানে নারীরা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, আধুনিক ও সংস্কৃতিমনা। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবিত্ত নারীরা যখন পোশাকের বিধিনিষেধে জর্জরিত, তখন কাবুলের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন প্যারিসীয় ডিজাইনারদের তৈরি স্কার্ট পরে।

ভারতের সেতারশিল্পী ওস্তাদ বিলায়েত খান আফগান রাজা জহির শাহর দরবারে সেতার বাজাতেন। আবার আফগান সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ সরহাং ছিলেন ভারতীয় ঘরানা বিখ্যাত গায়ক। তিনি ফারসি কবিতা ও ভারতীয় রাগ—দুই ক্ষেত্রেই পারদর্শী ছিলেন।

আরও পড়ুনতালেবান কার ভয়ে এবং কেন রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে রাখছে২৬ আগস্ট ২০২৩

আজকের দিনে তালেবান নারীদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করে, ভারতেও ধর্মীয় শুদ্ধতাবাদীরা নারীদের প্রতি প্রায় একই রকম মনোভাব পোষণ করেন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা (যা তালেবান মতাদর্শকে অনুপ্রাণিত করেছে) এবং হিন্দুত্ববাদীরা উভয়ই ভ্যালেন্টাইনস ডে, মেয়েদের জিনস পরা, মুঠোফোন ব্যবহার বা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা—এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে প্রচারণা চালাতে পারে।

আরএসএসের প্রভাবশালী নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বিশ্বাস করতেন, আধুনিকতা নারীদের বিপথে নিচ্ছে। দ্য কারাভান পত্রিকা ২০১৭ সালে মোদির তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আরএসএস নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে গোলওয়ালকরের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, ‘একজন সচ্চরিত্র নারী তার দেহ আড়াল করে রাখে।’ তিনি আরও আফসোস করেছিলেন যে আধুনিক নারীরা মনে করেন, ‘আধুনিকতা মানে শরীর যত বেশি প্রকাশ করা যায়, তত ভালো।’ এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘কী অবনতি!’

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কোন দিকে০৮ অক্টোবর ২০২৫

তালেবান বা আরএসএস—দুই পক্ষই নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য যতটা বাহ্যিক, অন্তরে তারা ততটাই অভিন্ন। তাই আজ যখন ভারত তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, তখন সেটিকে শুধু ‘কূটনৈতিক কৌশল’ হিসেবে দেখা ভুল হবে; বরং এটি এক ‘অদ্ভুত আত্মীয়তা’। এখানে দুই ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ একই রকম রক্ষণশীলতার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।

জাভেদ নকভি ডনের দিল্লি প্রতিনিধি

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ