১৮৬৯ থেকে ২০২৫, কার্ল মার্ক্সের পুঁজি বইটির ১৫০ বছর পেরিয়েছে। এই বই নিয়ে আলোচনা আর সেটিকে ভিত্তি করে লেখালেখি এখনো সমান মাপে চলছে। তবে এটা বেদনার যে বাংলায় এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চর্চা ও আলোচনার পারম্পর্য ও ধারাবাহিকতা একেবারে নেই বললেই চলে।

মার্ক্স–সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত বাংলায় যা হয়েছে, তার মধ্যে মার্ক্সের নিজের লেখা বই ও তাঁর লেখালেখি প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়েছে খুব কম। এর কারণ হচ্ছে, এটাকে একটা মতাদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বাস্তবতার চেয়ে আবেগটাই প্রবলভাবে কাজ করেছে। কিন্তু মার্ক্সের কাছে, আমরা যে সমাজে বাস করি, সেই বাস করা বাস্তব সমাজই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন মার্ক্স তাঁর পুঁজির প্রথম খণ্ডের জার্মান সংস্করণের দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমি বইটি লিখছি তাঁদের জন্য, যাঁদের নিজেদের মতো করে ভাবার সাহস আছে।’

মার্ক্স আমাদের ভাবনার একটা ভিত্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বদলে আমরা মার্ক্সের লেখাকে একটা আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। ফলে মার্ক্সের চিন্তার চর্চা এখানে খুব গভীরভাবে হয়নি। তাঁর যেসব মৌলিক গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে, তার খুব কম অংশ আমরা নিজেরা করেছি। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল। মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থটিও সেই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়।

অন্যদিকে আমরা দেখি যে রুশ ভাষা, চীনা ভাষা ও পশ্চিমা ভাষাগুলোয় মার্ক্সকে নিয়ে লেখালেখি ও চর্চা ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। মার্ক্সকে নিয়ে চিন্তার চর্চা এসব ভাষায় প্রবলভাবে বিরাজমান।

দুই.

মার্ক্সের পুঁজিকে অর্থনীতির বই হিসেবে দেখাটা সমস্যাজনক। কেননা, মার্ক্স পুঁজি লিখতে গিয়ে, অর্থনীতি নামে যে শাস্ত্র দাঁড়িয়ে ছিল, তার বিরোধিতা করেন। কার্ল মার্ক্সের পুঁজি: একটি পাঠ পর্যালোচনা (প্রথম খণ্ড) বইয়ের ভূমিকায় লেখক আনু মুহাম্মদ মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘বুর্জোয়া অর্থনীতির বিজ্ঞান হিসেবে অর্থনীতি তার শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছে’। এই বক্তব্যকে আমরা প্রবলভাবে উপলব্ধি করি, যখন দেখি অর্থনীতি নামের শাস্ত্রে মানুষের উপস্থিতি নেই।

এই শাস্ত্র লাভ, ক্ষতি, চাহিদা, জোগানের মতো বিমূর্ত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এসব বিষয়ের স্রষ্টা মানুষ সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। মার্ক্স মূলত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন অর্থনীতিকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। ফলে মার্ক্সের চিন্তাকে আমরা যখন তথাকথিত ‘অর্থনীতি’র বিষয় হিসেবে পাঠ করতে যাই, তখনই সমস্যাটা তৈরি হয়। কেননা, মার্ক্স কোনো অর্থনীতির বই লেখেননি।

এটাকে স্বীকার করা ছাড়া পুঁজি পাঠ করতে যাওয়াটা পুরোটাই একটা পণ্ডশ্রম। এই জায়গাতেই আনু মুহাম্মদ তাঁর বইতে পুঁজি পাঠের যে পর্যালোচনা দাঁড় করিয়েছেন, সেটা আমাদের এখানে মার্ক্সচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা, মার্ক্সের মৌলিক রচনার সরাসরি পাঠ আমাদের এখানে শুরু হয়েছে কালের বিচারে খুব সম্প্রতি। যত দিন পর্যন্ত ‘মার্ক্সবাদ’ নামের বিষয়টি এখানে প্রবল প্রতাপে উপস্থিত ছিল, তত দিন পর্যন্ত এটার প্রয়োজনীয়তা কেউ উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু উপলব্ধিটা যে শুরু হয়েছে, তারই একটা দৃষ্টান্ত এই বই।

আমাদের এখানে এখন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ—সব ধরনের পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের বাস্তব জীবন। মার্ক্স বলেছিলেন, জার্মানরা সব সময় স্কুলছাত্রের মতোই থেকে গেছে। আমাদের এখানকার অর্থনীতি ও রাজনীতিচর্চার দিকে তাকালে আমরাও একই বাস্তবতা দেখতে পাব।

এই পটভূমিতে আমরা যদি মনে করি যে বাস্তব মানুষ ও তার সমস্যাকে রাজনীতি ও ‘অর্থনীতি’র কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে, তাহলে যে বিশাল একটা প্রয়াস দরকার, সেই প্রয়াসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আনু মুহাম্মদের কার্ল মার্ক্সের পুঁজি: একটি পাঠ পর্যালোচনা (প্রথম খণ্ড) বইটিকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। বইটি মার্ক্সের চিন্তার জমিন সম্পর্কে পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে আশা করি।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

দেশের চারজনের একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার

দেশের প্রতি চারজনের একজন মানুষ এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) বিষয়ক এক সেমিনারে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিকল্পনা কমিশনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করেন জিইডির সদস্য (সচিব) মনজুর হোসেন। আলোচক ছিলেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আখতার এবং বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিবিএসের ২০১৯ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) তথ্য ব্যবহার করে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) নিরূপণ করা হয়েছে।  বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হলো দারিদ্র্য পরিমাপের একটি বিস্তৃত পদ্ধতি, যা শুধু আয় বা ভোগের মতো একক মাত্রার বাইরে গিয়ে দারিদ্র্যকে তার বিভিন্ন দিক থেকে বুঝতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের এ সূচকে তিনটি মাত্রা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যাতে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই মাত্রাগুলোকে ১১টি আলাদা সূচকে ভাগ করা হয়েছে। যেমন জীবনযাত্রার মানের মধ্যে রয়েছে—বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, খাওয়ার পানি, বাসস্থান, রান্নার জ্বালানি, সম্পদ এবং ইন্টারনেট সংযোগ।

এমপিআই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে ২৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে রয়েছে, যা সংখ্যায় প্রায় ৩ কোটি ৯৮ লাখ। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ, আর শহরে ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সিলেট বিভাগে এই দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ, ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর পাঁচটি জেলায় ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। জেলাগুলো হলো—বান্দরবান, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি ও ভোলা। শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ হার ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

প্রধান অতিথি আনিসুজ্জামান চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে এমপিআই-কে দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি নতুন ও উদ্ভাবনী কৌশল হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই পদ্ধতি সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। তিনি এ সূচককে নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এ ছাড়া কিছু জেলায় দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে আরও গবেষণা করার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এমপিআই ব্যবস্থাটি আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য মাপকাঠিকে সম্পূরকভাবে সহায়তা করবে এবং এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেবে। সভাপতির বক্তব্যে মনজুর হোসেন জানান, জিইডি ভবিষ্যতেও নিয়মিত এই সূচক প্রকাশ করবে এবং নীতিনির্ধারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ