গুম হত্যার চেয়েও ভয়াবহ অপরাধ, বিচার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: আইন উপদেষ্টা
Published: 22nd, April 2025 GMT
আইনবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুমের ঘটনায় বাংলাদেশে জঘন্যভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এসব ঘটনার বিচার করা হবে। পাশাপাশি দেশের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এমনভাবে করা হবে, যাতে কখনোই কেউ আর এ ধরনের অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাতে না পারেন।
অধ্যাপক আসিফ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো গুম, খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নৃশংসতম ঘটনাগুলোর সুবিচার নিশ্চিত করা।
প্রস্তাবিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার বিকেলে আইন ও বিচার বিভাগ এবং আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিকেল পৌনে চারটায় এ সভা শুরু হয়।
গুম দেশের মানুষের জাতীয় জীবনে বিশেষ করে গত ১৫ বছরে একটা দুঃসহ স্মৃতি হয়ে আছে উল্লেখ করে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে (গুমের) বিচার করার কথা বলতাম। কিন্তু সংশয় ও দ্বিধা থাকত।.
আসিফ নজরুল জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার একেবারে প্রথম দিকেই কোনো কালবিলম্ব না করে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে (দলিল) পক্ষরাষ্ট্র হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো রিজার্ভেশন (আপত্তি) ছাড়া এত বড় মানবাধিকার কনভেনশনের পক্ষরাষ্ট্র হয়েছে।
দেশে গুমসংক্রান্ত বিষয় বিচার করার জন্য কোনো ডেডিকেটেড (সুনির্দিষ্ট) আইন নেই উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা গুম আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পক্ষরাষ্ট্র হয়েছি কিন্তু আমাদের দেশে গুমসংক্রান্ত বিষয় বিচার করার জন্য কোনো ডেডিকেটেড আইন নেই, এটি হতে পারে না। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিস্তৃত এবং সুসংগঠিত গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা হলেও এর বাইরে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে গুমের আলাদা কোনো সংজ্ঞা বা তার শাস্তির কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া নেই।’
এই শূন্যতাকে দূর করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এ আইনের একটি খসড়া তৈরি করে যথাযথভাবে তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
গুমকে হত্যার চেয়েও ভয়াবহ অপরাধ উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও খারাপ অপরাধ। সরকারের যত অগ্রাধিকার রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো গুম, খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে নৃশংসতম ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেটির বিচার নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের শাসক হওয়ার চিন্তা যাঁদের থাকে, তাঁদের জন্য কাজটা কঠিন করে দেওয়া। সে জন্য আমরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করছি। একই সঙ্গে আমরা বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আরও বলেন, অনেক আইন হবে, আগেও হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও অনেক ভালো ভালো আইন হয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাখেনি। এখন যে আইন করা হবে, সেগুলো পরবর্তী সরকার রাখবে কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি বললাম, পরবর্তী যে সরকার আসবে, তারা কমপক্ষে এক হাজার মানুষের রক্তের ওপরে গঠিত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে আসবে। তার পেছনে ৫০-৬০ হাজার মানুষের আহত হওয়ার স্মৃতি থাকবে। লাখো কোটি মানুষের কান্না, এত বড় লিগ্যাসি বহন করার পর পরবর্তী সরকার আমাদের সব সংস্কার ভুলে যাবে, এটি আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমরা সংস্কারপ্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছি। এই আশঙ্কা থেকে যে তারা যেন কখনো বলতে না পারে, আমাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।’
আজকের মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, কমিটির সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটরিল অ্যাসিস্ট্যান্ট এহসানুল হক সমাজী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক শহিদুল আলম, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেলিন, মানবাধিকারকর্মী ও এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সুলতান মো. জাকারিয়া, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস, সাবেক কূটনীতিক ও গুম সার্ভাইভার মারুফ জামান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়েরা ইসলাম খান প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এম এহতেশামুল বারী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মো. কামাল উদ্দিন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব চ র কর উপদ ষ ট সরক র র র কর র র জন য আম দ র অপর ধ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল বুধবার দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ পরবর্তী ওই দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।