অমর একুশে বইমেলা দেশের অন্যতম বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব, বাঙালির প্রাণের ঐতিহ্যবাহী মেলা। এটি পাঠক-লেখক এবং প্রকাশকের বৃহত্তম মিলনমেলা। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ এবং প্রজন্মের চিন্তা চেতনার প্রেক্ষাপটে অমর একুশে বইমেলার জনপ্রিয়তা এবং আবেদন অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

১. বইমেলার আয়োজনে পর্যাপ্ত জায়গা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রকৃত প্রকাশকদের প্রয়োজনমতো জায়গা বরাদ্দ এবং নান্দনিক প্যাভিলিয়ন বা স্টল নির্মাণ নিশ্চিত করা। প্রতিবছর ন্যূনতম পাঁচজন একেবারে নতুন মেধাবী প্রকাশককে বিনামূল্যে এক ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেওয়া। পাইরেট বইয়ের প্রকাশকদের স্টল বাতিল করা।
২.

মেলায় যাতায়াত সহজ করতে মাসব্যাপী বিশেষ মেট্রোরেল সুবিধা চালু করা। গুরুত্বপূর্ণ লেখক, গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের বিজ্ঞাপন মেট্রোরেলে প্রচারের ব্যবস্থা করা। অডিও-ভিডিও প্রচারণার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। 
৩. বইমেলা কর্তৃপক্ষ পাঠকদের জন্য অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ওয়েবসাইট, অ্যাপ সুবিধা রাখতে পারে। যেখানে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থাসমূহের বইয়ের ডিজিটাল ক্যাটালগ, প্রতিদিনের প্রকাশিত বইয়ের আপডেটসহ যাবতীয় অন্যান্য তথা দেওয়া যেতে পারে। 
৪. শিক্ষার্থী পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ ডিসকাউন্ট এবং বইপড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান কার্যক্রম চালু করা। 

৫. শিশুকর্ণারকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সাজাতে হবে। শিশুদের জন্য খুব ভালো মানের বইয়ের পাশাপাশি শিশু কর্ণারে বিচিত্র রকম শিক্ষামূলক একটিভিটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে পুরস্কারও দেওয়া যেতে পারে। 
৬. লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের সমন্বয়ে প্রতিদিন সরাসরি আলোচনা পর্ব এবং প্রতি পর্বের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার ওয়েবসাইটে প্রকাশ। 
৭. নতুন বইয়ের মোড়ক, পাঠ উন্মোচন, সাহিত্য আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বইমেলার পুরো সময় উৎসবমুখর রাখা। 
৮. নতুন মেধাবী প্রকাশকদের জন্য প্রকাশনা সংক্রান্ত কর্মশালার আয়োজন। 
৯. শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখি, গল্পবলা, চিত্রকলা কর্মশালা আয়োজন। 
১০. বইমেলার একটি ভার্চুয়াল সংস্করণ চালু করা যেতে পারে। ১১. গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টসমূহ সরাসরি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা। 

১২. ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের মতামত সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে পরবর্তী বছরের মেলার পরিকল্পনা করা। 
১৩. বইমেলার খবর, বইয়ের খবর টিভি, রেডিও এবং স্যোশাল মিডিয়ায় মাসব্যাপী বিশেষভাবে সরব রাখা, মেলার বিশেষ দিক নিয়ে ভিডিও ও পডকাস্ট সিরিজ চালু করা। 
১৪. মেলা কমিটির পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মেলা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া। বইপড়া প্রতিযোগিতা, রচনা লেখা প্রতিযোগিতা, গল্প বলা, আবৃত্তি প্রভৃতি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। 
১৫. মেলায় অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশনাকে প্রাধান্য দেওয়া। বইয়ের আন্তর্জাতিক রাইট বিক্রয়ের লক্ষে আন্তর্জাতিক রাইট এজেন্সিসমূহকে বইমেলায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। আমি  মনে করি, অমর একুশে বইমেলা কমিটি এসব উদ্যোগ এবং আরও অভিজ্ঞজনের মতামত নিয়ে বইমেলাকে আরও জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও পাঠকবান্ধব করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশে অমর একুশে বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিডিয়া বইমেলার সকল দিক জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারে এবং পাঠকদের বই পড়ায় ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে পারে। অমর একুশে বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা নিম্নরূপ হতে পারে:

সময়োচিত খবর: মিডিয়াকে বইমেলার সমস্ত খবর সঠিক সময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এতে বইমেলার সর্বশেষ আপডেট, নতুন বই, বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখকদের সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বইমেলার সব কর্মকাণ্ড এবং আপডেট আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। 

ভিডিও কন্টেন্ট: বইমেলা থেকে লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং, ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি তৈরি করে এবং তা মিডিয়ায় প্রচার করে বইমেলার পরিবেশ উৎসবমুখর করে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। 

পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ: নতুন বই, প্রকাশক, লেখকদের বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন মিডিয়ায় প্রকাশ করা যেতে পারে। এটি পাঠকদের জন্য বই নির্বাচনে সহায়তা করবে। 

বিতর্ক ও আলোচনা: বইমেলার বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এ সকল অনুষ্ঠানের বিস্তারিত মিডিয়ার মাধ্যমে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করে বইমেলা সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে । 

পাঠকদের অভিমত: পাঠকদের অভিমত জানার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোল, সার্ভে ইত্যাদি চালানো যেতে পারে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা তাৎক্ষণিক প্রচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 

বইমেলার ইতিহাস: বইমেলার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে পাঠকদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং বইমেলার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। বইমেলায় মিডিয়া ব্যবস্থাপনা চমৎকারভাবে করা গেলে বইমেলার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। মানুষ বই পড়ায় উৎসাহিত হবে, বইয়ের পাঠক নিঃসন্দেহে অনেক বাড়বে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখক দ্রুত পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। প্রকাশকদের বই বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পের সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। অর্থাৎ আধুনিক ও কার্যকর মিডিয়া ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে মেধাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণের পাশাপাশি পেশাদার প্রকাশকদের নেতৃত্বে প্রকাশিত শিল্প দ্রুত গতিতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

লেখক: বিশেষজ্ঞ প্রকাশক, চেয়ারম্যান, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবস থ দ র জন য জনপ র বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ