ফলমূল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সীমাবদ্ধতার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। দ্রুত পচনশীল খাদ্যপণ্য সংরক্ষণ করতে না পারায় কৃষকেরা কম দামে বিক্রি করে দেন কিংবা ফেলে দিতে বাধ্য হন। এতে তাঁদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে স্মার্ট ড্রায়ার নামের কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফল, শাকসবজি, ভেষজ উদ্ভিদ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে খাদ্যপণ্যের অপচয় ঠেকানো সম্ভব। সম্প্রতি সে রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেকের দৃষ্টি কেড়েছেন নওগাঁর কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা (৪২)।
শুরুটা সোহেল রানা করেছিলেন কাঁচা ও পাকা আম শুকিয়ে সংরক্ষণের জন্য। পরে এই কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে টমেটো, ফুলকপি, মরিচ, বিটরুট, পরিপক্ব কলা, বরই, অর্জুন বৃক্ষের ছাল, আদা, অ্যালোভেরা, লেবু, নিমপাতা, শজনেপাতা ও পেয়ারাপাতা শুকিয়ে সংরক্ষণ করছেন। এমনকি ফেলনা কলার খোসা পর্যন্ত শুকিয়ে গুঁড়া করে সার হিসেবে বিক্রি করছেন।
তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাড়ি নওগাঁর সাপাহার উপজেলা সদরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২৩ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার পেয়েছেন সোহেল রানা। এই তরুণের আছে দুটি মিশ্র ফলবাগান ও তিনটি আমের বাগান।
সোহেল রানার স্মার্ট ড্রায়ারের কার্যকারিতা দেখে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে উৎপাদিত আমের প্রায় ৩০ শতাংশ গাছ থেকে সংগ্রহ করার আগে ও পরে নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সীমাবদ্ধতার কারণে এই বিপুল অপচয় হয়। স্মার্ট ড্রায়ার ব্যবহার করে এই অপচয় অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। শুধু আম নয়, স্মার্ট ড্রায়ার ব্যবহার করে অন্যান্য ফল, শাকসবজিসহ মৌসুমের সময় বিভিন্ন কৃষিপণ্য শুকিয়ে সংরক্ষণ করে অপচয় রোধ করা সম্ভব। দীর্ঘ সময় ধরে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ করলে আর্থিকভাবেও লাভবান হওয়া সম্ভব।’
কী এই স্মার্ট ড্রায়ার
খাদ্যপণ্য শুকানোর কাজে বিশেষ ধরনের বদ্ধ ঘরকে বলা হয় স্মার্ট ড্রায়ার হাউস। ঘরটি স্বয়ংক্রিয়, নিজ থেকেই খাদ্যপণ্য শুকানোর কাজ করতে পারে। ঘরের ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে রাতেও সক্রিয় থাকে ঘরটি।
এই ঘরে দুটি এগজস্ট ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে, যা খাদ্যপণ্য থেকে বের হওয়া পানি দ্রুত বাইরে বের করে দেয় এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। ঘরটি ১৪ ফুট দীর্ঘ, প্রস্থে ১১ ফুট, আর উচ্চতা ১০ ফুট। ঘরের ভেতরে তাপ সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে আটটি পাখা ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে দুটি কুলিং ফ্যান। মোবাইল ফোনে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে ঘরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একসঙ্গে প্রায় ৫০০ কেজি খাদ্যপণ্য শুকানো যায় এই ঘরে।
সোহেল রানা জানান, স্মার্ট ড্রায়ারে ভেষজ উদ্ভিদ ও খাদ্যপণ্য শুকাতে ৩০ থেকে ৫০ ঘণ্টা সময় লাগে। প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের তাপে খাদ্যপণ্য শুকাতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। আবার প্রাকৃতিকভাবে খোলা আকাশের নিচে খাদ্যপণ্য শুকালে তাতে ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। খাদ্যপণ্যের রংও নষ্ট হয়ে যায়। এতে বাজারজাত করতে সমস্যা হয়। স্মার্ট ড্রায়ারে এই সমস্যাগুলো নেই।
অনলাইনে একটি লেখা পড়ে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন সোহেল রানা। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশিং অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর কাছে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি সোহেল রানার বাগানে ঘর স্থাপনে সহায়তা করেন।
জানতে চাইলে মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, সব কৃষি উদ্যোক্তারই এই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা উচিত। ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা হলেই ছোট পরিসরে একটি স্মার্ট ড্রায়ার স্থাপন করা সম্ভব। শুকানো খাদ্যপণ্যের মধ্যে পানির পরিমাণ ৩ থেকে ৫ শতাংশ রাখা হয়। পরিপূর্ণভাবে শুকানোর পর খাদ্যপণ্যকে মেকানিক্যাল মিলিং মেশিনে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গুড়ো করা হয়, যাতে পণ্যের পুষ্টিমানের কোন পরিবর্তন না হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিং করে উন্নত প্যাকেজিং করে বাজারজাত করা হয়। ফলে খাদ্যপণ্যটি দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
সোহেল রানার বাগানে স্থাপিত স্মার্ট ড্রায়ার হাউস। বিশেষ ধরনের বদ্ধ এই ঘরে খাদ্যপণ্য শুকানো হয়। সম্প্রতি নওগাঁর সাপাহারে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ দ যপণ য শ ক ন ব যবহ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
কাজের আনন্দই জীবনের সার্থকতা
জন্মদিনের অনুষ্ঠান নয়, তবে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটি ছিল সে উপলক্ষেই। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ও সুবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ছিল গত ২৫ জুলাই। তাঁর অগণিত অনুরাগীরা চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, তারপর আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে কিছুতেই সম্মত হননি তিনি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ষষ্ঠতলায় কেন্দ্রের প্রাক্তনী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজন আলাপচারিতার এক ঘরোয়া আয়োজন করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে। সেখানে তিনি বললেন, কাজের মধ্য দিয়ে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছেন, সেটিই জীবনের সার্থকতা। এই আনন্দই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।
এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তিনি তাঁর চিরপরিচিত সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গভীর তাৎপর্যময় কথায় উত্তর দিয়েছেন। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠন, প্রেম–ভালোবাসা—সবকিছু উঠে আসে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক কথোপকথনে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু কালজয়ী লেখকের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। এক অন্তরঙ্গ প্রাণবন্ত আবহ বিরাজমান ছিল সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি এই আয়োজনে।
আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তিনি কবিতার চর্চা করেননি কেন? জবাবে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমান একবার তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে কবিত্বের ঘাটতি আছে। তাঁর নিজেরও সে রকম মনে হয়েছে। তারপর সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও অনেক রকম কাজ করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন, এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন, কী আশা করেন তাদের কাছে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তরুণেরা কী হবে, তা তরুণদের ওপরে নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে আমরা তাদের কী বানাতে চাই, তার ওপর। দেখতে হবে তরুণদের গড়ার মতো আমাদের ক্ষমতা কতটা আছে। অর্থাৎ শিক্ষক কেমন হবে, তার ওপরে নির্ভর করে তাঁর ছাত্র কেমন হবে। সক্রেটিস শিক্ষক ছিলেন বলে ছাত্র প্লেটো হয়েছেন। প্লেটোর শিক্ষা পেয়ে ছাত্র অ্যারিস্টটল হতে পেরেছেন। বড়দের যদি বড়ত্ব না থাকে, তবে ছোটরা বড় হতে পারে না। দুর্ভাগ্য যে আমরা বড়রা তাদের সামনে আদর্শ দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে এখন বড়দেরই ছোটদের পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে।’
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম জানতে চান, তিনি এত বিচিত্র ধরনের এত বিপুল কাজ করেছেন। এই প্রাণশক্তি পান কেমন করে?
উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শক্তি আসে আনন্দ থেকে। কাজ করতে পারাটাই আনন্দের। আর সব সময় আশাবাদী থাকি। আশা কখনো শেষ হয় না। আশা শেষ মানে আমি শেষ।’
আলাপচারিতায় আরও অংশ নেন দুদক চেয়ারম্যান এম এ মোমেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, চিকিৎসক আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী খায়রুল আলম সবুজ, কথাশিল্পী আনিসুল হক, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার, অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, মশিউর রহমান, আলী নকী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনী খাদিজা রহমান।