সচিবালয়ের ৫৮৯ সিসি ক্যামেরাই ‘অন্ধ’
Published: 14th, January 2025 GMT
প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে গতিবিধি পর্যবেক্ষণে বসানো আছে ৬২৪ সিসি ক্যামেরা। পিলে চমকানো তথ্য হলো, এসব ক্যামেরার কেবল ৩৫টি এখন সচল। ৯৫টি অর্ধ-বিকল, বাদবাকি ৪৯৪টি পুরোপুরি অচল। সচিবালয়ের তিন ফটকে আছে চারটি ব্যাগেজ স্ক্যানার। এর সবটিই নষ্ট। এ ছাড়া ছয়টি আর্চওয়ের কোনোটাই কাজ করে না; সবই ‘মৃত’। খোদ সরকারি প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এমন ভয়ংকর ‘বিকল কাহিনি’। এসব নষ্ট সরঞ্জামের তালিকা সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ প্রতিবেদনে তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
গেল ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। সরকারি ছুটির দিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এখনও জনমনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। পাশাপাশি নানা কারণে সচিবালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি করেছে সরকার। এমন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সচিবালয়ের নিরাপত্তার দুর্দশার চিত্র সামনে এলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে বিভিন্ন ক্যাটেগরির ৭৪টি ক্যামেরাসহ আরও কিছু সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে এতে চার প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানই শর্ত পূরণ করতে না পারায় মূল্যায়ন কমিটি কাউকে যোগ্য মনে করেনি। ফলে গত ১৯ মে বাতিল হয়ে যায় সেই দরপত্র।
ওই সময় ফের দরপত্র আহ্বান ও নিরাপত্তা যন্ত্রপাতির হালনাগাদ চাহিদা সরেজমিন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের নিরাপত্তা শাখার উপসচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। এ কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে গত ১৫ ডিসেম্বর প্রতিবেদনটি জমা দেয়। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে সম্প্রতি এসব সরঞ্জাম কেনার জন্য সংশোধিত বাজেটে বাড়তি সাড়ে ১২ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে এখনও অর্থ ছাড় করা হয়নি।
জানা যায়, করোনা মহামারির পর সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন কয়েক দফায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল। লাগানো হয় ৭৪টি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা। ৫টি গেটের ক্যামেরা ছিল প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত, যা কেনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে। এসব ক্যামেরা নাইট ও ডে ভিশন। ফলে রাতের অন্ধকারেও মানুষ চেনা যায়। এ ছাড়া নতুন করে ৪টি ব্যাগেজ স্ক্যানার বসানোর কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অথচ ২০২২ সালে একটি ব্যাগেজ স্ক্যানার জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো সচিবালয়ের ৪টি গেটে গাড়ি স্ক্যানার স্থাপন করা হয়েছিল। এসব স্ক্যানারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা। এত কম সময়ের ব্যবধানে এসব সরঞ্জাম কেন বিকল হলো– তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তার যন্ত্রপাতি কেনার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেওয়া উচিত। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানি থেকে সর্বশেষ প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা ও ব্যাগেজ স্ক্যানার আনা হলে এত দ্রুত তা নষ্ট হতে পারে না। তাই নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কেনার আগে পুরোনো যন্ত্রপাতি যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন, কেন এত তাড়াতাড়ি বিকল হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ মাহমুদ উল্লা সমকালকে বলেন, ইনফ্রারেড ক্যামেরা মানুষের তাপমাত্রা থেকে ধরতে পারে। অন্ধকারের মধ্যেও মানুষকে চেনা যায়। একটা বিড়াল গেলেও দেখা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে প্রায়ই এ ক্যামেরা ব্যবহার হয়। এই ক্যামেরা ইমেজ ও ভিডিও নিতে পারে। এমন ক্যামেরা আমেরিকা, চীন থেকে আনা হলে অবশ্যই এসব কাজ করার কথা। এত অল্প সময়ে নষ্ট হতে পারে না।
সিসি ক্যামেরার হাল
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে তিনটি কোম্পানির মোট ৬২৪টি ক্যামেরা সচিবালয়ের বিভিন্ন স্থানে বসানো আছে। এর মধ্যে সাইনেস্ট ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের ৪২০টি, ট্রেসার ইলেকট্রোকমসের ১৮৮টি ও মেরিটস টেকনোলজি লিমিটেডের ১৬টি ক্যামেরা রয়েছে। তবে ৬২৪টি ক্যামেরার মধ্যে বর্তমানে ৩৫টি ক্যামেরা যথাযথভাবে মনিটরে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। ৯৫টি সচল ক্যামেরা মনিটরে দেখা যায়, তবে এগুলো নেগেটিভ ভিউ হওয়ায় যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। বাকি ৪৯৪টি পুরোপুরি নষ্ট।
কমিটির পর্যবেক্ষণে বলেছে, নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে সচিবালয়ের পাঁচটি প্রবেশ গেট ও সীমানা প্রাচীর। তবে বর্তমানে বসানো ক্যামেরার মধ্যে অধিকাংশই অচল থাকায় পর্যবেক্ষণে সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া উন্নত প্রযুক্তির যুগে অ্যাডভান্স টেকনোলজি সংবলিত নতুন ক্যামেরা রয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ক্যামেরাগুলো ফেস ডিটেকশনের মাধ্যমে দুষ্কৃতকারীদের শনাক্ত করতে পারে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা চিহ্নিত করতে পারে; যা সচিবালয়ের পাঁচটি গেট ও সীমানা প্রাচীরের জন্য প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত সিসি ক্যামেরা
সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। যাতে ক্যামেরা সচিবালয়ের পাঁচটি গেটে ও সীমানাপ্রাচীর-সংলগ্ন সব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সচিবালয়ের পাঁচটি গেট এবং সব ভবন পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার জন্য প্রস্তাবিত ৭৪টি ক্যামেরা কেনা যেতে পারে। এর মধ্যে সচিবালয়ের গেট ও বিভিন্ন ভবনের প্রবেশদ্বারে ৪৩ ফেস ডিটেকশন ক্যামেরা, সীমানা প্রাচীরে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য ২০টি বুলেট ক্যামেরা এবং বিভিন্ন ভবন ও আঙিনার ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পর্যবেক্ষণের জন্য চারটি পিটিজেড ক্যামেরা বসানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে দরকার সাতটি ডম ফেস রিকগনাইজেশন ক্যামেরা।
ব্যাগেজ স্ক্যানার ও আর্চওয়ে সব অচল
বর্তমানে সচিবালয়ের পাঁচটি গেটের মধ্যে তিনটি গেটে মোট চারটি ব্যাগেজ স্ক্যানার রয়েছে। তবে সব স্ক্যানার অচল। কমিটির পর্যবেক্ষণে বলেছে, সচিবালয়ের ২ নম্বর গেটের মাধ্যমে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবেশ করে। তাই এ গেটে একটি ব্যাগেজ স্ক্যানার বসানো প্রয়োজন। তাছাড়া সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটে (দর্শনার্থী প্রবেশ গেট) দুটি এবং ৫ নম্বর গেটে একটি ব্যাগেজ স্ক্যানার বসানো যেতে পারে। এ ছাড়া সচিবালয়ের নিরাপত্তায় বসানো ছয়টি আর্চওয়ের মধ্যে সবগুলোই এখন অচল। এ কারণে ছয়টি আধুনিক স্মার্ট আর্চওয়ে কেনা যেতে পারে।
লাগবে ভিডিও ডিসপ্লে
সচিবালয়ের নিরাপত্তা কন্ট্রোল রুমে ২৭টি মনিটর রয়েছে, এর একটি অচল। নিরাপত্তার জন্য বসানো ক্যামেরা যথাযথ পর্যবেক্ষণের জন্য আরও ১০টি মনিটর কেনা যেতে পারে। এ ছাড়া নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ৫০টি ওয়্যারলেস সেট কেনা প্রয়োজন।
সচিবালয়ের সোমবারের চিত্র
গতকাল সচিবালয়ের এক নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশের সময় প্রতিবেদক দেখতে পান, দর্শনার্থী প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যেসব সংবাদকর্মী ও দর্শনার্থীর তালিকা গেটে দেওয়া আছে, শুধু তাদেরই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। গেটে ব্যাগেজ স্ক্যানার ও আর্চওয়ের ব্যবহার দেখা যায়নি।
কারা কী বলছেন
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, শুধু সচিবালয় নয়, দেশের অনেক জায়গায় নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব রয়েছে। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্রের নাজুক পরিস্থিতি সেটাই আবার প্রমাণ করল। এটা দুঃখজনক। শুধু সচিবালয় নয়, প্রতিটি সরকারি অফিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের পরিকল্পনায় নিরাপত্তার বিষয়টির অভাব রয়েছে। তার পরও ভালো দিক হচ্ছে, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করেছে। তবে শুধু পর্যালোচনা করলেই হবে না। যেসব দুর্বলতা উঠে এসেছে, তা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন সমকালকে বলেন, সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কী কারণে এতদিন সেটা হয়নি, তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি আগামীতে তা নিশ্চিত হওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড.
জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) আতাউর রহমান সমকালকে বলেন, উপসচিবকে দিয়ে যে প্রতিবেদন করা হয়েছে, এটা একটা ক্লু মাত্র। এর ওপর অনেক কাজ করা হবে। বুয়েটের শিক্ষক, পুলিশসহ যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাদের দিয়ে যাচাই-বাছাই করব। উপসচিবের কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কি অর্থ বিভাগে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থ বিভাগ এমন নয় যে, টাকা চাইলেই দিয়ে দেবে। খরচ করতে পারলেই শুধু টাকা পাওয়া যাবে। আতাউর রহমান বলেন, যেসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, শুধু সেগুলোই কেনা হবে। বুয়েটের টেকনিক্যাল লোক দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে। যেগুলো অল্পদিন আগে কেনা, মেয়াদ থাকার পরও নষ্ট হয়েছে, সেগুলো স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কেনা হয়েছিল কিনা, দেখা হবে। কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে কিনা, সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।