বিপুল ব্যয়ের সড়ক, তবু থাকছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি
Published: 16th, April 2025 GMT
মহাসড়কটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে বিপুল ব্যয়ের এ মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত গতিতেও চলাচল করতে পারবে না যানবাহন।
এটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। ২০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। যদিও এ মহাসড়কের প্রায় পুরোটা ঘেঁষে রয়েছে শিল্পকারখানা, হাটবাজার, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মানুষ ও স্থানীয় যানবাহন পারাপার করতে হবে মহাসড়কের ওপর দিয়ে। থাকছে না পাতালপথ বা নিরাপদ পারাপারের ব্যবস্থা। অর্থাৎ নকশায় ঘাটতি রেখেই চলছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটির সম্প্রসারণের কাজ।
পুলিশ ও সড়ক দুর্ঘটনা–সংক্রান্ত গবেষণা অনুসারে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দেশের অন্যতম শীর্ষ দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক। পুলিশের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে এ মহাসড়কে ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চার শতাধিক মানুষের। তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু মামলা হয়েছে—এমন দুর্ঘটনাই পুলিশের হিসাবে আসে। বাস্তবে মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি।
বিদ্যমান নকশায় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। মহাসড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে এর আশপাশে শিল্পায়ন ও স্থাপনা বাড়বে। এখনই এর সমাধান না করলে ভবিষ্যতে বিপদ হবে।অধ্যাপক সামছুল হক, পরিচালক, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েটঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সওজ। সওজের একটি সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। তখন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২২টি ওভারপাস ও ২৭টি পাতালপথসহ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বেশ কিছু বিষয় বাদ দেয়। তখনই সড়কের নকশা প্রণয়নে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এতে সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। যানবাহন কাঙ্ক্ষিত গতিতে চলতে পারবে না।
মহাসড়কটির জন্য নিয়োগ দেওয়া পরামর্শকদের প্রতিবেদন অনুসারে, মূল নকশা অনুসারে মহাসড়কটি সম্প্রসারণ না হওয়ার কারণে জায়গায় জায়গায় স্থানীয় যানবাহনকে মূল মহাসড়ক দিয়ে পারাপার করতে হবে। স্থানীয় যানবাহনগুলোর মূল মহাসড়কে প্রবেশ বা বের হওয়ার ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও দূরপাল্লার যানবাহনের গতি কমে যাবে। বড় বড় মোড়ে বা গোলচত্বরের মতো জায়গায় যানবাহনের আটকে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পে গতানুগতিক যেসব পদচারী–সেতু রাখা হয়েছে, সেগুলো বয়স্ক, শিশু কিংবা শারীরিকভাবে সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী নয়।
প্রকল্প থেকে নিয়োগ করা পরামর্শকদের প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করতে সওজের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হককে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান নকশায় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে যানজট তৈরির মতো বিশৃঙ্খল অবস্থা রয়ে যাবে। মহাসড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে এর আশপাশে শিল্পায়ন ও স্থাপনা বাড়বে। এখনই এর সমাধান না করলে ভবিষ্যতে বিপদ হবে।
অধ্যাপক সামছুল হক আরও বলেন, বাংলাদেশে মানুষ মরার পর সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বরং মৃত্যু কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা আগেই ভাবতে হবে। এটাই এখন আন্তর্জাতিক রীতি।
‘মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত’ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২০৯ কিলোমিটার চার লেন করা হচ্ছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হচ্ছে আরও প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ১৪ শতাংশ।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে গিয়ে সওজ বলেছে, এটি এশিয়ান হাইওয়ে, বিমসটেক করিডর এবং সার্ক হাইওয়ে করিডরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ, বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ স্থাপন; স্থানীয় ও ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণের মাধ্যমে সড়কের নিরাপত্তা বৃদ্ধি; পাশাপাশি সড়ক ব্যবহার করা বয়স্ক, নারী, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ এবং দুর্ঘটনা ও সড়ক নিরাপত্তাঝুঁকি হ্রাস করা।
২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে সড়কের নকশা, নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটিকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, খরচ কমাতে গিয়ে কিছু অঙ্গ বাদ দেওয়ার ফলে সড়ক নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও কাঙ্ক্ষিত গতিতে যানবাহন চলতে না পারার ঝুঁকি সম্পর্কে শুরু থেকেই তাঁরা ওয়াকিবহাল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। এখন বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
যা যা থাকছে প্রকল্পেপ্রকল্পের আওতায় সড়ক সম্প্রসারণ ছাড়াও ৬৬টি ছোট-বড় সেতু এবং ৩০৫টি কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৬টি পদচারী–সেতু ও ১৩টি ওভারপাস রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর মতো ব্যস্ত শহরেই মানুষ পদচারী–সেতু ব্যবহার করে না। মহাসড়কে ২৬টি পদচারী–সেতু সেভাবে কাজে লাগবে না।
সওজ সূত্র জানায়, মহাসড়কের পাশে ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২০৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মহাসড়ক ঘেঁষে আছে ৫১টি বাজার। ২৮টি স্থানে মহাসড়কে গুরুত্বপূর্ণ অন্য সড়ক যুক্ত হয়েছে। ছোট সড়ক যুক্ত হয়েছে অন্তত ৬৫০টি। মহাসড়কের পাশে রয়েছে ১০টি হাসপাতাল ও ২৮টি ফিলিং স্টেশন।
ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৪ সালে নকশা প্রণয়ন করা হয়। ২০১৭ সালে প্রকল্প নেওয়ার সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। তখন চীনের সঙ্গে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। এ জন্য চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষির চালায় সওজ। চায়না হারবার এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ১৬ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে। দফায় দফায় দর-কষাকষির পর ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
দর–কষাকষির চলার সময় ২০১৮ সালের শুরুর দিকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তৎকালীন সচিব মো.
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক আট জেলাকে সরাসরি যুক্ত করেছে। এগুলো হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট। মহাসড়কটি দিয়ে আরও চার-পাঁচ জেলার যানবাহন চলাচল করে।
সওজের তথ্য অনুসারে, মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ইটাখোলা পর্যন্ত অংশে দিনে গড়ে ৩০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। মাঝের অংশে ১০ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করে। আর সিলেটের শেরপুর থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত অংশে গড়ে ২৭ হাজারের মতো যানবাহন চলে। এ মহাসড়কে চলাচল করা যানবাহনের বড় অংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা। স্থানীয় ব্যক্তিরা গবাদিপশু, জমির ফসলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মহাসড়কের এপার-ওপার করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাঁদের জন্য দরকার নিরাপদ পাতালপথ।
প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সড়কের গতি ধরে রাখা ও দুর্ঘটনা কমাতে উড়ালসড়ক ও তিন ধরনের পাতালপথ নির্মাণের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ১১টি উড়ালসড়ক নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য ১৭টি পাতালপথ, ২৯টি হালকা যানবাহন চলাচলের পাতালপথ এবং মানুষ পারাপারের জন্য ৭৮টি পাতালপথ নির্মাণের সুপারিশ করেছে তারা।
এর বাইরে ৭৮টি আধুনিক পদচারী–সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এসব পদচারী–সেতু গতানুগতিক সিঁড়ির বদলে র্যাম্পের মতো হবে। এ ছাড়া গবাদিপশু পারাপারের জন্য ১২টি পাতালপথ নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়াও কিছু স্থানে বেড়া দেওয়া, বাস ও অটোরিকশার স্ট্যান্ড নির্মাণ এবং বাজার এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এতে ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতে পারে।
এসডিজিতে (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেক কমানোর কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সামছুল হক বলেন, চার লেন প্রকল্পে অনেক উড়ালসড়ক রাখা হয়েছে। এগুলোর কিছু কাটছাঁট করার সুযোগ আছে। গতানুগতিক পদচারী–সেতু রাখা হয়েছে। এগুলো আরও জনবান্ধব করা সম্ভব। এভাবে সমন্বয় করলে ব্যয় খুব বেশি বাড়বে না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সড়ক দ র ঘটন প রকল প র প ত লপথ অন স র ত কর র র জন য র র মত পদচ র সরক র নকশ য়
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আঁধার কাটেনি কোচদের
বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না। টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা।
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।