সরিয়ে নেওয়া হবে মোনালিসাকে, তাকে দেখতে গুনতে হবে বাড়তি টাকা
Published: 29th, January 2025 GMT
প্যারিসের বিশ্বখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের সংস্কার কাজ এবং নতুন নির্মাণ কাজের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা চিত্রকর্ম মোনালিসা নতুন একটি প্রদর্শনী স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। মঙ্গলবার ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তার নতুন রেনেসাঁ প্রকল্পের রূপরেখা ঘোষণার সময় এসব কথা বলেন।
২০৩১ সালে নতুন প্রদর্শনী স্থান খুলে দেওয়া হবে এবং মোনালিসাকে দেখতে হলে দর্শনার্থীদের আলাদা করে টিকিট কাটতে হবে। খবর: বিবিসি
এই প্রকল্পে কাচের তৈরি পিরামিড আকৃতির ল্যুভর জাদুঘরে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয় একটি ঢোকার পথ তৈরি করা হবে। জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ল্যুভর জাদুঘরের দ্বিতীয় প্রবেশ দ্বারের নকশা চূড়ান্ত করা হবে।
এ ছাড়া জাদুঘরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্যেও পরিবর্তন হবে। আগামী বছর জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশের বাসিন্দা নন, এমন ব্যক্তিদের জাদুঘর প্রবেশে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকদেরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।
সম্প্রতি ল্যুভরের পরিচালক লোরঁস দে কার জাদুঘরটির অবস্থা নিয়ে সতর্ক করে ফ্রান্স সরকারকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত ভিড় এবং জাদুঘর ভবনের অবস্থার কথা তুলে ধরেন।
এ মাসের শুরুতে ফ্রান্স সরকার ওই চিঠি প্রকাশ করে। চিঠিতে লোরঁস দে কার আরও লেখেন, ১৯৮৯ সাল থেকে পিরামিড আকৃতির জাদুঘরটির ভেতরে প্রবেশের একটিই প্রবেশ পথ এবং অবকাঠামোগত দিক দিয়ে সেটি আর অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপ সামলানোর মতো অবস্থায় নেই। বর্তমানে বছরে ৯০ লাখের বেশি দর্শনার্থী ল্যুভর জাদুঘরে আসেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সবার দৃষ্টিতে, মোনালিসাকে উপস্থাপনার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।’
প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার দর্শনার্থী ল্যুভর জাদুঘরে আসেন। তাদের তিন-চতুর্থাংশই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা দেখতে যান। এবং তাদের মোনালিসা দেখার অভিজ্ঞতা রীতিমতো ধৈর্যের পরীক্ষায় পরিণত হয়। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে তারা মোনালিসার সামনে যাওয়ার সুযোগ পান এবং সেটি দেখা এবং ছবি তোলার জন্য গড়ে ৫০ সেকেন্ড সময় পান।
নতুন প্রকল্পে প্রবেশ দরজা দিয়ে সরাসরি ভূগর্ভস্থ নতুন প্রদর্শনী স্থলগুলোতে চলে যাওয়া যাবে। সেখান থেকেই যাওয়া যাবে পিরামিড ভবনের ভেতরের দিকে অংশে।
মাখোঁ বলেছেন, মোনালিসাকে বর্তমান স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে জাদুঘরে সেটিকে ঠিকমতো দেখা যাবে। দর্শনার্থীদের জন্য অন্যসব বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখাও সহজ হবে, যেগুলো বেশির ভাগ সময় অদেখাই থেকে যায়।
এই সংস্থার এবং নতুন নির্মাণকাজে কয়েক শ কোটি ইউরো ব্যয় হবে। তবে করদাতাদের এর ব্যয়ভার বহন করতে হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট মাখোঁ। তিনি বলেছেন, টিকিট বিক্রির অর্থ, অনুদান এবং জাদুঘরটির পৃষ্ঠপোষক ল্যুভর আবু ধাবি থেকে এই অর্থ আসবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এম ন য় ল ম খ র জ দ ঘর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।