বইমেলা: যে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে
Published: 19th, January 2025 GMT
অমর একুশে বইমেলা দেশের অন্যতম বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব, বাঙালির প্রাণের ঐতিহ্যবাহী মেলা। এটি পাঠক-লেখক এবং প্রকাশকের বৃহত্তম মিলনমেলা। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ এবং প্রজন্মের চিন্তা চেতনার প্রেক্ষাপটে অমর একুশে বইমেলার জনপ্রিয়তা এবং আবেদন অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
১. বইমেলার আয়োজনে পর্যাপ্ত জায়গা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রকৃত প্রকাশকদের প্রয়োজনমতো জায়গা বরাদ্দ এবং নান্দনিক প্যাভিলিয়ন বা স্টল নির্মাণ নিশ্চিত করা। প্রতিবছর ন্যূনতম পাঁচজন একেবারে নতুন মেধাবী প্রকাশককে বিনামূল্যে এক ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেওয়া। পাইরেট বইয়ের প্রকাশকদের স্টল বাতিল করা।
২.
৩. বইমেলা কর্তৃপক্ষ পাঠকদের জন্য অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ওয়েবসাইট, অ্যাপ সুবিধা রাখতে পারে। যেখানে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থাসমূহের বইয়ের ডিজিটাল ক্যাটালগ, প্রতিদিনের প্রকাশিত বইয়ের আপডেটসহ যাবতীয় অন্যান্য তথা দেওয়া যেতে পারে।
৪. শিক্ষার্থী পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ ডিসকাউন্ট এবং বইপড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান কার্যক্রম চালু করা।
৫. শিশুকর্ণারকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সাজাতে হবে। শিশুদের জন্য খুব ভালো মানের বইয়ের পাশাপাশি শিশু কর্ণারে বিচিত্র রকম শিক্ষামূলক একটিভিটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে পুরস্কারও দেওয়া যেতে পারে।
৬. লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের সমন্বয়ে প্রতিদিন সরাসরি আলোচনা পর্ব এবং প্রতি পর্বের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার ওয়েবসাইটে প্রকাশ।
৭. নতুন বইয়ের মোড়ক, পাঠ উন্মোচন, সাহিত্য আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বইমেলার পুরো সময় উৎসবমুখর রাখা।
৮. নতুন মেধাবী প্রকাশকদের জন্য প্রকাশনা সংক্রান্ত কর্মশালার আয়োজন।
৯. শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখি, গল্পবলা, চিত্রকলা কর্মশালা আয়োজন।
১০. বইমেলার একটি ভার্চুয়াল সংস্করণ চালু করা যেতে পারে। ১১. গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টসমূহ সরাসরি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
১২. ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের মতামত সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে পরবর্তী বছরের মেলার পরিকল্পনা করা।
১৩. বইমেলার খবর, বইয়ের খবর টিভি, রেডিও এবং স্যোশাল মিডিয়ায় মাসব্যাপী বিশেষভাবে সরব রাখা, মেলার বিশেষ দিক নিয়ে ভিডিও ও পডকাস্ট সিরিজ চালু করা।
১৪. মেলা কমিটির পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মেলা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া। বইপড়া প্রতিযোগিতা, রচনা লেখা প্রতিযোগিতা, গল্প বলা, আবৃত্তি প্রভৃতি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।
১৫. মেলায় অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশনাকে প্রাধান্য দেওয়া। বইয়ের আন্তর্জাতিক রাইট বিক্রয়ের লক্ষে আন্তর্জাতিক রাইট এজেন্সিসমূহকে বইমেলায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। আমি মনে করি, অমর একুশে বইমেলা কমিটি এসব উদ্যোগ এবং আরও অভিজ্ঞজনের মতামত নিয়ে বইমেলাকে আরও জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও পাঠকবান্ধব করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশে অমর একুশে বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিডিয়া বইমেলার সকল দিক জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারে এবং পাঠকদের বই পড়ায় ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে পারে। অমর একুশে বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা নিম্নরূপ হতে পারে:
সময়োচিত খবর: মিডিয়াকে বইমেলার সমস্ত খবর সঠিক সময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এতে বইমেলার সর্বশেষ আপডেট, নতুন বই, বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখকদের সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বইমেলার সব কর্মকাণ্ড এবং আপডেট আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
ভিডিও কন্টেন্ট: বইমেলা থেকে লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং, ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি তৈরি করে এবং তা মিডিয়ায় প্রচার করে বইমেলার পরিবেশ উৎসবমুখর করে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে।
পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ: নতুন বই, প্রকাশক, লেখকদের বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন মিডিয়ায় প্রকাশ করা যেতে পারে। এটি পাঠকদের জন্য বই নির্বাচনে সহায়তা করবে।
বিতর্ক ও আলোচনা: বইমেলার বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এ সকল অনুষ্ঠানের বিস্তারিত মিডিয়ার মাধ্যমে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করে বইমেলা সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে ।
পাঠকদের অভিমত: পাঠকদের অভিমত জানার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোল, সার্ভে ইত্যাদি চালানো যেতে পারে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা তাৎক্ষণিক প্রচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বইমেলার ইতিহাস: বইমেলার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে পাঠকদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং বইমেলার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা চমৎকারভাবে করা গেলে বইমেলার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। মানুষ বই পড়ায় উৎসাহিত হবে, বইয়ের পাঠক নিঃসন্দেহে অনেক বাড়বে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখক দ্রুত পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। প্রকাশকদের বই বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পের সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। অর্থাৎ আধুনিক ও কার্যকর মিডিয়া ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে মেধাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণের পাশাপাশি পেশাদার প্রকাশকদের নেতৃত্বে প্রকাশিত শিল্প দ্রুত গতিতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
লেখক: বিশেষজ্ঞ প্রকাশক, চেয়ারম্যান, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবস থ দ র জন য জনপ র বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।