২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ফুলপরী খাতুন। ফুলপরী তখন প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি এখন ২য় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। দেখতে দেখতে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের দুই বছর পার হয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় পার হলেও সেই দুর্বিষহ রাতের স্মৃতি এখনও তাড়া করছে ফুলপরীকে। গত বুধবার রাতে সেই রাতের স্মৃতি মনে করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। 

স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের প্রতি অগাধ ইতিবাচক ধারণার কারণে আর বেশি বোকা হওয়ায় সেদিন রাতে তাদের সাথে চলে গেলাম। সেই চলে যাওয়াটা চিরদিনের জন্য চলে যাইনি যে এটা আমার ভাগ্য। জীবনে ফেলে আসা রাতগুলোর মধ্যে ওটাই জঘন্যতম রাত। মস্তিষ্ক যতদিন সুস্থ থাকবে ওই রাত ততদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।’

স্ট্যাটাসে ফেব্রুয়ারির সেই রাতে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের কিছু বর্ণনাও তুলে ধরেন ফুলপরী। তিনি লিখেছেন, ২০২৩ সালের সেই সময়টায় আমি যে কতো অসহায় ছিলাম! সেই রাতে ভাবতেছিলাম কি এমন করলাম যার জন্য এত বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য অপমানের শিকার হলাম! ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য নিজেই ছোট হয়েছি, ক্ষমা চেয়েছি, শান্তি চেয়েছি। চলছে তো চলছেই রাত শেষ হয়ে যায় তাও প্রতিহিংসা বিন্দু মাত্র কমে না। মনে হচ্ছিল কোনো মার্ডার করা আসামির রিমান্ড চলছে। শ্বাসকষ্ট এর জন্য আমারই ইনহেলার চেয়েও পাইনি। 

ফুলপরী আরও লিখেছেন, আমার মনটা পাথরের মতো শান্ত, শ্বাস প্রশ্বাস গুলো ছোট হয়ে আসছিল। তিন দিন হলো ঠিকঠাক মতো খাওয়াও নাই ঘুমও নাই, মনে হচ্ছিল কখন যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। শীতে কাঁপতেছিলাম মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল মুখে আঙ্গুল এর দাগ, ঘুষির দাগ মুছে যাওয়া জন্য। মনে হয়েছিল এই অত্যাচার এর ধরণ গুলো কোনো কাপুরুষের শিখিয়ে দেওয়া।

এছাড়াও স্ট্যাটাসে তার ওপর হওয়া নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে যেসব বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন সে বিষয়টি তুলে ধরে ফুলপরী বলেছেন, কতো মানুষের কতো কথা নিঃশব্দে হজম করেছি। শিক্ষিত চশমায় আঁটা মানুষও আমার মুখে ওপর আঙ্গুল তুলেছে। এলাকার রাজনৈতিক নেতারা বলতো আমার জন্য পাঁচটি মেয়ের জীবন নষ্ট। এতো মায়া! কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে যে শাস্তিটা দিতে পারতাম তা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেইনি। 

শুধুমাত্র সেই সময়টাতেই নয়, বর্তমানেও সমাজের মানুষের নানা কটু কথা শুনতে হয় বলে ভাষ্য ফুলপরীর। তবে তিনি আর এখন মানুষের এসব কথা কানে নেন না। সমাজের চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে চান তিনি। তিনি বলেন, নিজেকে সামলাতে অনেক সময় লেগেছে, যা আমি কখনোই প্রত্যাশা করিনি। এ সমাজ একটা মানুষকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে দিতে চায় না, পেছন থেকে হাত-পা ধরে টানতে থাকে। তখনও এলাকার মানুষ কত বাজে কথা বলেছে, এখনও বলে। তবে আমি বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের। কে কি বলল এসব কানে নেই না। মানুষ হাজার কথা শুনালেও কিছুই মনে করি না। চুপচাপ থাকি। জীবন থেকে, চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে চাই। তাই তেমন কাউকে ভক্তি করি না, মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকি সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। নিজের সৎ লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

২০২৩ সালের ১১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফুলপরীকে গণরুমে ডেকে রাতভর নির্যাতন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষিতে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শাখা ছাত্রলীগ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। হাইকোর্টের নির্দেশে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ওই বছরের ১ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশনায় দোষী সাব্যস্ত ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচ ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পাশাপাশি ছাত্রলীগ থেকেও তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাইকোর্টের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অভিযুক্তদের এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শাস্তি বিধিসম্মত না হওয়ায় গৃহীত শাস্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পুনরায় শাস্তি নির্ধারণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বশেষ ওই বছরের ২১ আগস্ট জরুরী সিন্ডিকেটে দোষীদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী, ছাত্রলীগ কর্মী হালিমা আক্তার, ইসরাত জাহান, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।

সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।

পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু

১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।

বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।

এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।

আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।

জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী