মস্তিষ্ক যত দিন সুস্থ থাকবে, ওই রাত ততদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে: ফুলপরী
Published: 14th, February 2025 GMT
২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ফুলপরী খাতুন। ফুলপরী তখন প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি এখন ২য় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। দেখতে দেখতে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের দুই বছর পার হয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় পার হলেও সেই দুর্বিষহ রাতের স্মৃতি এখনও তাড়া করছে ফুলপরীকে। গত বুধবার রাতে সেই রাতের স্মৃতি মনে করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের প্রতি অগাধ ইতিবাচক ধারণার কারণে আর বেশি বোকা হওয়ায় সেদিন রাতে তাদের সাথে চলে গেলাম। সেই চলে যাওয়াটা চিরদিনের জন্য চলে যাইনি যে এটা আমার ভাগ্য। জীবনে ফেলে আসা রাতগুলোর মধ্যে ওটাই জঘন্যতম রাত। মস্তিষ্ক যতদিন সুস্থ থাকবে ওই রাত ততদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
স্ট্যাটাসে ফেব্রুয়ারির সেই রাতে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের কিছু বর্ণনাও তুলে ধরেন ফুলপরী। তিনি লিখেছেন, ২০২৩ সালের সেই সময়টায় আমি যে কতো অসহায় ছিলাম! সেই রাতে ভাবতেছিলাম কি এমন করলাম যার জন্য এত বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য অপমানের শিকার হলাম! ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য নিজেই ছোট হয়েছি, ক্ষমা চেয়েছি, শান্তি চেয়েছি। চলছে তো চলছেই রাত শেষ হয়ে যায় তাও প্রতিহিংসা বিন্দু মাত্র কমে না। মনে হচ্ছিল কোনো মার্ডার করা আসামির রিমান্ড চলছে। শ্বাসকষ্ট এর জন্য আমারই ইনহেলার চেয়েও পাইনি।
ফুলপরী আরও লিখেছেন, আমার মনটা পাথরের মতো শান্ত, শ্বাস প্রশ্বাস গুলো ছোট হয়ে আসছিল। তিন দিন হলো ঠিকঠাক মতো খাওয়াও নাই ঘুমও নাই, মনে হচ্ছিল কখন যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। শীতে কাঁপতেছিলাম মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল মুখে আঙ্গুল এর দাগ, ঘুষির দাগ মুছে যাওয়া জন্য। মনে হয়েছিল এই অত্যাচার এর ধরণ গুলো কোনো কাপুরুষের শিখিয়ে দেওয়া।
এছাড়াও স্ট্যাটাসে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে যেসব বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন সে বিষয়টি তুলে ধরে ফুলপরী বলেছেন, কতো মানুষের কতো কথা নিঃশব্দে হজম করেছি। শিক্ষিত চশমায় আঁটা মানুষও আমার মুখে ওপর আঙ্গুল তুলেছে। এলাকার রাজনৈতিক নেতারা বলতো আমার জন্য পাঁচটি মেয়ের জীবন নষ্ট। এতো মায়া! কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে যে শাস্তিটা দিতে পারতাম তা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেইনি।
শুধুমাত্র সেই সময়টাতেই নয়, বর্তমানেও সমাজের মানুষের নানা কটু কথা শুনতে হয় বলে ভাষ্য ফুলপরীর। তবে তিনি আর এখন মানুষের এসব কথা কানে নেন না। সমাজের চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে চান তিনি। তিনি বলেন, নিজেকে সামলাতে অনেক সময় লেগেছে, যা আমি কখনোই প্রত্যাশা করিনি। এ সমাজ একটা মানুষকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে দিতে চায় না, পেছন থেকে হাত-পা ধরে টানতে থাকে। তখনও এলাকার মানুষ কত বাজে কথা বলেছে, এখনও বলে। তবে আমি বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের। কে কি বলল এসব কানে নেই না। মানুষ হাজার কথা শুনালেও কিছুই মনে করি না। চুপচাপ থাকি। জীবন থেকে, চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে চাই। তাই তেমন কাউকে ভক্তি করি না, মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকি সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। নিজের সৎ লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
২০২৩ সালের ১১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফুলপরীকে গণরুমে ডেকে রাতভর নির্যাতন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষিতে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শাখা ছাত্রলীগ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। হাইকোর্টের নির্দেশে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ওই বছরের ১ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশনায় দোষী সাব্যস্ত ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচ ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পাশাপাশি ছাত্রলীগ থেকেও তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাইকোর্টের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অভিযুক্তদের এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শাস্তি বিধিসম্মত না হওয়ায় গৃহীত শাস্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পুনরায় শাস্তি নির্ধারণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বশেষ ওই বছরের ২১ আগস্ট জরুরী সিন্ডিকেটে দোষীদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী, ছাত্রলীগ কর্মী হালিমা আক্তার, ইসরাত জাহান, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।