Prothomalo:
2025-08-01@18:26:14 GMT

শহীদ জোহার আত্মত্যাগের স্মরণে

Published: 18th, February 2025 GMT

ফাগুন আসে পলাশের আগুন হয়ে; কৃষ্ণচূড়ার লালে মিশে যায়, প্রেম আর দ্রোহের ছোঁয়া। কিন্তু এক ফাল্গুনে, ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়ার রং মলিন হয়ে গিয়েছিল এক মহান শিক্ষকের রক্তে; সেই সঙ্গে চক্র ক্রমিক হারে বসন্ত ছাপিয়ে দরজায় কড়া নেড়েছিল অবহেলা! ঠিক যেন কবি দর্পণ কবিরের স্বরচিত কবিতার মতো; মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের মতো; অনেকটা নির্লজ্জভাবে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা!  ড.

সৈয়দ মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা—বাংলাদেশের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক সাহসী শিক্ষক; যিনি প্রমাণ করে গেছেন—শিক্ষকের কলম যেমন শক্তিশালী, তেমনি তাঁদের আত্মদানের দৃঢ়তাও এক অবিনশ্বর চেতনা।

উনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বাঙালি আত্মত্যাগের মন্ত্রে নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা নিচ্ছিল। উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, শহীদ আসাদ নামে তিনি ইতিহাসে খ্যাত। এরই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে।

ফলে দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন দাবানলের রূপ নেয়। প্রতিবাদস্বরূপ ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্র ছাত্র–ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কাজলা গেটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়।

‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড—ডোন্ট ফায়ার; কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে’—নিজেকে প্রক্টর পরিচয় দিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠেন ড. জোহা। তর্কযুদ্ধের একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েই ক্ষান্ত হয়নি, বেয়নেট দিয়ে নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ প্রারম্ভ থেকেই এ দেশের শিক্ষকেরা অসহায় শিক্ষাব্যবস্থার কাছে, নানা বাহিনীর কাছে, ছাত্র নামের দুর্বৃত্তদের কাছে! শিক্ষক সম্পর্কে মানুষের মনে যে বিষয়টি গেঁথে গেছে, তারা খুব সাধারণ মানের জীবনযাপন করবে এবং সেই সাদামাটা জীবনের জন্য সমাজ তাদের ধন্য ধন্য করবে। অর্থাৎ বাংলা সিনেমায় দেখানো শিক্ষকদের সেলুলয়েড ও জেরক্স ভার্সন! অথচ শিক্ষকদের তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও গণ্য করেন।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা চরম সংকটে। শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনেও ব্যবসার ছায়া, উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে মেধা পাচারের কালো হাতছানি। শিক্ষকদের বেতন, পারিতোষিক, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ—সবকিছুতেই ঘাটতি। আদর্শচর্চা ও নৈতিক শিক্ষার স্থান দখল করেছে গ্রেডভিত্তিক শিক্ষা। একসময় যাদের সামনে জাতি মাথা নত করত; আজ তাঁরা অবহেলিত। শিক্ষকের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ন্যায় ও নীতির স্বাধীনতা।

জীবন ঠুনকো, জীবন সংকটময়। তবে রক্ত যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, তখন তা ইতিহাস গড়ে। শহীদ জোহার আত্মত্যাগ তেমন ইতিহাসই তৈরি করেছে। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে এই রাষ্ট্র তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে এবং তাঁর নামে চার টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট চালু করা হয়েছে। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসন ভবনের সামনে নজরে পড়বে শহীদ জোহার সমাধিক্ষেত্র।

কয়েক বছর ধরে জোহা দিবস পালনে যোগ দিয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একুশে পদকও দেওয়া হয়নি ড. জোহাকে। এ জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, ড. জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পাশাপাশি জোহা স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনাসভা, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে ‘সংসারের জন্য যে নিজেকে প্রতিনিয়ত ক্ষয় করিলো, তাহাকে সকলে মাথায় করিয়া দায়মুক্তি পাইলো;  কিন্তু তাহাতে তাহার ক্ষয় পূরণ হইল কি?’
যে জাতি জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেই জাতির চেতনা কীভাবে বিকশিত হবে?

আজ যখন অন্যায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত, যখন সত্য বলতে ভয় পায় মানুষ, যখন ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ—তখন আমাদের প্রয়োজন শামসুজ্জোহার মতো সাহসী শিক্ষকদের, যাঁরা জ্ঞানের আলোয় পথ দেখাবেন, যাঁরা আবারও বুক পেতে দেবেন সত্যের জন্য; কিন্তু একফালি ছেঁড়া চাঁদ আঁকড়ে পুরো পূর্ণিমা উপভোগের আকাঙ্ক্ষা করাটা বাড়াবাড়ি! হৃদয় স্পর্শ করলে দেখা যাবে, সেখানে একটা মাংসপিণ্ড ব্যতীত কোনো অনুভব নেই।

উনসত্তরের রক্তস্নাত কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতি থেকে হৃদয়ে বিশালতা জাগ্রত করে। সেই ফাগুনের বাতাসের কিংশুকের দোলায় আমাদের প্রত্যাশা এক মহান শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক  দিবস' হিসেবে স্বীকৃতিদান এখন সময়ের দাবি।

তাই সময়ের উজান-স্রোতে গা ভাসানো এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে, তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সময়ের প্রভাবমুক্ত, মুক্তচিন্তার একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের আবার শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে, যেন তাঁরা জাতি গঠনে চেতনাস্রষ্টা হয়ে উঠতে পারেন।

শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, শহীদ সৈয়দ ড.শামসুজ্জোহার প্রতি;সেই সব শিক্ষককের প্রতি, যাঁরা এখনো আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে, শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার জন্য!
নীরবতা কখনো মুক্তির পথ হতে পারে না। পরিশেষে ‘আলো হাতে চলিতেছে আঁধারের যাত্রী’—আমরা যেন সেই যাত্রী হই; যারা সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের আলো বহন করে এগিয়ে যায়।

দীপা সাহা
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষকদ র র জন য ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

অভ্যুত্থানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন ব্রাত্য

বাংলাদেশ হলো আত্মমুগ্ধ ব্যক্তিদের (নার্সিসিস্টদের) দেশ। এ জনপদের মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যে তাই ‘নার্সিসিস্ট পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ (এনপিডি) থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য একাডেমিকভাবে এ প্রবণতার ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তবে জুলাই অভ্যুত্থানকে মানদণ্ড ধরলে এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে ‘নার্সিসিস্টদের দেশ’ বললে অত্যুক্তি হবে না!

জুলাই অভ্যুত্থানকে নানা রঙে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। জাতিগতভাবে এটিও সম্ভবত আমাদের সাধারণ প্রবণতা। যে কারণে এই গণ-অভ্যুত্থানকে কখনো ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘বিপ্লব’, কখনোবা ‘মেটিকিউলাস ডিজাইন’ কিংবা ‘মাস্টারমাইন্ড তত্ত্ব’ দিয়ে আবরণ পরানো হয়েছে। এটা হয়েছে নিজেকে অধিপতিশীল ভাবার কারণে কিংবা নিজের সময়কে বৃহৎ ইতিহাসের নিক্তিতে অনেক বড় করে দেখার আরোপিত ভ্রান্তি থেকে।

একটা গণ-অভ্যুত্থান যে ‘মেটিকিউলাস’ কিংবা একক ভরকেন্দ্রিক হতে পারে না এবং সর্বোপরি গণ-অভ্যুত্থানকে অর্গানিক উপায়ে বিপ্লবে রূপান্তর করতে যে ‘উৎপাদন পদ্ধতি’ (মোড অব প্রোডাকশন) ও ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ (রিলেশনস অব প্রোডাকশন) পরিবর্তন অনিবার্য, এটা ক্রিটিক্যালি পাঠ না করেই গণ-অভ্যুত্থানে আপামর শ্রেণির অবদানকে খাটো করে দেখেছেন হালের অধিপতিশীলরা।

আমি যা করেছি, সেটিই মহীয়ান, বাদ বাকি সব ‘অপর’—এই প্রবণতা থেকেই জন্ম হয় ফ্যাসিবাদের; আধিপত্যবাদী বয়ানের। এই মননের অন্তরেই ঘুমিয়ে থাকে নার্সিজম; অর্থাৎ নার্সিজম খোদ নিজেই এমন একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভরকেন্দ্র সৃষ্টিকারী, যা অধিকতর সংকটের মুখোমুখি করে ফেলে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে।

অভ্যুত্থান–উত্তর প্রথমবর্ষের মধ্যেই তার দিক উন্মোচন হতে শুরু করেছে, যা অভ্যুত্থানের প্রকৃত স্পিরিটকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বয়ান ও ক্ষমতাচর্চা তো জুলাইয়ের স্পিরিট নয়!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নড়াচড়ায় যখন কোনো কিছুই টলানো যাচ্ছিল না, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক দখলের প্রত্যাঘাত, জীবনবাজি রাখা, শহীদ হওয়া ছিল ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব বড় ঘটনা।অতীতের নিক্তিতে চব্বিশের ঐতিহাসিক অবস্থান

চব্বিশের গুরুত্ব–বীরত্ব নিঃসন্দেহে নানামাত্রিকভাবে অভূতপূর্ব। তবে এই বীরত্বকে সাতচল্লিশ ও একাত্তরের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখার নিক্তিটিও ‘অভূতপূর্বভাবে’ বিপজ্জনক! এই বয়ান কয়েকটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক লড়াইকে একবারে নাকচ করে দিয়েছে। তার মধ্যে উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান অন্যতম।

আশির দশকে প্রায় দশকব্যাপী আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনগুলো একত্র হয়ে ১০ দফা দিয়েছিল। সেসব দাবির মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সর্বোপরি শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণে উৎপাদন সম্পর্ক বদলের তৎপরতা ছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছয় ছফাকে বিস্তৃত করে ছাত্রসমাজের যে ১১ দফার ওপর দাঁড়িয়েছিল, তার কাছাকাছি দূরদর্শী রাজনৈতিক এজেন্ডা এর আগে-পরে বলতে গেলে তৈরিই হয়নি।

নতুন রাষ্ট্রপ্রকল্পের স্বপ্নে বিভোর শিক্ষার্থীদের আটষট্টি-উনসত্তরের ১১ দফার মধ্যে তিন–চতুর্থাংশ দাবি ছিল শ্রমজীবী শ্রেণির প্রশ্নে, যেগুলো উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তন ও সামাজিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছিল। আর প্রথম দফাতেই ছিল শিক্ষার আশু সংস্কারকল্পে হামুদুর রাহমান শিক্ষা কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাতিল ও শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি কমানোর দাবি। আশ্চর্যই বৈকি, বর্তমানের শক্তিশালীদের বয়ানে উনসত্তর নিয়ে কোনো কথাই নেই! 

এরও আগে দুর্দান্ত দূরদর্শী ছিল যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকেন্দ্রিক ২১ দফা, যার প্রথম আটটির মধ্যে সাতটিই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষার্থে। ৯ থেকে ১১ পর্যন্ত তিনটি দফা ছিল শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার সংস্কার প্রশ্নে।

পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের নিপীড়নমূলক স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ওই ২১ দফা হয়ে উঠেছিল সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য মুক্তির মেনিফেস্টো। তবে সেটা ছিল রাজনীতিকদের ভূমিকায় ঋদ্ধ আর আমাদের এই আলোচনা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বিচারে সীমাবদ্ধ।

চব্বিশের ‘৯ দফা’ কি মনে থাকবে

সময়ের জীবিত সন্তান হিসেবে নিজেদের সময়কে আমরা যতই বীরত্ববাচক বলি না কেন, চব্বিশের ৯ দফা পূর্ববর্তী সময়গুলোর দাবি-দফার তুলনায় বরং অনেক বিবর্ণ-ম্রিয়মাণ। এগুলো দিয়ে অতীতের ধারাবাহিকতাকেও স্পর্শ করা যায় না, আবার ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথও নির্ধারণ করা যায় না। তা ছাড়া একাত্তরের পর সবচেয়ে বৃহদাকার হত্যাকাণ্ড ও জুলুমের পর ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া’র মতো নিরীহ দাবি যেখানে সর্বাগ্রে অলংকৃত হয়, সেই দাবিনামা আন্দোলনের নেতারা স্বভাবতই ভুলে যেতে চাইবেন, এ আর আশ্চর্য কী!

বস্তুত, চব্বিশের যে ৯ দফা, তার কটিই–বা মনে রেখেছেন খোদ নেতারা কিংবা সাধারণ মানুষ? এগুলো কি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিশা দিতে পারে? অনিবার্যভাবেই না।

এই ৯ দফার প্রতিটিই ইস্যুভিত্তিক ও চব্বিশের আন্দোলনকেন্দ্রিক। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এই দাবিগুলোতে স্থান পাওয়ার যোগ্যই বিবেচিত হয়নি; কিংবা দাবিদাওয়ার প্রণেতারা সম্ভবত অতীতের ছাত্রনেতাদের মতো দূরদৃষ্টি দিয়ে ভাবেনইনি বিষয়গুলো।

চব্বিশের ‘ব্রাত্যকরণ প্রকল্প’

চব্বিশের জুলাইয়ের ‘৩৬ দিন’ ছিল বিপুল সম্ভাবনা ও অসামান্য বীরত্বময়। জুলুমের অপর পৃষ্ঠে একটা অসাধারণ সম্ভাবনাময় সময়ের জন্ম দিয়েছিল চব্বিশের জুলাই। কিন্তু সালতামামিতেই প্রশ্নটা আসবে, সেই সম্ভাবনাকে কি রক্ষা করা গেল? দঙ্গলবাজি ও মবতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত কি গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করেনি?

নানা শ্রেণি–পেশা, জাতি–ধর্ম–বর্ণ–গোত্রের বিপুল প্রান্তিক মানুষ কীভাবে শুধু সংখ্যাগুরু ও ক্ষমতাবানের অহমিকার বলি হয়ে গেল অভ্যুত্থানের পর, সেই প্রশ্নের জবাব তো সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে দিতে হবে। অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেলেও ন্যূনতম কোনো ভাবনা-ভাবনান্তর প্রান্তজনদের জন্য বরাদ্দ নেই। উল্টো জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নারীরা অভ্যুত্থানের পর আরও কোণঠাসা হয়েছেন।

সত্যের খাতিরে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে শিক্ষাব্যবস্থার ভয়ংকর দার্শনিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় কর্মসংস্থানব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলনটির দর্শনগত সীমা খুবই সংকুচিত। যে কারণে দাবিদাওয়ায় নেই কৃষক-শ্রমিকের কথা; অথচ সরকারি গেজেটভুক্ত ৮৪৪ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৮৪ জন সাধারণ শ্রমজীবী ও ১২০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন (দৈনিক প্রথম আলো, ২০ জুলাই, ২০২৫)।

এই যে সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্গকে অপর ও ব্রাত্য করার প্রকল্প, তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি লোপাট করা, এগুলো কি বৈষম্যবিরোধী অবস্থান?

আরও নেই শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো রূপরেখা; কথা নেই অভূতপূর্ব সাড়া দেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত কলেজ ও অপরাপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর—যাদের শহীদের সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। বিশেষত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঝাঁপিয়ে না পড়লে অভ্যুত্থান আদৌ সফল হতো কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অথচ সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই আজ ব্রাত্য!

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বড়দের পাঠশালায় ‘কোমলমতি’ ভাবা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। নামের সংক্ষিপ্ত রূপটিও (বেবি) কী আশ্চর্যজনক আক্ষরিক সার্থকতায় ভাস্বর! অবস্থাপন্নদের সন্তান, রাজনীতি-সমাজবিমুখ, দেশ নিয়ে ভাবনাহীন, বিদেশে এক পা দেওয়া, সারাক্ষণ শুধু সিজি সিজি (সিজিপিএ) জপা, পশ-জোস-বস করপোরেট কালচার সিনড্রোম, ফাস্ট ফুড, আপেল ও ব্রয়লার খাওয়া এবং সর্বোপরি, ‘আই হেট পলিটিকস’—কোমলমতি, তথা বেবি অভিধা দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী প্রয়োজন! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এভাবে দেখার প্রবণতা ‘প্রাচীন প্রস্তর যুগ’ থেকেই চলে আসছে। অথচ তাঁরাই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন! 

আন্দোলনের একপর্যায়ে গত বছরের ১৬ জুলাই রাতে ইউজিসি একযোগে সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়ার এখতিয়ার-বহির্ভূত আদেশ দেয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ থেকে ছাত্র হত্যাকাণ্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আদেশের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, যেখানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক অংশ নেন। শিক্ষকদের এই প্রতিবাদী অবস্থান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক পরোক্ষ দাবানলের সৃষ্টি করে। 

হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৮ জুলাই, যে সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উপায়ন্তর না পেয়ে শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় রাষ্ট্র ও সরকারকে প্রত্যাঘাত করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশেষত ঢাকার রামপুরা থেকে উত্তরা পর্যন্ত পুরো প্রগতি সরণি ও কুড়িল বিশ্বরোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। ২ আগস্ট শুক্রবার, ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অভ্যুত্থানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন ব্রাত্য