চলতি সপ্তাহেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। তাই ফুটপাত থেকে শুরু করে বিপণিবিতানে সর্বত্রই চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। যদিও ক্রেতাদের ভিড় তুলনামূলক কম। কারণ, ঈদের লম্বা ছুটি শুরু হওয়ায় ঢাকা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। এর মানে, ঢাকায় ঈদের বেচাবিক্রির বড় অংশই গত সপ্তাহে শেষ। তবে মফস্‌সলে এখন জমজমাট কেনাবেচা চলছে।

ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায়ে এবার ভালো করছে নামীদামি কিছু ব্র্যান্ড। তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ১০ শতাংশ বা তারও বেশি। তবে কোনো কোনো ব্র্যান্ডের ব্যবসা অবশ্য গতবারের চেয়ে খানিক কমেছে। সে জন্য তারা শেষ মুহূর্তে বড় মূল্যছাড় দিয়ে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

একাধিক ব্র্যান্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ ছিল। তারপরও ক্রেতারা কেনাকাটা করেছেন। ব্যবসা যা হয়েছে, সেটি সন্তোষজনক।

গত শতকে দেশে আড়ং, অঞ্জনস, রঙসহ হাতে গোনা কয়েকটি পোশাকের ব্র্যান্ড ছিল। দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ায়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা থাকায় গত দুই দশকে বেশ কিছু ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে। পোশাকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেলে নতুন একটি ধারা সংযোজন করতে পারায় ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো।

বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে আড়ং, সেইলর, লা রিভ, টুয়েলভ, ইয়েলো, সারা লাইফস্টাইল, জেন্টল পার্ক, ক্যাটস আই, এক্সটাসি, রিচ ম্যান, লুবনান, ইলিয়ান, ক্লাব হাউস, ইজি ফ্যাশন ইত্যাদি। অন্যদিকে শুধু দেশি পোশাকের জন্য সাদাকালো, ক্রে ক্র্যাফট, রঙ বাংলাদেশ, দেশাল, বিবিয়ানা, যাত্রা, নিপুণসহ কয়েকটি ফ্যাশন হাউস বেশ জনপ্রিয়।

রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, রোজার প্রথম ৮–১০ দিন ক্রেতাদের উপস্থিতি কম ছিল, তারপর বেড়েছে। দিন দুয়েক ধরে আবার কমছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বিক্রিতে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আশা করছি, শেষ পর্যন্ত ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। কারণ, ঈদের আগের কয়েক দিন মফস্‌সলে ভালো ব্যবসা হয়। তিনি জানান, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রঙ বাংলাদেশের ২০টি বিক্রয়কেন্দ্র আছে।

নব্বইয়ের দশক থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ইপিলিয়ন গ্রুপ। ১০ বছর আগে যমুনা ফিউচার পার্ক ও ধানমন্ডিতে দুটি বিক্রয়কেন্দ্র দিয়ে সেইলর নামে পোশাকের ব্র্যান্ড গড়ে তোলে গ্রুপটি। বর্তমানে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৩। চলতি বছর ভোলা ও নরসিংদীতে নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে তারা। গত ২৫ রমজান পর্যন্ত তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি হয়েছে। নতুন দুই বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া হিসাব করলে ব্যবসা গতবারের চেয়ে ৩২ শতাংশের মতো বেড়েছে।

— ঈদের বেচাবিক্রি এখন ঢাকায় কম, তবে মফস্‌সলে বেশ জমজমাট।
— যাদের বিক্রি কম, তারা শেষ মুহূর্তে বড় মূল্যছাড় দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
— ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা থাকায় দিন দিন নতুন নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সেইলরের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) রেজাউল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় সব বিক্রয়কেন্দ্রেই আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। পোশাকের মান ও নকশার উন্নয়নে আমরা বেশ আগে থেকেই বিনিয়োগ করেছি। সেটির ব্যবসায়িক সুফল আমরা এবার বেশ ভালোভাবে পেয়েছি।’

দেড় দশক আগে ঢাকার উত্তরা ও বনশ্রীতে ছোট্ট দুটি বিক্রয়কেন্দ্র নিয়ে পোশাকের ব্র্যান্ড লা রিভের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে চলতি বছরে নতুন পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে তারা। ঈদে লা রিভের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে।

এমন তথ্য দিয়ে লা রিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মন্নুজান নার্গিস প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের কেনাকাটায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কিছুটা হলেও পড়েছে। গতবারের চেয়ে বড় বিল কম হয়েছে। আগে যাঁরা দু–তিনটি পোশাক কিনতেন, তাঁরা একটি করে কিনেছেন।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক টিম গ্রুপের দেশি পোশাকের ব্র্যান্ড হচ্ছে টুয়েলভ। বর্তমানে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৮। তাদের বিক্রি গত বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বাড়তি। গতবার যতগুলো বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, সেগুলো হিসাবে নিলে বাড়বে ১১ শতাংশের মতো।

এমন তথ্য দিয়ে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘কিছু ক্যাটাগরিতে আমরা বেশ ভালো করেছি। দুই–একটিতে ভালো হয়নি। সব মিলিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছি। তারপরও ব্যবসা সন্তোষজনক।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা পণ্যের মান উন্নয়নে বেশ জোর দিয়েছি। আগামী দুই বছরে সেটির সুফল আরও বেশি মিলবে।’

শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপের পোশাকের আরেক ব্র্যান্ড সারা লাইফস্টাইলের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বর্তমানে ১৫। সব মিলিয়ে এবারের ঈদে তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে গতবার যতগুলো বিক্রয়কেন্দ্র ছিল, সেটি আমলে নিয়ে ব্যবসায়ে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ।

সারা লাইফস্টাইলের হেড অব অপারেরশন মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ম্যানস, লেডিস ও গার্লস—এই তিন শ্রেণির পোশাক ভালো বিক্রি হয়েছে।’ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ছুটি শুরু হওয়ায় ঢাকার বেচাবিক্রি কমে গেছে। মফস্‌সলে চলছে।

শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু হয় ইজি ফ্যাশনের। বর্তমানে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র আছে ৯১। গত এক বছরে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র বেড়েছে পাঁচটি। তবে এবারের ঈদে গতবারের চেয়ে বেচাবিক্রি প্রায় ১০ শতাংশ কম হয়েছে তাদের।

এমন তথ্য দিয়ে ইজি ফ্যাশনের পরিচালক তৌহিদ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর ব্যবসা অনেক ভালো হয়েছিল। সেই তুলনায় এবার কিছুটা কম হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেকের মতো আমাদেরও বিক্রি কম হয়েছে। তবে যতটুকু খারাপ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তার চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে ব্যবসা।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব ক রয়ক ন দ র র স খ য ত দ র ব ক রয়ক ন দ র গতব র র চ য় প রথম আল ক প রব দ ধ ব যবস য় র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ