বহুভাষিক ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা গড়ার প্রত্যয়ে বিটিআরসি ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্স দিবস-২০২৫ উদযাপন করেছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (বিআইজিএফ) উদ্যোগে এবং ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নম্বরস-এর (আইকান) সহযোগিতায় কারিগরি কর্মশালা ও বিশেষ সম্মেলনে গবেষক, প্রযুক্তিবিদ, টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্ট অংশীজন ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

দিবসটি উদযাপনে ‘বিটিআরসি ডট বাংলা’ ডোমেইনে বিটিআরসির নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ইমেইল অ্যাপ্লিকেশন উদ্বোধন করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.

) মো: এমদাদ উল বারী।

বিটিআরসির মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজ ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্স দিবসের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব উপস্থাপন করেন। বিআইজিএফ’র মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হক অনু ডট বাংলা ডোমেইনকে জনপ্রিয় করতে বিটিআরসির সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ইন্টারনেট জগতে ৪৯.২ ভাগ কনটেন্ট ইংরেজি, অথচ ইংরেজি ভাষী জনসংখ্যা পৃথীবীতে মাত্র ১৬ শতাংশ। ফলে বেশ কিছু দেশের বহু ভাষার জনগোষ্ঠি তার নিজস্ব ভাষায় ইন্টারনেট কনটেন্ট ব্যবহার করতে পারছে না।

ইন্টারনেটে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্সের প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা নিয়ে তথ্যচিত্র উপস্থাপনা করেন বক্তারা।

চ্যাটজিপিটি ছাড়াও এআই প্রযুক্তির সব মডেলে ইংরেজি ও পশ্চিমা ভাষার ওপর বেশি জোর দিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেটকেন্দ্রিক কনটেন্ট, ইন্টারফেস আর বিভিন্ন ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এটা দেশ, জাতি আর সমাজের অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশের জন্য জরুরি।

ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্সের কারিগরি দিক প্রসঙ্গে বিটিআরসির উপপরিচালক ড. শামসুজ্জোহা বলেন, ২০২৬ সালে নতুন করে টপ লেভেল ডোমেইন বরাদ্দ দেওয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এতে। সুযোগ কাজে লাগাতে আগ্রহী উদ্যোক্তার জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে আইকান এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমীরণ গুপ্ত বলেন, যারা ইংরেজি ভাষাভাষী নয়, তাদের জন্য বহুভাষিক ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ডোমেইনের সামগ্রিক বিষয়ে, বিশেষত ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্স বিষয়ে আইকানের কর্মসূচির বিষয়ে আলকপাত করে বলেন, এমন বিষয়ে যে কোনো প্রকৌশল ও কারিগরি সহায়তা দিতে আইকান সব সময় কাজ করবে।

আইকান বোর্ডের পরিচালক সাজিদ রহমান জানালেন, ইন্টারনেট সবাইকে এক সুতোয় বাধার জন্য চালু হলেও ভাষার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তা বিভাজন সৃষ্টি করেছে। যদি অন্তর্ভূক্তিমূলক ডিজিটাল ভবিষ্যত গড়তে হয়, তাহলে সবাইকে সমানভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। বিটিআরসি’র উদ্যোগ এক্ষেত্রে জরুরি। ফলে সব স্টেকহল্ডারদের নিয়ে কার্যকরভাবে ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্সের ইকোসিস্টেম তৈরি করা সম্ভব হবে।

ইন্টারনেট জগতে যে কোনো ভাষার সার্বজনীন ব্যবহারের কারিগরি চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বিটিসিএল ডোমেইন বিভাগের ব্যবস্থাপক মোস্তফা আল মামুন ও আম্বার আইটির মাহফুজুর রহমান বলেন, ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্সের সফল বাস্তবায়নে সফটওয়্যার ও কারিগরি প্রকৌশল মানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে হবে।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো: এমদাদ উল বারী বলেন, যোগাযোগের প্রয়োজনে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। অন্য ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই তা জটিল হয়। অনেক সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় অন্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ডিজিটাল ডিভাইড কমিয়ে আনতে কানেক্টিভিটি ও ইন্টারনেট ব্যবহার- দুই ক্ষেত্রেই ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে।

কারিগরি সেশনে ভাষার সার্বজনীন ব্যবহার, ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেইম (আইডিএন) ও ইমেইল অ্যাড্রেস ইন্টারন্যাশনালাইজেশন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন আইকানের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের টেকনিক্যাল এনগেজমেন্ট ম্যানেজার চাম্পিকা উইজয়তুনগা।

বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মাহমুদ হোসেন, বিআইজিএফ চেয়ারপারসন মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম, বাংলাদেশ লইয়ার ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার হাসান শাহরিয়ার, বাংলাদেশ ইয়ূথ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান রিয়াদ হাসান বাদশা, বাংলাদেশ স্কুল অব ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের চেয়ারম্যান নাজমুল দিবস উদযাপন সভায় উপস্থিত ছিলেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ট আরস ব ট আরস চ য় র ম য ন ব ট আরস র ব যবহ র র জন য ড ম ইন আইক ন সরক র উপস থ

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ