ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও তা গোপন করে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয় বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংক। তারা হলেন– সাবের হোসেন চৌধুরী, মোরশেদ আলম ও মামুনুর রশিদ কিরণ। গত বছরের ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে তারা সবাই এমপি হন। আরেক আওয়ামী লীগ নেতা বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক প্রকৌশলী আবু নোমান হাওলাদারের খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রাখায় তিনি এখনও পরিচালক পদে আছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে ভয়াবহ এ অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর সঙ্গে জড়িত সাউথইস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপির তথ্য লুকানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাখ্যা চেয়ে গত ১৩ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১২ মার্চের মধ্যে দফা ধরে ধরে ব্যাখ্যা দিতে হবে।

নিয়ম অনুযায়ী কেউ ঋণখেলাপি হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) রিপোর্ট করতে হয়। কারও ঋণের শ্রেণি পরিবর্তন হলে একসময় শাখা থেকে প্রথমে নিজ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হতো। বেশ কিছু প্রক্রিয়া মেনে সিআইবির তথ্য হালনাগাদ করা হতো। তবে আশ্চর্যজনকভাবে গত নির্বাচনের তিন মাস আগে হঠাৎ করে তথ্য হালনাগাদের ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সুযোগের অপব্যবহার করে সাউথইস্ট ব্যাংক তিনজন সংসদ সদস্য প্রার্থীর খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে। এমন অনিয়ম অন্য ব্যাংকেও ঘটতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-৯ আসনের সাবেক এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী পারফরম্যান্স মোটরসের পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটির নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ৩৪টি মেয়াদি ও একটি চলতি মূলধন ঋণ রয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের পাওনা ৪৮৫ কোটি টাকা এবং নির্বাচনের আগে তা খেলাপি ছিল। কিন্তু তা নিয়মিত দেখানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণটি যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ করলে সংসদ সদস্য পদ ধরে রাখার জন্য হলেও সাবের হোসেন চৌধুরী তা পরিশোধ করতেন। আবার এসব ঋণ করপোরেট শ্রেণিভুক্ত হিসেবে সাধারণ প্রভিশন হিসেবে ১ শতাংশ হারে ৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা রাখার কথা। অথচ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণ দেখিয়ে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে মাত্র ১ কোটি ২১ লাখ টাকা প্রভিশন রাখা হয়। অন্যদিকে চলতি মূলধন ঋণ কোম্পানির ব্যবসায় না খাটিয়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতপশিলের ডাউনপেমেন্ট হিসেবে দেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-২ আসনের সাবেক এমপি মোরশেদ আলম বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার ইউটিলিটির সাউথইস্ট ব্যাংকে ৭ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল। এ তথ্য গোপন করে সিআইবিতে ‘ক্লিন’ রিপোর্ট দেয় ব্যাংক। এভাবে মোরশেদ আলমকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

নোয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এএসটি বেভারেজ ছিল সাউথইস্ট ব্যাংকের ঋণখেলাপি। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ব্যাংকটির নিউ ইস্কাটন শাখায় তাদের ঋণ খেলাপি হয় বেশ আগেই। সিআইবিতে এ তথ্য গোপন করায় তিনি নির্বাচনের সুযোগ পান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা ও বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো.

আবু নোমান হাওলাদারের মালিকানাধীন ডায়নামিক কারসের ১৩ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখার খেলাপি। এ তথ্য গোপন রাখায় ঋণখেলাপি হয়েও তিনি এখনও ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল আছেন।

বক্তব্য জানার জন্য গত বুধবার থেকে সাবেক এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী ও মোরশেদ আলমের ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ধরেননি। কখনও কখনও মোরশেদ আলমের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে এসএমএস করলেও তারা সাড়া দেননি। মামুনুর রশিদ কিরণের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবু নোমান হাওলাদারের ফোনও বন্ধ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত এসব নেতা এখন আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। এসব ব্যক্তির শ্রেণীকৃত ঋণকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সিআইবিতে নিয়মিত হিসেবে রিপোর্ট করা হয়, যা অনৈতিক। খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সঙ্গে জড়িত শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এসব ঋণ খেলাপি করে যথাযথ প্রভিশন রাখতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দিন মো. ছাদেকের বক্তব্যের জন্য গত মঙ্গলবার থেকে টেলিফোন করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে এসএমএস করলেও সাড়া দেননি। গত বৃহস্পতিবার এমডির দপ্তরে গেলে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ সমকালকে বলেন, ‘স্যার বোর্ড মিটিংয়ে আছেন।’ ব্যাংকটির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এমডি স্যার রাত ৯টায় টেলিফোনে কথা বলবেন।’ রাতে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। পরে একটি এসএমএস দিয়ে লেখেন ‘সরি’। ২০২৩ সালের এপ্রিলের আগ পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এম কামাল হোসেন। সার্বিক বিষয়ে তাঁর বক্তব্য চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেন, একটি ব্যাংকে পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেবল সেতু হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

সাউথইস্ট ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের বক্তব্যের জন্য গত মঙ্গলবার থেকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। গত বুধবার তাঁর গুলশান-২ নম্বরের বাসায় গেলে জানানো হয়, তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায়ও তিনি অংশ নেননি। গত মঙ্গলবার আলমগীর কবিরের হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করে বক্তব্য চাওয়া হলেও সাড়া দেননি। গত বুধবার রাতে আলমগীর কবিরের প্রতিনিধি হিসেবে এক ব্যক্তি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তাদের জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চেয়ারম্যানের পদ হারিয়েও রেখেছেন দুই গাড়ি
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ব্যাংকের একটি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে দুটি করে দামি গাড়ি ব্যবহার করে আসছেন। গাড়ি দুটির একটি হ্যারিয়ার জিপ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৮৭১৩। আরেকটি মার্সিডিজ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ভ ১৪-০০৫৪। গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি আর চেয়ারম্যান নেই। অথচ গত মঙ্গলবার গুলশান-২ এ ৫৮ নম্বর রোডের ৩/৪ বাসার গ্যারেজে গাড়ি দুটি পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান হিসেবে একটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। পদ হারানোর চার মাস পরও গাড়ি দুটি ফেরত দেননি। গত সপ্তাহে গাড়ি ফেরত চেয়ে তাঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দ্রুত গাড়ি ফেরত না দিলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বেশি সুদে কলমানি থেকে টাকা নিয়ে কম সুদে ধার
দুরবস্থায় পড়া দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। এর চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর ভাইয়ের ছেলে জুবায়ের কবির। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বে লিজিংয়ের আমানত ছিল ৪৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৩২ কোটি বা ৪৭ শতাংশই সাউথইস্ট ব্যাংকের রাখা আমানত। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বে লিজিংয়ের মোট ৮৩৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫৫১ কোটি টাকা বা ৬৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বে লিজিংয়ের পুঞ্জীভূত লোকসান ছিল ১৭২ কোটি টাকা। সার্বিক পর্যালোচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, সাউথইস্টের পাওনা পরিশোধের আর্থিক সক্ষমতা বে লিজিংয়ের নেই। 

২০২২ ও ২০২৩ সালে যখন এ অর্থ দেওয়া হয়, ওই সময় ব্যাংক নিজেও তহবিল সংকটে থাকায় কলমানি থেকে ধার করছিল। যে রকম সুদে ব্যাংক ধার করেছে, তার চেয়ে কম সুদে বে লিজিংকে দিয়েছে। প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বরের লেনদেনের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, ওই দিন মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে ৮২ কোটি টাকা ধার করে সাউথইস্ট। একই দিন বে লিজিংকে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে ধার দেওয়া হয় ৬২ কোটি টাকা। কলমানির বাইরে মেয়াদি আমানত হিসেবে বে লিজিংয়ে ১২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা রেখেছে ব্যাংক। আর ব্যাংক ফাউন্ডেশনের ২৪ কোটি টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংক গ্রিন স্কুলের ৫৭ লাখ টাকাও রাখা হয়েছে। 

ঋণে যত জালিয়াতি
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে কোনো একটি ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। এ নির্দেশনা অমান্য করে বিভিন্ন গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সাউথইস্ট ব্যাংকের মোট মূলধন ছিল ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে একক গ্রুপকে সর্বোচ্চ ৬৮৭ কোটি টাকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাউথইস্ট ব্যাংকের গুলশান শাখা ও ডিইপিজেড অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে সমস্যাগ্রস্ত কেয়া গ্রুপকে ১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। ২০১৯ সাল থেকে এই ঋণ খেলাপি হলেও তা নিয়মিত দেখিয়ে এসেছে ব্যাংক। ২০২২ সালে আলমগীর কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় এ ঋণে নতুন করে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। 

সাউথইস্ট ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কেয়া গ্রুপের খারাপ অবস্থার কারণে অন্য ব্যাংক যখন ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে, ওই সময় সাউথইস্ট ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবির ব্যক্তিস্বার্থে ঋণ দিয়েছেন। ২০১৯ সালে ঋণ দেওয়ার পরই কেয়া কসমেটিকসকে আলমগীর কবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সে বীমা করানো হয়। যেখান থেকে কমিশন আয় করেছে ৬৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় দেশবন্ধু সুগার মিলের ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। এ ঋণে নানা অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় স্ল্যাশ ওয়ার্কস ওয়াটার পার্কের ঋণে নানা অনিয়ম হয়েছে। ঋণ দেওয়ার আগে শাখা থেকে পার্কটির প্রথম বছরের আয় প্রাক্কলন করা হয় ২১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অথচ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের পর থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত আয় হয়েছে ৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখায় বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের ঋণ রয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে জামানত মাত্র ৯৭ কোটি টাকার। ২০২৩ সালের জুনে ঋণটি খেলাপি হলেও নিয়মিত দেখানো হতো। ক্যাপিটাল বনানী ওয়ান ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে করপোরেট শাখায় ঋণ রয়েছে ৭৫৪ কোটি টাকা। নিয়ম অমান্য করে ২০২১ সালের জুলাইতে ১১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করে ব্যাংক। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ বেস্ট হোল্ডিংস গ্রুপের চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, সাউথইস্ট ব্যাংকের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। আর ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, যা ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। যদিও ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্তত ৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ১৭ দশমিক ২৯ শতাংশ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলমের নির্দেশনায় তখন মাত্র ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়। একই সঙ্গে ৩৩০ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় দেওয়া হয়। যে কারণে ২০৯ কোটি টাকার নিট মুনাফা দেখায় ব্যাংক। বিশেষ সুবিধা না দিলে ৫৯২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ত। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। ৬১২ কোটি টাকা এমন সব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, যাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ। এর বাইরে পুনঃতপশিল করা ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এর মানে খেলাপির বাইরে ব্যাংকটির ৩৬ দশমিক ৩১ শতাংশ সমস্যাগ্রস্ত ঋণ। পুনঃতপশিল করা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা তিনবারের বেশি তপশিল হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঋণখ ল প এমপ আওয় ম ল গ স উথইস ট ব য ২০২৩ স ল র র ব যবস ঋণখ ল প ক র ঋণ র জন য দশম ক স আইব ম লধন তপশ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে তিন গুণ

নীতি সহায়তার নামে মন্দ ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধের পর যেন লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। গত ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। মার্চ প্রান্তিক শেষে বিরূপ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

খেলাপি ঋণ যে এভাবে লাফিয়ে বাড়বে তা আগেই ধারণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ অনেক বাড়বে। গত ফেব্রুয়ারিতে আগের সেই কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে না। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আবার কমবে। এ ছাড়া নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সে জন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে এভাবে খেলাপি বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, মেয়াদি ঋণখেলাপির সময় পুনর্নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কিছু বড় অঙ্কের ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত হওয়ায় এভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ ছাড়া গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতপশিল করা ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ না হওয়া এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে সুদ যোগ হয়ে বেড়েছে খেলাপি।

বিগত সরকারের সময়ে নানা নীতি সহায়তার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর সংস্থাটি নীতি সহায়তা তুলে দেওয়ার শর্ত দেয়। বিশেষ করে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ী থাকার ৬ মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাব করার বিধান বাতিল এবং ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ করতে বলে সংস্থাটি। এর মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হয়। বিভিন্ন জালিয়াতি করে ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে
জেলে আছেন। এসব কারণেই খেলাপি ঋণ লাফিয়ে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মানে শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। যেখানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যেখানে খেলাপি দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মানে ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। আর সরকার পরিবর্তনের আগে গত জুন শেষে খেলাপি ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সে তুলনায় বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। শেষ ৯ মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। এর অন্যতম কারণ বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ঋণের নামে বিপুল অর্থ লুট হয়। সেই টাকা আর ফেরত আসছে না। দখল করা কোনো কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৯৮ শতাংশে ঠেকেছে। এক সময় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের যেখানে ৫ শতাংশের কম ছিল খেলাপি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকের ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের যা ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৬
হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বিগত সরকারের শুরুর দিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগ থেকে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিল চালু হয়। এরপর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে কখনও বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতপশিল, কখনও ঋণ ফেরত না দিলেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে গিয়ে পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এতদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ এখন বেরিয়ে আসছে। এতে করে দ্রুত বাড়ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে তিন গুণ
  • দৃষ্টিহীন বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গেপ্তার ২
  • বিএনপির সঙ্গে চীনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
  • হবিগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু
  • নাটক প্রকাশ নিয়ে নিলয়ের ক্ষোভ, যা জানাল দীপ্ত কর্তৃপক্ষ
  • শিল্পী-নির্মাতাকে না জানিয়ে ইউটিউবে নাটক প্রকাশ, নিলয়ের ক্ষোভ
  • শিল্পী-নির্মাতাকে না জানিয়ে নাটক রিলিজ, নিলয়ের ক্ষোভ
  • চাকরির নামে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো চক্রের হোতা গ্রেপ্তার
  • বিদেশে চাকরির নামে যুবকদের পাঠানো হতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে, চক্রের ‘হোতা’ গ্রেপ্তার
  • ঈদ পুনর্মিলনীর নামে বিএনপির আয়োজনে আ.লীগের মিলনমেলার অভিযোগ