নারী ও কন্যাশিশুরা কোথাও নিরাপদ নয়
Published: 27th, April 2025 GMT
সম্প্রতি নারী ও কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখজনক হারে বাড়ছে। ঘরে–বাইরে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ।
জুলাই আন্দোলনের এক শহীদের কলেজশিক্ষার্থী মেয়ের (১৭) দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া ও ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে আজ রোববার এই বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
একই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাব ও নারীদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে নারীপক্ষ। তাদের বিবৃতিতে এই কলেজছাত্রীর মৃত্যুর পেছনে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সমাজের অসংবেদনশীল আচরণ, অসাধু প্রভাব–প্রতিপত্তি, দুর্নীতি ও কাউন্সেলিং সেবা না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার বাসা থেকে ভুক্তভোগী কলেজশিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকিতে।
ভুক্তভোগীর মা জানান, গত ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় পটুয়াখালীতে বাবার কবর জিয়ারত করে নানাবাড়িতে ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে।
নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর সহিংসতা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলেছে, এসব ঘটনা নারীদের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করছে। এমন পরিস্থিতি নারীর অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে কলেজছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারসহ যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
নারীপক্ষের আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজীম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে ভুক্তভোগী কলেজছাত্রীর ধর্ষণ ও তার পরবর্তী লাঞ্ছনাকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
ধর্ষণের শিকার নারীর রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে নারীপক্ষ বলেছে, ভুক্তভোগী নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
টিনএজ সিনড্রোম: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এক নীরব সংকট
এক সময় ছিল, যখন সন্তানের আবেগ, দুষ্টুমি বা হঠাৎ রাগ দেখে বাবা-মা মুচকি হেসে বলতেন—“বয়স হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু আজ, সেই দুষ্টুমি পরিণত হয়েছে এমন আচরণে, যা অনেক সময় বাবা-মা পর্যন্ত চেনেন না। সন্তান চোখে চোখ রাখে না, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, কথা বললে রাগে ফেটে পড়ে। এই চিত্র এখন বিশ্বব্যাপী। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আমরা এক ‘Adolescent Syndrome’ বা ‘Teenage Behavioral Crisis’-এর মুখোমুখি, যা বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
আচরণগত বিপর্যয়ের পেছনে বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ সিনড্রোমের প্রধান কারণ তিনটি:
হরমোনের দোলাচল: ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের ওঠানামা টিনএজারদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হরমোনাল পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, যা আচরণে অতিরিক্ত আবেগ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণ বিকাশ: ১৩-১৯ বছর বয়সে মস্তিষ্কের যুক্তিবোধ ও নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অংশ (prefrontal cortex) এখনও গঠনের পর্যায়ে থাকে। ফলে তারা আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়, ঝুঁকি নেয়, এবং কখন কী বলতে হবে—তা বোঝে না।
প্রযুক্তির নীরব আগ্রাসন: TikTok, Instagram, Snapchat—এসব প্ল্যাটফর্মে মেয়েরা দিনে গড়ে ৬–৮ ঘণ্টা সময় কাটায়। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়া সৌন্দর্য ধারণা, জনপ্রিয়তার চাপ, ফিল্টার সংস্কৃতি তাদের আত্মপরিচয়কে বিকৃত করে তুলছে।
কেন বেশি দেখা যায় মেয়েদের মধ্যে?
Emotional Sensitivity: মেয়েরা আত্মপরিচয় ও আত্মমূল্যায়নে বেশি স্পর্শকাতর।
Beauty Pressure: সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের শরীর, ত্বক, স্টাইল—সবকিছু নিয়েই এক অনিয়ন্ত্রিত চাপ কাজ করে।
Hormonal Impact: মাসিক চক্র ও হরমোন ওঠানামা তাদের মুড, আবেগ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বাবা-মা কি আগের তুলনায় বেশি সমস্যায়?
হ্যাঁ, এবং এর পেছনে রয়েছে পরিবারে সংলাপের ঘাটতি। অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের আধিপত্য। পিতামাতার নিজের মানসিক চাপ। বিকৃত প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা। আজ অনেক অভিভাবক জানেন না—কীভাবে সন্তানের কাছে পৌঁছাতে হয়। তারা নিজেরাই কর্মব্যস্ত, ক্লান্ত, মানসিকভাবে নিঃশেষ।
বিশ্বের অবস্থা কী বলছে?
জাপানে টিনএজ আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সুইডেনে, গত ১০ বছরে কিশোরীদের বিষণ্ণতা বেড়েছে ৪৭%। যুক্তরাষ্ট্রে, CDC বলছে—“Teenage girls are experiencing record levels of sadness, violence, and suicidal thoughts.” বাংলাদেশে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্ণতা বেড়েছে প্রায় ৫০% (মনোরোগ ইনস্টিটিউট, ২০২৩)।
তাহলে বাবা-মা কী করবেন?
শুনুন, শাসন নয় – সন্তানকে সময় দিন, তার কথার পেছনে আবেগ বুঝুন।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ করুন – নিজেরাও মডেল হোন প্রযুক্তি ব্যবহারে।
কাউন্সেলিংয়ে ভীতি নয় – প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিন।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যও রক্ষা করুন – সন্তানকে বোঝাতে গেলে নিজের ভেতরে শান্তি থাকা জরুরি।
একটি প্রজন্ম যেন না হারিয়ে যায়। এই সংকট নিছক পারিবারিক নয়—এটি এক সামাজিক দায়। টিনএজারদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা বোঝা না গেলে, আমরা এক ‘চুপ করে থাকা বিষণ্ণ প্রজন্ম’ হারিয়ে ফেলব। সন্তান যখন বিদ্রোহ করে, সে আসলে জানিয়ে দেয়— ‘আমি ভালোবাসা চাই, বোঝার মানুষ চাই।’ আমাদের দায়িত্ব তাদের ভাষা বুঝে নেওয়া।
তারা//