সচিবালয়ে শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়
Published: 22nd, January 2025 GMT
প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে গতিবিধি পর্যবেক্ষণে আছে ৬২৪ সিসি ক্যামেরা। পিলে চমকানো তথ্য হলো, এসব ক্যামেরার মাত্র ৩৫টি এখন সচল। ৯৫টি অর্ধ-বিকল, বাদ বাকি ৪৯৪টি পুরোপুরি অচল। সচিবালয়ের তিন ফটকে আছে চারটি ব্যাগেজ স্ক্যানার। এর সব ক’টিই নষ্ট। এ ছাড়া ছয়টি আর্চওয়ের কোনোটাই কাজ করে না; সবই ‘মৃত’। খোদ সরকারি প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এমন ভয়ংকর ‘বিকল কাহিনি’। (সমকাল, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫)
খবরে বলা হয়েছে, এসব বিকল যন্ত্রপাতি মেরামত করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কোনো নিরাপত্তার প্রশ্নে তো প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব জরুরি তহবিল থাকার কথা। সেই অর্থ ব্যয় করেও তো সিসি টিভিগুলো মেরামত করা যেত বা রিপ্লেস করা যেত বা যায়। সে উদ্যোগ কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়েছে?
আবার এত সিসি ক্যামেরা কি একসঙ্গে বিকল হয়ে পড়েছে? যদি তা হয়, তাহলে তার মানে এক রকম। যদি সেগুলো পর্যায়ক্রমে বিকল হয়ে পড়ে, তাহলে অন্য কথা। তার মানে ঘটনাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঘটেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই তা ঘটেছে। অথচ কাউকে আজ পর্যন্ত এ জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
চারটি ব্যাগেজ স্ক্যানার ও ৬টি আর্চওয়ে দীর্ঘকাল ধরেই অচল। আর্চওয়ে সচল না থাকায় কেউ যদি অবৈধ যন্ত্রপাতি, মারণাস্ত্র, পিস্তল-বন্দুক বা দেশি অস্ত্রসহ ঢোকে, তাহলেও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্তারা তা ধরতে পারবেন না। তারা যদি নিরাপত্তার কাজ না-ই করতে পারেন, তাহলে তাদের ওই দায়িত্বে রাখা তো অর্থের অপচয় এবং নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর হুমকিস্বরূপ। অথচ জননিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আরামে অফিস করছেন।
গেল ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। সরকারি ছুটির দিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এখনও জনমনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এমন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সচিবালয়ের নিরাপত্তার দুর্দশার চিত্র সামনে এলো। যদি এসব সিসি ক্যামেরা একসঙ্গে নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে এর সঙ্গে ২৫ ডিসেম্বরের আগুনের কোনো যোগসূত্র উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওই অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত যতটুকু হয়েছে, তাতে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মেলেনি। বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্লোরগুলোতে পাওয়া সাদা পাউডারের উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকার পরও অষ্টম তলায় কুকুর কীভাবে গেল– সে প্রশ্নেরও কোনো সুরাহা হয়নি।
২.
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন যোগ দেন তখন কি তিনি জননিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে কোনো উপাত্ত চেয়েছিলেন? সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যে কিছুই জানতেন না, তা বোঝা গেল ওই অগ্নিকাণ্ডের পর। সিসি টিভি, আর্চওয়ে ও ব্যাগেজ স্ক্যানারগুলো সচল থাকলে কে বা কারা সাদা পাউডার নিয়ে এসেছিল, তাদের শনাক্ত করা তেমন দুরূহ হতো না। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সম্ভবত এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ– কাকের মাংস কাকে খায় না। তাই তারা দোষীদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে না। যদি সিসি টিভি ক্যামেরা চালু থাকত তাহলে সহজেই অপরাধী চক্রকে চিহ্নিত করা যেত।
এই গাফিলতির জন্য দায়ী কে বা কারা? সাদা চোখে মনে হবে দায়ী জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জননিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি কেন– সেটিও এক প্রশ্ন। তারা কেন অর্থ ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে বা করে চলেছে?
এটি এক প্রকার গদাইলস্করি কাজ। ধরুন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অর্ডার করেছে আইজিপিকে– ‘অমুক’কে আটক করো। আইজিপি সে অর্ডার সংশ্লিষ্ট এলাকার বা তাঁর সরাসরি অধস্তনকে বহন করতে আদেশ দিলেন। তিনি দিলেন তাঁর অধস্তনকে। সেই অধস্তন দিলেন তাঁর অধস্তন থানার ওসিকে। ওসি দিলেন কোনো এসআইকে। সেই এসআই তাঁর সোর্সকে পাঠালেন– যাও, তাকে বলো যে আমি তাকে আটক করতে আসছি। আসামি ভদ্রলোক, টাকা নিয়ে রেডি। এসআই টাকা নিয়ে ফিরে এলেন এবং জানিয়ে দিলেন– আসামি পলাতক; তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আদেশের জবাব গেল দু’তিন দিন পর। অন্যদিকে আসামি পুলিশেরই চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, গত ১৬-১৭ বছর ধরে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আস্ফালন আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে নির্বাচন নামক ভোট চুরির উৎসবে প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন ওই প্রশাসনের কর্মকর্তারা। শীর্ষ থেকে উপজেলা পর্যন্ত প্রত্যেক আমলা বিগত সরকারের লুটপাটের সহযোগী, বেনিফিশিয়ারি। নানা কিসিমের তোফা তারা পেয়েছেন শেখ হাসিনার তরফ থেকে। তারা হাসিনাকেই চান। এ চাওয়ার পেছনে তাদের লাভকেই দেখছেন বড় করে। দেশ ও দেশের মানুষের সেবক না হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো প্রভুসুলভ লুটপাট যারা চালিয়েছেন, তারা তো ফ্যাসিবাদীদেরই দোসর হওয়ার কথা। তারাই যে সচিবালয়ের নথি পোড়াতে নিজেদের লেজুড় কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাদের কাজে লাগাননি– সেটিই বা কে বলতে পারে!
এত বড় অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে এর হোতাদের কি ধরতে পেরেছে সরকার? সরকার মানে তো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকেই বোঝায়। তাঁরই নিয়ন্ত্রণে জননিরাপত্তা বিভাগ। সেই বিভাগের কর্মকর্তারা সচিবালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন থেকে এ দায়িত্বহীন কাজ করলেন, তা অপরাধের শামিল। যথাযথ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করাই হবে প্রধান কাজ। শুধু সচিবালয়ের গেটে কড়াকড়ি করলেই যদি জননিরাপত্তা রক্ষিত হতো তাহলে সিসি ক্যামেরা, আর্চওয়ে ও ব্যাগেজ স্ক্যানার বসানোর দরকার হতো না।
ড. মাহবুব হাসান: সাংবাদিক
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে ইরানের তেল ও গ্যাস স্থাপনায় হামলা
ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তেল ও গ্যাস স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে বৈরিতা চলছে। তবে এবারই প্রথম ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর পর দুই পক্ষ সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি হামলা তীব্র হতে থাকায় বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত শনিবার গভীর রাতে ইরানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরায়েল একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি ডিপোতে হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে রাজধানী তেহরানে একটি তেল শোধনাগারেও আগুন ধরে যায়। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
বিশ্বের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র ‘সাউথ পার্স’-এ ইসরায়েলের হামলায় আগুন লাগার পর ইরান আংশিকভাবে এ ক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ইরান কাতারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করে থাকে।
ইসরায়েল নজিরবিহীনভাবে ইরানের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আরও বাড়তে পারে। দুই দেশই একে অন্যের ভূখণ্ডে আরও বড় ধরনের হামলার হুমকি দিচ্ছে।
ইরান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস ও তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল মজুতের অধিকারী– এই তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের (ইআইএ) দেওয়া। ফলে দেশটির জ্বালানি অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু ছিল। তবে এতদিন ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে হামলা এড়িয়ে চলছিল, বিশেষ করে তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের চাপ ছিল। কিন্তু এবার তা বদলে গেছে।
গত শনিবার রাতে তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে শাররান জ্বালানি ডিপো ও শহরের দক্ষিণে শার-রে অঞ্চলে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ তেল শোধনাগারে বড় ধরনের আগুন লাগে। এ ছাড়া ইরানের দক্ষিণ বুশেহর প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র সাউথ পার্স লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
হামলায় সাউথ পার্সের ‘ফেইজ ১৪’ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে আগুন লাগে। ফলে এখানে দৈনিক ১ দশমিক ২ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদনকারী একটি অফশোর প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলের হামলার প্রথম দিনে তেল ও গ্যাস স্থাপনা বাদ পড়লেও বাজারে তেলের দাম প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। সোমবার বিশ্ববাজারে তেলের দামে আরও বড় উল্লম্ফন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক অ্যালান এয়ার বলেন, ইসরায়েল চায়, ইরানের ওপর হামলায় যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ুক। তাদের লক্ষ্য, ইরানের এই সরকারের পতন ঘটানো। ইরানের সামরিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ, দেশের অভ্যন্তরে সম্মান রক্ষার বিষয় আছে। কিন্তু ইসরায়েলে বড় ধরনের ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা ইরানের নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের বন্ধুর সংখ্যা কম। আর থাকলেও ইসরায়েল পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক মতামতকে পাত্তা দেয় না– বলেন তিনি।