‘বেরাদারান-ই-মিল্লাত’ বলার পরপরই দুই গুলিতে মঞ্চে ঢলে পড়লেন লিয়াকত আলী খান
Published: 16th, October 2025 GMT
গত সপ্তাহান্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষে দুই পক্ষের প্রায় ২৫০ জন নিহত হন। সীমান্তে এই সংঘর্ষ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যদিও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই বৈরীভাব নতুন নয়। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ভরা জনসমাবেশে, এক লাখ মানুষের সামনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এক আফগান।
দিনটি ছিল ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে চার বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে পাকিস্তান। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি জনসভায় ভাষণ দেবেন, জনগণের সামনে নিজের দেশ পরিচালনা নীতির ব্যাখ্যা দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে সারা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ রাওয়ালপিন্ডি আসছিলেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (রাওয়ালপিন্ডি) ওই জনসমাবেশের আয়োজন করেছিল।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন, তা জানতে যেমন সেদিন দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তেমনি লিয়াকত আলী নিজেও জনগণকে বিস্ময় উপহার দিতে চেয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি রওনা হওয়ার আগে স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এটা হবে একটি নীতিনির্ধারণী ভাষণ।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে লিয়াকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশটির জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডান হাত বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না।
তারপরও কেন লিয়াকত আলী খানকে খুন হতে হলো, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।
লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ড ঘিরে সে সময় সবচেয়ে বেশি রহস্যময় আচরণ করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ঠিক কী কারণে, কার ইশারায় জনপ্রিয় এই প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে খুন হতে হলো, তা খুঁজে বের করা নিয়ে তাদের মধ্যে ‘অনীহা’ দেখা গিয়েছিল।
দেশে-বিদেশে অনেক সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক এ রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করছেন। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হত্যা রহস্যের কিনারা কেউ করতে পারেনি।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।যেদিন খুন হন
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
বিকেল চারটার দিকে সমাবেশস্থলে আসেন প্রধানমন্ত্রী। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চে বক্তৃতা দিতে ওঠেন তিনি।
সেদিনের সেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল লিয়াকত আলীর ব্যক্তিগত নির্দেশে। তিনি আয়োজকদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, তিনি যখন ভাষণ দেবেন, তখন মঞ্চে তাঁর পাশে আর কেউ থাকবে না। মঞ্চে তিনি একা থাকবেন এবং মঞ্চের ওপর কোনো শামিয়ানা থাকবে না।
সারা দেশ থেকে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীর পাঠানো চিঠির জেরে লিয়াকত আলী এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন। চিঠিতে সবাই অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে নিজ চোখে ভালো করে দেখতে চান।
তাই মঞ্চের ওপর রাখা হয়েছিল একটি মাইক্রোফোন, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। মঞ্চের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে চার ফুট।
কে জানতে, এভাবে অনুসারীদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে লিয়াকত আলী খুনির সহজ নিশানায় পরিণত হবেন। মঞ্চে উঠে সবে তিনি বলেছেন ‘বেরাদারান-ই-মিল্লাত’.
তখনই পরপর দুটি গুলির শব্দ, উপস্থিত জনতা দেখলেন মঞ্চের ওপর ঢলে পড়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। সে নীরবতা ভাঙে তৃতীয় গুলির শব্দে।
লোকজন ছুটতে শুরু করেন, সবার মুখে এক কথা, ‘কায়েদ-ই-মিল্লাত মারা গায়া’ (প্রধানমন্ত্রী মারা গেছেন)।
হামলাকারীর ছোড়া একটি গুলি লিয়াকত আলীর বুকের বাঁ পাশে লাগে। তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়, করা হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তখন লিয়াকত আলীর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর কোম্পানিবাগের নাম বদলে রাখা হয় লিয়াকত গার্ডেন। লিয়াকত আলী খুন হওয়ার ঠিক ৫৬ বছর পর ২০০৭ সালে এই লিয়াকত গার্ডেনেই গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।
লিয়াকত আলীর আফগান খুনি
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়া নিয়ে ভারতীয় লেখক এম এস ভেঙ্কটারমনি তাঁর বই ‘দ্য আমেরিকান রোল ইন পাকিস্তান’–এ লেখেন, লিয়াকত আলী খানের খুনির ছোড়া একটিমাত্র বুলেট দেশটির রাজনীতির পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হয়।
লিয়াকত হত্যাকাণ্ডের পরপরই পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সাঈদ আকবর বাবরাক নামে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর খুনি বলে ঘোষণা করেন। শুরুতে সংশয় থাকলেও পর তাঁরা বলেন, সাঈদ আফগানিস্তানের নাগরিক।
কিন্তু আফগান সরকার পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ওই দাবি অস্বীকার করে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সাঈদের আফগান নাগরিকত্ব আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
সাঈদ ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকেরা সাঈদকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া) আশ্রয় দেন। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী হিসেবে সাঈদকে ভাতা দেওয়া হচ্ছিল।
ঘটনাস্থলেই কেন হত্যা করা হয় হামলাকারীকে
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মঞ্চের ঠিক উল্টো দিকে দর্শক আসনের একেবারে সামনের সারি থেকে গুলি চালিয়েছিলেন সাঈদ। দর্শক আসনের ওই সারি রাখা ছিল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জন্য। একজন সাধারণ মানুষ হয়ে সাঈদ সেখানে কীভাবে পৌঁছালেন?
সাঈদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার পরপর আশপাশের লোকজন তাঁর ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়। হাজারো আঘাতের সঙ্গে সাঈদের মৃতদেহে তিনটি গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ভিড়ের মধ্যে কে সাঈদকে গুলি করে?
পরে সেখানে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তাঁর ছোড়া অন্তত একটি গুলি সাঈদের গায়ে লেগেছে। একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি খুনিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন।
তাঁদের কেউই লিয়াকত আলী খানকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি আমি তাঁদের কারও মুখ থেকে সমবেদনা বা দুঃখ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে শুনিনি।..আইয়ুব খানঘটনাস্থলে হামলাকারীর মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্য জটিল করে তোলে
সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলা হয়, গণপিটুনি থেকে বাঁচিয়ে সাঈদকে জীবিত আটকের সুযোগ পুলিশের হাতে ছিল। সাঈদের মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্যকে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। প্রশ্ন ওঠে, সাঈদকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার পর মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও কি ঘটনাস্থলে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়?
হত্যার পর সাঈদের পকেটে প্রায় ২ হাজার রুপি পাওয়া যায়। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে পাওয়া যায় আরও ১০ হাজার রুপি। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। সাঈদের কাছে এত রুপি পাওয়ায় কেউ কেউ ধরে নেন, তিনি ভাড়াটে খুনি ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে খুন করতেই তাঁকে ভাড়া করা হয় এবং মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও ঘটনাস্থলে হত্যার বন্দোবস্ত করেন চক্রান্তকারীরা।
যদিও এমন ধারণার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
লিয়াকত আলী খানউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত হত য র স ঈদ র কর ছ ল হয় ছ ল হওয় র আফগ ন রহস য স ঈদক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
‘বেরাদারান-ই-মিল্লাত’ বলার পরপরই দুই গুলিতে মঞ্চে ঢলে পড়লেন লিয়াকত আলী খান
গত সপ্তাহান্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষে দুই পক্ষের প্রায় ২৫০ জন নিহত হন। সীমান্তে এই সংঘর্ষ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যদিও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই বৈরীভাব নতুন নয়। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ভরা জনসমাবেশে, এক লাখ মানুষের সামনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এক আফগান।
দিনটি ছিল ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে চার বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে পাকিস্তান। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি জনসভায় ভাষণ দেবেন, জনগণের সামনে নিজের দেশ পরিচালনা নীতির ব্যাখ্যা দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে সারা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ রাওয়ালপিন্ডি আসছিলেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (রাওয়ালপিন্ডি) ওই জনসমাবেশের আয়োজন করেছিল।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন, তা জানতে যেমন সেদিন দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তেমনি লিয়াকত আলী নিজেও জনগণকে বিস্ময় উপহার দিতে চেয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি রওনা হওয়ার আগে স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এটা হবে একটি নীতিনির্ধারণী ভাষণ।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে লিয়াকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশটির জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডান হাত বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না।
তারপরও কেন লিয়াকত আলী খানকে খুন হতে হলো, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।
লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ড ঘিরে সে সময় সবচেয়ে বেশি রহস্যময় আচরণ করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ঠিক কী কারণে, কার ইশারায় জনপ্রিয় এই প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে খুন হতে হলো, তা খুঁজে বের করা নিয়ে তাদের মধ্যে ‘অনীহা’ দেখা গিয়েছিল।
দেশে-বিদেশে অনেক সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক এ রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করছেন। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হত্যা রহস্যের কিনারা কেউ করতে পারেনি।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।যেদিন খুন হন
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সকাল থেকে জনারণ্য। বিকেলে সেখানে বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে কোম্পানিবাগে প্রায় এক লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
বিকেল চারটার দিকে সমাবেশস্থলে আসেন প্রধানমন্ত্রী। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চে বক্তৃতা দিতে ওঠেন তিনি।
সেদিনের সেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল লিয়াকত আলীর ব্যক্তিগত নির্দেশে। তিনি আয়োজকদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, তিনি যখন ভাষণ দেবেন, তখন মঞ্চে তাঁর পাশে আর কেউ থাকবে না। মঞ্চে তিনি একা থাকবেন এবং মঞ্চের ওপর কোনো শামিয়ানা থাকবে না।
সারা দেশ থেকে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীর পাঠানো চিঠির জেরে লিয়াকত আলী এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন। চিঠিতে সবাই অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে নিজ চোখে ভালো করে দেখতে চান।
তাই মঞ্চের ওপর রাখা হয়েছিল একটি মাইক্রোফোন, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। মঞ্চের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে চার ফুট।
কে জানতে, এভাবে অনুসারীদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে লিয়াকত আলী খুনির সহজ নিশানায় পরিণত হবেন। মঞ্চে উঠে সবে তিনি বলেছেন ‘বেরাদারান-ই-মিল্লাত’...।
তখনই পরপর দুটি গুলির শব্দ, উপস্থিত জনতা দেখলেন মঞ্চের ওপর ঢলে পড়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। সে নীরবতা ভাঙে তৃতীয় গুলির শব্দে।
লোকজন ছুটতে শুরু করেন, সবার মুখে এক কথা, ‘কায়েদ-ই-মিল্লাত মারা গায়া’ (প্রধানমন্ত্রী মারা গেছেন)।
হামলাকারীর ছোড়া একটি গুলি লিয়াকত আলীর বুকের বাঁ পাশে লাগে। তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়, করা হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তখন লিয়াকত আলীর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর কোম্পানিবাগের নাম বদলে রাখা হয় লিয়াকত গার্ডেন। লিয়াকত আলী খুন হওয়ার ঠিক ৫৬ বছর পর ২০০৭ সালে এই লিয়াকত গার্ডেনেই গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।
লিয়াকত আলীর আফগান খুনি
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়া নিয়ে ভারতীয় লেখক এম এস ভেঙ্কটারমনি তাঁর বই ‘দ্য আমেরিকান রোল ইন পাকিস্তান’–এ লেখেন, লিয়াকত আলী খানের খুনির ছোড়া একটিমাত্র বুলেট দেশটির রাজনীতির পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হয়।
লিয়াকত হত্যাকাণ্ডের পরপরই পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সাঈদ আকবর বাবরাক নামে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর খুনি বলে ঘোষণা করেন। শুরুতে সংশয় থাকলেও পর তাঁরা বলেন, সাঈদ আফগানিস্তানের নাগরিক।
কিন্তু আফগান সরকার পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ওই দাবি অস্বীকার করে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সাঈদের আফগান নাগরিকত্ব আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
সাঈদ ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকেরা সাঈদকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া) আশ্রয় দেন। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী হিসেবে সাঈদকে ভাতা দেওয়া হচ্ছিল।
ঘটনাস্থলেই কেন হত্যা করা হয় হামলাকারীকে
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মঞ্চের ঠিক উল্টো দিকে দর্শক আসনের একেবারে সামনের সারি থেকে গুলি চালিয়েছিলেন সাঈদ। দর্শক আসনের ওই সারি রাখা ছিল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জন্য। একজন সাধারণ মানুষ হয়ে সাঈদ সেখানে কীভাবে পৌঁছালেন?
সাঈদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার পরপর আশপাশের লোকজন তাঁর ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়। হাজারো আঘাতের সঙ্গে সাঈদের মৃতদেহে তিনটি গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ভিড়ের মধ্যে কে সাঈদকে গুলি করে?
পরে সেখানে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তাঁর ছোড়া অন্তত একটি গুলি সাঈদের গায়ে লেগেছে। একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি খুনিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন।
তাঁদের কেউই লিয়াকত আলী খানকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি আমি তাঁদের কারও মুখ থেকে সমবেদনা বা দুঃখ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে শুনিনি।..আইয়ুব খানঘটনাস্থলে হামলাকারীর মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্য জটিল করে তোলে
সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলা হয়, গণপিটুনি থেকে বাঁচিয়ে সাঈদকে জীবিত আটকের সুযোগ পুলিশের হাতে ছিল। সাঈদের মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্যকে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। প্রশ্ন ওঠে, সাঈদকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার পর মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও কি ঘটনাস্থলে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়?
হত্যার পর সাঈদের পকেটে প্রায় ২ হাজার রুপি পাওয়া যায়। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে পাওয়া যায় আরও ১০ হাজার রুপি। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। সাঈদের কাছে এত রুপি পাওয়ায় কেউ কেউ ধরে নেন, তিনি ভাড়াটে খুনি ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীকে খুন করতেই তাঁকে ভাড়া করা হয় এবং মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও ঘটনাস্থলে হত্যার বন্দোবস্ত করেন চক্রান্তকারীরা।
যদিও এমন ধারণার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
লিয়াকত আলী খান