Prothomalo:
2025-11-03@04:06:48 GMT

শহীদ জোহার আত্মত্যাগের স্মরণে

Published: 18th, February 2025 GMT

ফাগুন আসে পলাশের আগুন হয়ে; কৃষ্ণচূড়ার লালে মিশে যায়, প্রেম আর দ্রোহের ছোঁয়া। কিন্তু এক ফাল্গুনে, ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়ার রং মলিন হয়ে গিয়েছিল এক মহান শিক্ষকের রক্তে; সেই সঙ্গে চক্র ক্রমিক হারে বসন্ত ছাপিয়ে দরজায় কড়া নেড়েছিল অবহেলা! ঠিক যেন কবি দর্পণ কবিরের স্বরচিত কবিতার মতো; মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের মতো; অনেকটা নির্লজ্জভাবে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা!  ড.

সৈয়দ মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা—বাংলাদেশের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক সাহসী শিক্ষক; যিনি প্রমাণ করে গেছেন—শিক্ষকের কলম যেমন শক্তিশালী, তেমনি তাঁদের আত্মদানের দৃঢ়তাও এক অবিনশ্বর চেতনা।

উনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বাঙালি আত্মত্যাগের মন্ত্রে নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা নিচ্ছিল। উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, শহীদ আসাদ নামে তিনি ইতিহাসে খ্যাত। এরই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে।

ফলে দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন দাবানলের রূপ নেয়। প্রতিবাদস্বরূপ ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্র ছাত্র–ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কাজলা গেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়।

‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড—ডোন্ট ফায়ার; কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে’—নিজেকে প্রক্টর পরিচয় দিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠেন ড. জোহা। তর্কযুদ্ধের একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েই ক্ষান্ত হয়নি, বেয়নেট দিয়ে নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ প্রারম্ভ থেকেই এ দেশের শিক্ষকেরা অসহায় শিক্ষাব্যবস্থার কাছে, নানা বাহিনীর কাছে, ছাত্র নামের দুর্বৃত্তদের কাছে! শিক্ষক সম্পর্কে মানুষের মনে যে বিষয়টি গেঁথে গেছে, তারা খুব সাধারণ মানের জীবনযাপন করবে এবং সেই সাদামাটা জীবনের জন্য সমাজ তাদের ধন্য ধন্য করবে। অর্থাৎ বাংলা সিনেমায় দেখানো শিক্ষকদের সেলুলয়েড ও জেরক্স ভার্সন! অথচ শিক্ষকদের তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও গণ্য করেন।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা চরম সংকটে। শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনেও ব্যবসার ছায়া, উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে মেধা পাচারের কালো হাতছানি। শিক্ষকদের বেতন, পারিতোষিক, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ—সবকিছুতেই ঘাটতি। আদর্শচর্চা ও নৈতিক শিক্ষার স্থান দখল করেছে গ্রেডভিত্তিক শিক্ষা। একসময় যাদের সামনে জাতি মাথা নত করত; আজ তাঁরা অবহেলিত। শিক্ষকের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ন্যায় ও নীতির স্বাধীনতা।

জীবন ঠুনকো, জীবন সংকটময়। তবে রক্ত যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, তখন তা ইতিহাস গড়ে। শহীদ জোহার আত্মত্যাগ তেমন ইতিহাসই তৈরি করেছে। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে এই রাষ্ট্র তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে এবং তাঁর নামে চার টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট চালু করা হয়েছে। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসন ভবনের সামনে নজরে পড়বে শহীদ জোহার সমাধিক্ষেত্র।

কয়েক বছর ধরে জোহা দিবস পালনে যোগ দিয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একুশে পদকও দেওয়া হয়নি ড. জোহাকে। এ জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, ড. জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পাশাপাশি জোহা স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনাসভা, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে ‘সংসারের জন্য যে নিজেকে প্রতিনিয়ত ক্ষয় করিলো, তাহাকে সকলে মাথায় করিয়া দায়মুক্তি পাইলো;  কিন্তু তাহাতে তাহার ক্ষয় পূরণ হইল কি?’
যে জাতি জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেই জাতির চেতনা কীভাবে বিকশিত হবে?

আজ যখন অন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত, যখন সত্য বলতে ভয় পায় মানুষ, যখন ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ—তখন আমাদের প্রয়োজন শামসুজ্জোহার মতো সাহসী শিক্ষকদের, যাঁরা জ্ঞানের আলোয় পথ দেখাবেন, যাঁরা আবারও বুক পেতে দেবেন সত্যের জন্য; কিন্তু একফালি ছেঁড়া চাঁদ আঁকড়ে পুরো পূর্ণিমা উপভোগের আকাঙ্ক্ষা করাটা বাড়াবাড়ি! হৃদয় স্পর্শ করলে দেখা যাবে, সেখানে একটা মাংসপিণ্ড ব্যতীত কোনো অনুভব নেই।

উনসত্তরের রক্তস্নাত কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতি থেকে হৃদয়ে বিশালতা জাগ্রত করে। সেই ফাগুনের বাতাসের কিংশুকের দোলায় আমাদের প্রত্যাশা এক মহান শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক  দিবস' হিসেবে স্বীকৃতিদান এখন সময়ের দাবি।

তাই সময়ের উজান-স্রোতে গা ভাসানো এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে, তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সময়ের প্রভাবমুক্ত, মুক্তচিন্তার একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের আবার শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে, যেন তাঁরা জাতি গঠনে চেতনাস্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন।

শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, শহীদ সৈয়দ ড.শামসুজ্জোহার প্রতি;সেই সব শিক্ষককের প্রতি, যাঁরা এখনো আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে, শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার জন্য!
নীরবতা কখনো মুক্তির পথ হতে পারে না। পরিশেষে ‘আলো হাতে চলিতেছে আঁধারের যাত্রী’—আমরা যেন সেই যাত্রী হই; যারা সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের আলো বহন করে এগিয়ে যায়।

দীপা সাহা
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষকদ র র জন য ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

খুলনার ফুটপাত পথচারীদের নয়, হকারদের দখলে

খুলনা নগরের প্রধান সড়ক ও ফুটপাত এখন পথচারীদের নয়, হকারদের দখলে। ডাকবাংলা থেকে বড়বাজার পর্যন্ত নগরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রজুড়ে ফুটপাতের ওপর চলছে অস্থায়ী দোকানপাট, পণ্যের পসরা আর ক্রেতাদের ভিড়। ফলে পথচারীদের হাঁটার জায়গা নেই, স্থায়ী দোকানের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন ক্রেতা, হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত।

ডাকবাংলা এলাকা খুলনা নগরের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে ডাকবাংলা সুপারমার্কেট, রেলওয়ে মার্কেট, খুলনা বিপণিবিতান, দরবেশ চেম্বার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিপণিবিতান, কাজী নজরুল ইসলাম মার্কেট, মশিউর রহমান মার্কেটসহ বড় শপিং কমপ্লেক্স আছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের অন্যতম বাজার এটি। কিন্তু এখন এর পুরো এলাকার ফুটপাত দখল হয়ে গেছে ভাসমান ব্যবসায়ীদের হাতে।

হকারদের ভিড়ে দোকান দেখা যায় না

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ডাকবাংলা মোড় থেকে ক্লে রোড পর্যন্ত ফুটপাতে মালামাল সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। স্থায়ী দোকানদাররাও নিজেদের দোকানের সামনের জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন। ভ্যানে করে জামাকাপড়, ফল, গৃহস্থালির পণ্য বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতের পর এখন রাস্তার অর্ধেকজুড়ে। পুরোনো যশোর রোড, সদর থানা মোড়, কেডি ঘোষ রোড থেকে হেলাতলা পর্যন্ত একই চিত্র। খালিশপুর চিত্রালি বাজার ও দৌলতপুর বাজারেও ফুটপাতের ওপর খাট বসিয়ে চালা তুলে ব্যবসা চলছে। ফলে পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিদিন।

খালিশপুর চিত্রালি বাজারের দোকান ব্যবস্থাপক মো. আসাদ বলেন, ‘হকারদের কারণে বাইরে থেকে আমাদের দোকান দেখা যায় না। তাদের ব্যবসা জমজমাট, কিন্তু আমাদের বিক্রি কমে গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোও ঢেকে গেছে অস্থায়ী দোকানে।’

খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা গেছে, নগরের আয়তন ৪৬ বর্গকিলোমিটার, পাকা সড়ক ৬৪১ কিলোমিটার। ফুটপাতের সঠিক হিসাব না থাকলেও অন্তত ২৫ কিলোমিটার ফুটপাত হকারদের দখলে। চলতি বছরে ১২ দিনের মতো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই ফের দখল হয়ে যায়।

কেসিসির সম্পত্তিবিষয়ক কর্মকর্তা গাজী সালাউদ্দীন বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী নেতা ও প্রশাসন সবাই একসঙ্গে উদ্যোগ না নিলে এটি বন্ধ হবে না। অনেকে নিজের দোকানের সামনের ফুটপাতও ভাড়া দেন হকারদের। সহযোগিতা না পেলে একা আমাদের কিছু করার নেই।’

পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ