ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট হয়নি: ঢাকা চেম্বার
Published: 2nd, June 2025 GMT
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব হয়নি। কারণ, প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, সিএমএসএমই ও ব্যাংকিং খাত সংস্কারে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
আজ সোমবার সন্ধ্যায় প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডিসিসিআইয়ের সহসভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহসভাপতি সালিম সোলায়মানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।
তাসকীন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বেশি মাত্রায় ব্যাংকনির্ভর হওয়া একটি নেতিবাচক দিক। এবারের বাজেটে ব্যবসায় গতি আনার জন্য তেমন কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
এ সময় তাসকীন আহমেদ আরও বলেন, ‘বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমাতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালন ব্যয় বাড়বে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতি কিছুটা মন্থর হয়ে যাবে। এ ছাড়া আর্থিক খাত থেকে অধিক হারে ঋণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে করমুক্ত পণ্যের ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপকে আমরা সঠিক মনে করছি না। এতে ব্যবসার কার্যকরী মূলধন কমে যাবে।’
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাসকীন আহমেদ আরও বলেন, ব্যক্তিগত করের ক্ষেত্রে আয়সীমায় ৫ শতাংশের সীমা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আগামী অর্থবছরে দেশের ৫০ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর বাড়তি করের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া টার্নওভার কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি করেন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি।
এ সময় অটোমোবাইল খাতে খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করায় এই খাতের স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ কমলেও স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট বাড়ানোয় এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হবে বলেও মনে করছে ঢাকা চেম্বার।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি আরও বলেন, ‘বাজেটে এলএনজিসহ ব্যবসার কাঁচামাল আমদানিতে কর কিছুটা কমানো হয়েছে। এর ফলে আমাদের হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। আমাদের বেসরকারি খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। তবে বাজেটে ব্যবসাবান্ধব তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। এসএমই খাতে আমাদের দেশের সর্বমোট শ্রমশক্তির ৫০ শতাংশ ও ৮০ লাখের বেশি মানুষ জড়িত। অথচ বাজেটে এই খাত নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি।’
স্টার্টআপ খাত নিয়ে তাসকীন আহমেদ বলেন, এই খাতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে অনলাইন ব্যবসার লেনদেনে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। তাতে অনলাইনে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দিন পার করার বাজেট
জাকির হোসেন
ছাত্রদের নেতৃত্বে গত বছরের জুলাই মাসে যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তার অন্যতম কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলেও এর পেছনে ছিল গভীরতর সামাজিক অসন্তুষ্টি। বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মসংস্থানের বাইরে। শিক্ষিত বেকারের হার অন্তত ২০ শতাংশ।
তরুণদের প্রত্যাশা ছিল, এই জায়গায় বড় উন্নতি হবে। তবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে সেই প্রত্যাশা পূরণে জোরালো পদক্ষেপ দেখা গেল না। শুধু কর্মসংস্থান নয়, প্রত্যাশিত অনেক খাতে সরকার গতানুগতিক থেকেছে। মনে হচ্ছে, দিন পার করার একটি বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গত বছরের ছয় মাসে ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নেই শ্রমশক্তির অন্তত ৩০ শতাংশের। ফলে দেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের যে প্রত্যাশা রয়েছে, বাজেটে সেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অবশ্য অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যে কর্মসংস্থানের সামান্য তহবিল, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প এবং প্রশিক্ষণের উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তায় কয়েকটি জায়গায় নামমাত্র ভাতা বাড়ানো হয়েছে। টিসিবির বাদ পড়া ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড কবে হবে তার ঘোষণা নেই। ভাতা বাড়ানো হলেও সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প কমিয়ে আনা হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি নজর দেওয়া হয়নি। আগে যেমন বরাদ্দ দেওয়া হতো, এবারও তেমন।
কর্মসংস্থানের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দরিদ্রদের সুরক্ষায় বাজেটে কিছু কর্মসূচি ও প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানাননি অর্থ উপদেষ্টা।
বাজেটের আগে অর্থ উপদেষ্টা এবং এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হবে। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হবে ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে। গত অর্থবছরের অর্থ আইনে দুই অর্থবছরের আয়করের হার নির্ধারণ করা হয়। বলা হচ্ছে, এ কারণে এখন সরকার পরিবর্তন করেনি।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক আইনে সংশোধন এনেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে করমুক্ত আয়ে আগামী অর্থবছরে ছাড় দেওয়া উচিত ছিল। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এর মানে তাদের বেতন বাড়বে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে সরকারি প্রায় ১৫ লাখ চাকরিজীবীর সুবিধা হবে।
অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’। বৈষম্যহীন ঘোষণা দিলেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ধরনের সুযোগ রাখা সৎ করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক। অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, মাত্র ৬৬ পৃষ্ঠার। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলেও এর অনেকাংশ জুড়ে চলমান বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উদ্যোগর বর্ণনা। নতুন উদ্যোগের কথা কম আছে।
বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পদক্ষেপও আশানুরূপ নয়। অথচ গত অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিনিয়োগের বিষয়ে বলতে গিয়ে অর্থ উপদেষ্টা গত বিনিয়োগ সম্মেলনের গুণগান গেয়েছেন। নাসার সঙ্গে মহাকাশ গবেষণার চুক্তির কথা বলেছেন। এই চুক্তি দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে কীভাবে উৎসাহ দেবে স্পষ্ট নয়। বিনিয়োগের বিভিন্ন অন্তরায় দ্রুততম সময়ে দূর করার চেষ্টার কথা জানিয়েছেন তিনি। বিডার ওয়ানস্টপ সার্ভিসের কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
এবারের বাজেটে আমদানি উদারীকরণের পথে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম লক্ষ্য ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক থেকে রেহাই পাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয় এ রকম কিছু পণ্যকে মাথায় রেখে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় উৎপাদনে বিশেষত ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন করছাড় কমানো হয়েছে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আমদানি বাণিজ্য উদারীকরণের দিকে অনেকটা এগোলেও দেশের রপ্তানিকারকরা যাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন, তার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই।
ব্যয় কাঠামো
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতা, সুদ পরিশোধসহ সরকারের পরিচালন ব্যয় তিন ভাগের দুই ভাগ। বাকি এক ভাগ উন্নয়ন ব্যয়। এভাবেই হয়ে আসছে দেশের বাজেট।
পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এবার বাজেটে ব্যয়ের আকার এবং ঘাটতির আকার আগের চেয়ে কম ধরা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধরন থেকে সরে সরকার সামগ্রিক উন্নয়নে জোর দিতে চায়। এ কারণে ব্যয়ের আকার ছোট রাখা হয়েছে।