ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের যুগ তথ্য ও আধুনিকতার। প্রযুক্তি যত উন্নত হোক না কেন, তা হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের স্বভাব উন্নত করতে পারেনি। অনিবার্য অফুরন্ত কাম-বাসনার নিপীড়ন, মানব জাত—তার প্রত্যেক সদস্যকে নিজের জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। দার্শনিক যাঁরা, তাঁরা এই হাজার হাজার বছর ধরেই গভীরভাবে মানুষের অস্তিত্বকে নিয়ে বলে গেছেন, ইশারা-বাণী রেখে গেছেন। তেমনই এক উক্তি—‘নিজেকে চেনো’। কেননা, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে জ্ঞানীদের বাণীকে নিজ প্রাণে বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা, জীবন সমাধান পুনরায় খোঁজার আমন্ত্রণ। অনিত্য পেরিয়ে নিত্য আত্মজ্ঞান হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রথম শর্ত। আত্মজ্ঞান লাভের ফলে চলে আসে অনিত্য অনুভূতি-সহানুভূতি, যার ফল নৈতিকতা অর্থাৎ আত্মশাসন ও সংযম।
তবু সত্য যদি শুধু সত্য হয়ে থাকে, নিজ নিজ অন্তরে তার উপলব্ধি ঘটে। পরের কথা বা কর্মকে মনগড়া বিশ্লেষণই করা যায় বুদ্ধির নেশা বা ভ্রমে পড়ে, আর সেখানে অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। আজ হাতে হাতে ঘরে ঘরে মুহূর্তেই বিশ্বের খবর দেখতে পেলেও, আপন ঘরের খবর জানার আহ্বান কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ হয় না।
কিন্তু দিন শেষে সর্বজনীন ভাবুক খুব কম পাওয়া যায়, যাঁরা নিজের বার্তায় জাত-বর্ণ-লিঙ্গ ভেদাভেদ, দ্বেষাদ্বেষীর বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে দাঁড়িয়েছেন। তার ওপর, হাতে গোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে, যাঁরা বাস্তব পরীক্ষিত সাধনার পথ অন্বেষণ করে গেছেন। অসংশয়িত ফকির লালন সাঁইজি এই দুষ্প্রাপ্য ধারার একজন। তাঁর বাণীতে—‘কথায় যদি ফলে কৃষি, বীজ কেনে রোপে/ গুড় বললে কি মুখ মিষ্ট হয়, দীপ না জ্বাললে আঁধার কি যায়’ ধ্বনিত করে সুরা বাকারার ৪৪ নম্বর আয়াত—‘তোমরা লোকদের সৎ কাজে আদেশ করছ, কিন্তু নিজেদের সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছ/ তোমরা গ্রন্থ পাঠ করলেও হৃদয়ঙ্গম করছ না’। তবে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক বা সামাজিক কোন কোন উপাদান দিয়ে সাঁইজি তাঁর মতাদর্শে পৌঁছেছেন, সে বিশ্লেষণ আসলে অপ্রাসঙ্গিক, মূল সারবস্তু থেকে সরে এসে অহেতু তর্কে জড়ানো। কেননা, তাঁর চিন্তা এই বাণীতে স্পষ্ট—‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান’।
তবু সত্য যদি শুধু সত্য হয়ে থাকে, নিজ নিজ অন্তরে তার উপলব্ধি ঘটে। পরের কথা বা কর্মকে মনগড়া বিশ্লেষণই করা যায় বুদ্ধির নেশা বা ভ্রমে পড়ে, আর সেখানে অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। আজ হাতে হাতে ঘরে ঘরে মুহূর্তেই বিশ্বের খবর দেখতে পেলেও, আপন ঘরের খবর জানার আহ্বান কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ হয় না।কেমন? প্রত্যেক মানুষ যে অদ্বিতীয় ও একাকী, সেটা সাঁইজি বারবার স্মরণ করে দিয়েছেন, যেমন জনপ্রিয় এই বাণীতে—‘ভবে কেউ কারও নয় দুঃখের দুঃখী’, ‘আসতে একা, যেতে একা, এই ভব পীরিতের ফল আছে কি?’ যার সমাধান: ‘আল্লাহ্ বল মন রে পাখি’। আবেগ থেকে যদি বেগ বাদ দেওয়া যায়, সেই প্রথম অক্ষর হৃদয়ের অধর সত্তার উপস্থিতিকে বোঝায়। তখন জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যাবে, বাস্তবে। ‘নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে/আকার সাকার হইল সে/যেজন দিব্যজ্ঞানী হয়/সেহি জানতে পায়/কলি যুগে হলো মানুষ অবতার’ (‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার ভবে’)। আকারে যে সাকার প্রকাশ পায়, দেহে ও স্থূল জীবনযাত্রায়, সেটাকে ভিত্তি করে, বর্তমানে শিকড় লাগে, সূক্ষ্মতম জ্ঞান অর্জন করার সম্ভাবনা প্রত্যেক মানুষ রাখে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রয়েছে, সেটাও প্রশ্নাতীত। ‘আপন ঘরের খবর নে না/ অনাসে দেখতে পাবি কোন খানে সাঁইর বারামখানা’।
কিন্তু সাঁইজি শুধু তাঁর বাণীতে অবস্থিত নন। পহেলা কার্তিকে তাঁর তিরোধান দিবস পালন করা হয় ছেঁউড়িয়ায়, যেখানে তাঁর মরদেহ মাটিতে রাখা হয়েছে ১৮৯০ সালে। সাঁইজি এখনো বেঁচে আছেন তাঁর পরম্পরার মধ্য। কাল-স্থান-পাত্রের ঊর্ধ্বে যাঁরা তাঁর পথ অনুসরণ করতে থাকেন, ধারণ করতে থাকেন, আত্মজ্ঞানী-ব্রহ্মজ্ঞানীদের কাছে গিয়ে নিজেকে মানুষের মতন মানুষ গড়ে তোলার অনুরাগ পোষণ করতে থাকেন, ‘মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’, তাঁদের কাছে লালন সাঁইকে পাওয়া যায়। সোজা কথায়, নিত্যবস্তু অনুসারে লালন সাঁই ও তাঁর সাধুগুরুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
সাঁইজি শুধু তাঁর বাণীতে অবস্থিত নন। পহেলা কার্তিকে তাঁর তিরোধান দিবস পালন করা হয় ছেঁউড়িয়ায়, যেখানে তাঁর মরদেহ মাটিতে রাখা হয়েছে ১৮৯০ সালে। সাঁইজি এখনো বেঁচে আছেন তাঁর পরম্পরার মধ্য। কাল-স্থান-পাত্রের ঊর্ধ্বে যাঁরা তাঁর পথ অনুসরণ করতে থাকেন, ধারণ করতে থাকেন, তাঁদের কাছে লালন সাঁইকে পাওয়া যায়।তাহলে মানুষ কাকে বলে? সাধুগুরুর বার্তায় কিছু খোঁজ পাওয়া যায়। সব ধর্মের মতে মানুষ শ্রেয়, শ্রেষ্ঠ। কেন? কারণ, বাকি জীবজন্তুর চেয়ে মানুষের আলাদা শক্তি আছে। জীবজন্তু ভালোমন্দ জ্ঞান-বিবেচনা দিয়ে নিজের চলাফেরা বা পরিবেশকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। পরিবেশ ও স্বভাবের তাড়না তাদের কর্ম নির্ধারণ করতে থাকে। তাদের ইচ্ছাশক্তিও নেই। তাই যে নিকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, সে উৎকৃষ্ট বা সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারে মাত্র। বাংলা ভাষায় ‘মানুষ’ শব্দের বানান নিয়ে দারুণ একটা খেলা দেখা যায়: ‘ম’-তে মৈথুন, ‘আ’-তে আহার ও ‘ন’-তে নিদ্রা। যেটা সব সৃষ্টির মধ্যে পাওয়া গেলেও, কেবল মানুষ তাঁর ‘মান’ অর্থাৎ রুচি গঠন, ও ‘হুঁশ’ অর্থাৎ চেতনা জাগ্রত করতে পারে। এই দুই শক্তি দিয়ে ওই তিনটি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষেরই আছে। দুটো প্রবাদবাক্য শোনা যায়: ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’ এবং ‘আহার নিদ্রা ভয়, যত করি, তত হয়’। প্রবৃত্তি বা স্বভাবকে চিনে, কুস্বভাবকে যদি স্বীকার করা যায়, তবে উদ্যম করে অভ্যাসকে গঠনমুখী চালাতে চালাতে, সেই কুস্বভাবকেও ত্যাগ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ সাঁইজির এই দৈন্য পদ পাওয়া যায়—‘কারে দেব দোষ, নাহি পরের দোষ, আপন মনের দোষে পলাম রে ফেরে/মন যদি বুঝিত, লোভের দেশ ছাড়িত, লয়ে যেত আমায় বিরজাপারে’।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা যেমন বলেন, দুর্ঘটনার মধ্যে নয়, ঘটনা সামলানো ও মোকাবিলায় আমার পরিচয়, তেমনই স্বীকার যদি করা যায় যে আপন অজ্ঞানের সম্বন্ধে কেউ জ্ঞান রাখে না, তবে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। এ জন্য সঙ্গের কথা বারবার বলা হয়, যেমন এই দুটি বাণী:
‘ভুলব না ভুলব না বলি/কাজের বেলায় ঠিক থাকে না/আমি বলি, ভুলব না রে স্বভাব ছাড়ে না মোরে/…রঙ্গে মেতে সঙ্গ সাজিয়ে বসে আছি মগ্ন হয়ে/ সুসখারে সঙ্গ করে জানতাম যদি সুসঙ্গেরে/ লালন বলে তবে কী রে/ ছেঁচড়ে মারে মালখানা’।
সাঁইজি তাঁর পরম্পরার মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন, আপন চরিত্র তৈরি করতে হয় আয়নার সামনে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে, অর্থাৎ গুরুর কাছে সমর্পিত হয়ে। চরিত্র হয় প্রবৃত্তি ও নীতির সমন্বয়ে। সাধুগুরু জানায়, মানুষ তাঁর চরিত্রে অমরতাপ্রাপ্ত হতে পারেমাত্র। আরেকটা কথা শোনা যায় সাধুগুরুর কাছে: ‘প্রেমশূন্য হৃদয় ও জলশূন্য মোহনা একই সমান’। এখানে দুটো প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রথম প্রশ্ন—সাধু কাকে বলে? দ্বিতীয় প্রশ্ন—প্রেম কাকে বলে? সত্ত্বঃগুণেই সাধু। সত্ত্বঃ গুণ কী? আপন স্বার্থ শূন্য থাকার প্রবণতা। আপন স্বার্থই কাম। সত্ত্বঃ গুণ শুধু কর্মে প্রকাশিত নয়, ভাবে ও চিন্তায়ও প্রকাশ পায় আপন বিচারে—যদি মন বা নফসের বিয়োগ ঘটানো যায়। এ জন্য লালনের এক বাণীতে পাওয়া যায়—‘শুনেছি সাধু করুণা, সাধুর চরণ পরশিলে হয় গো সোনা’—করুণাই প্রেম, স্বার্থশূন্যতায় প্রেম। আপন কল্যাণ শিখতে পারলে পরের কল্যাণ করা যায়…
সাধনা করতে হয় অষ্টসিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতার লোভে নয়, বরং নিজেকে ফকির বানাতে, অষ্টপাশকে কোরবানি দিতে। ত্যাগে যেমন সত্ত্বঃ গুণের প্রকাশ, ত্যাগেই সাঁইজির ঠিকানা। জয় গুরু!
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রক শ অর থ ৎ র খবর
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের ‘সুরাইয়া’ পাচ্ছে ৫৭ লাখ টাকার সহায়তা
বার্লিন ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড থেকে ৪০ হাজার ইউরোর (প্রায় ৫৭ লাখ টাকা) তহবিল পাচ্ছে ‘সুরাইয়া’। বার্লিন ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ডের জন্য ৬৩টি দেশ থেকে ২৩৬টি সিনেমার প্রকল্প জমা পড়ে। এর মধ্যে তহবিল পাচ্ছে আটটি সিনেমা। এশিয়া থেকে পেয়েছে দুটি সিনেমা। একটি বাংলাদেশের ‘সুরাইয়া’; পরিচালনা করবেন রবিউল আলম। তিনি রবি নামেও পরিচিত। তিনি এর আগে চরকির ‘ঊনলৌকিক’, ‘ক্যাফে ডিজায়ার’ বানিয়ে প্রশংসা পেয়েছিলেন। সিনেমাটির প্রযোজক ফজলে হাসান। এশিয়া থেকে তহবিলের জন্য নির্বাচিত আরেকটি সিনেমা হলো কম্বোডিয়ার ‘টু লিভ টু স্টে’। এটি নির্মাণ করবেন দানেচ সান।
বর্তমানে নরওয়েতে রয়েছেন পরিচালক রবিউল আলম। হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে রবি বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড পৃথিবীর অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক একটি ফান্ড। শৈল্পিক ও নান্দনিক বিচারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্ভাবনাময় ছবিগুলো এখানে প্রতিযোগিতা করে। ফলে এ ফান্ড ‘সুরাইয়া’র জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নির্মাণ সহায়তার পাশাপাশি এর ফলে ছবিটির প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ সৃষ্টি হবে। যা ছবির বৈশ্বিক প্রদর্শন ও পরিবেশনার পথ সুগম করবে। এটা আমাদের দায়িত্বকে আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।’
সিনেমাটির প্রযোজক ফজলে হাসান বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্ডি ফিল্ম (স্বাধীন ধারার সিনেমা) নিজস্ব উদ্যোগে শুরু করতে হয়। দেশ থেকে তেমন কোনো লগ্নি মেলে না; বরং নানা কথা শুনতে হয়। সেখানে বার্লিনের মতো একটি বড় জায়গা থেকে আমাদের এ সহায়তা অনেক বড় ভরসার জায়গা তৈরি করে দিল। এটা আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সিনেমার বৈশ্বিক শৈল্পিক মূল্য রয়েছে। এ ফান্ড আমাদের কাছে সাহসের নাম। মনে হচ্ছে, আমরা সিনেমাটি নিয়ে সঠিক পথেই রয়েছি।’
রবিউল আলম রবি। চরকির সৌজন্যে