চলন্ত গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়, না পেলে আঘাত
Published: 3rd, June 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে চলন্ত যানবাহন থেকে জোর করে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী চালকরা জানিয়েছেন, মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের থামিয়ে টাকা আদায় করে একটি চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পৌরসভার কাছ থেকে যানবাহনের পাঁচটি স্ট্যান্ড ইজারা নিয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাদের নাম ভাঙিয়ে যানবাহন থামিয়ে চাঁদা নিচ্ছে কিছু লোক।
গতকাল সোমবার বিকেলে যাত্রী নিয়ে ভূলতা-বিশনন্দী আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে আড়াইহাজারের পায়রা চত্বরে যান অটোরিকশাচালক মোগল হোসেন। এ সময় গতিরোধ করে চাঁদা দাবি করে ইমন মিয়া নামে এক তরুণ। কীসের চাঁদা জানতে চাইতেই ক্ষিপ্ত ইমন রড দিয়ে অটোরিকশায় আঘাত করেন। আতঙ্কে কান্না শুরু করে ভেতরে থাকা এক শিশু। এ সময় আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে রড হাতে তাদের দিকে তেড়ে যান ইমন মিয়া। শেষ পর্যন্ত মোগল হোসেনের কাছ থেকে ২০ টাকা চাঁদা আদায় করেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী আলতাফ হোসেনের ভাষ্য, গোলচক্কর হিসেবে পরিচিত এই পায়রা চত্বরে এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। পৌরসভার নাম ভাঙিয়ে এই চত্বরের চারপাশ থেকে ৮-১০ জন এভাবে ট্রাক, পিকআপ, সিএনজিচালিত ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করেন। টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয় চালকদের। কখনও মারধরও করা হয়।
আড়াইহাজার পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মোজাহিদুল ইসলাম তুষারের ভাষ্য, গোলচক্করে মদনগঞ্জ রুট, ভূলতা রুট ও মাধবদী রুট, থানার মোড়, উপজেলা শহীদ মিনার সংলগ্ন ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সংলগ্ন মোট পাঁচটি সিএনজি স্ট্যান্ড ইজারা দেওয়া হয়েছে। শুধু ওই স্ট্যান্ড ব্যবহারকারী যানবাহন ও মালপত্র ওঠানামা করলেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল নেওয়ার নিয়ম। আঞ্চলিক মহাসড়কে যানবাহনের গতিরোধ করে কোনো টাকা তোলা যাবে না।
তাঁর এই বক্তব্যের সত্যতা মেলে না বাঞ্ছারামপুরগামী সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মোক্তার হোসেনের কথায়। তিনি বলেন, গোলচক্কর ও আশপাশের চারটি জায়গায় জোর করে ২০-৩০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এখানে লাঠি নিয়ে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলেই লাঠি দিয়ে আঘাত করে। আড়াইহাজার পুলিশ স্টেশনের পাশেও এভাবে চাঁদাবাজি চলে। বাংলাদেশের কোথাও এমন অরাজকতা দেখেননি তিনি।
এই পাঁচটি স্পটের আশপাশ থেকে দিনে ৫০-৬০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয় বলে কয়েকজন অটোরিকশাচালকের ধারণা। অটোরিকশাচালক মহসিন মিয়া, বাবুল মিয়া, মোসলেমউদ্দিন; ট্রাকচালক মিজানুর রহমান, ইলিয়াস হোসেন; নসিমন চালক আব্দুর রউফ ও জামালউদ্দিনের ভাষ্য, পায়রা চত্বর, কলেজ রোড, ভূলতা-বিশনন্দী সড়ক ও নোয়াপাড়া, দিঘিরপার সিএনজি অটো স্টেশন, নরসিংদী-মদনগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক– সবগুলোই সড়ক ও জনপথ বিভাগের। পুলিশ স্টেশন মোড়, থানার মসজিদ রোড এলজিইডির। এসব সড়কের কোথাও পৌরসভার পার্কিংয়ের জায়গা বা টার্মিনালের জায়গা নেই। অথচ পাঁচটি স্পটকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারাদারের লোকেরা চলন্ত অটোরিকশা, সিএনজি ও ইজিবাইক থেকে ২০ টাকা, পিকআপ ভ্যান থেকে ৫০ টাকা, ট্রাক থেকে ৫০-৭০ টাকার মতো চাঁদা আদায় করছে প্রকাশ্যে।
ভূলতা রুটের স্ট্যান্ডটির ইজারাদার আড়াইহাজার পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আল আমিন। তাঁর নামে দীন ইসলাম, আরমান ও সাজন আশপাশ থেকে চাঁদা আদায় করেন। সোমবার রাতে আল আমিনের নম্বরে কল দেওয়া হলেও ধরেননি।
সোমবার বিকেলে গোলচক্করে ঢাকা থেকে বিশনন্দীমুখী ট্রাক থামিয়ে ৫০ টাকা নেন ইমন মিয়া। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘চাঁদা তোলার রাইট আছে বলেই নিচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।’ বলে হুমকিও দেন। এ সময় গোলচক্করে ভূলতা রুটে চারজন ও মদনগঞ্জ রুটে চারজনকে টোল আদায়ের রিসিট ও লাঠি হাতে এবং মাধবদী রুটে দু’জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এলাকাবাসীর ভাষ্য ইমন মিয়া মাধবদী রুটের স্ট্যান্ডের ইজারাদার ও আড়াইহাজার পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হজরত আলীর লোক। এ ছাড়া মনির হোসেনসহ আরও দু-তিনজন তাঁর হয়ে চাঁদা আদায় করেন।
এ বিষয়ে ফোনে হজরত আলী বলেন, স্ট্যান্ডটি গত ১ বৈশাখ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন। ইমনকে চেনেন না। মনির তাঁর লোক। তাঁর চারজন লোক স্ট্যান্ড থেকেই টোল আদায় করে। তাঁর দাবি, ট্রাক আটকানোর নিয়ম নেই। তারা আশপাশেই থাকেন কেউ যদি সমস্যায় পড়েন, তাহলে সমাধান করেন। অনেকে টাকা আদায় করে নিজেরা নেন। হয়রানির অভিযোগ পেলে শাস্তি দেন।
পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, পৌরসভার নিজস্ব পার্কিং টার্মিনাল ছাড়া সড়ক-মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহন থেকে কোনো টোল আদায়ের বিধান নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
নারায়ণগঞ্জ সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম বলেন, তাদের সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থেকে টোল, পৌরকর বা যে কোনো নামেই টাকা নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এ বিষয়ে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ছাত্রলীগ নেতার বিচার চেয়ে অবরোধ
গাজীপুরের শ্রীপুরে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে সোমবার সকালে মহাসড়কে বিক্ষোভ করেন পরিবহন শ্রমিকরা। উপজেলার জৈনাবাজারে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। তারা গাজীপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফাহিম আহমেদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে তাঁর বিচার দাবি করেন।
এ বিষয়ে প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের আবুল হোসেন বলেন, রোববার মধ্যরাতের পর ফাহিম আহমেদ ২০-২৫ জন সহযোগী নিয়ে জৈনাবাজারের পশ্চিমে প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের স্ট্যান্ডে এসে দুটি বাস ভাঙচুর করেন। পরে তারা শ্রমিকদের মারধর করেন। এ সময় ফাহিম এ পরিবহনের প্রতিটি গাড়ি থেকে দিনে ১ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। না দিলে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার হুমকিও দেন।
তাঁর ভাষ্য, প্রতিবাদ করায় হামলাকারীরা একটি বাসচালকের সহকারী আরিফুল ইসলামকে ধরে নিয়ে যান। এ ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার সকাল ৭টার দিকে শ্রমিকরা জৈনাবাজার এলাকায় প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের কয়েকটি বাস আড়াআড়ি রেখে মহাসড়ক অবরোধ করেন।
ফাহিম আহমেদের ভাষ্য, ‘আমি কাউকে মারধর বা চাঁদা দাবি করিনি। রোববার রাতে আমার ভাতিজাকে মারধর করেন পরিবহন শ্রমিকরা। ঘটনাস্থলে গিয়ে কারণ জানতে চেয়েছিলাম। পরদিন বিষয়টি মীমাংসার কথা ছিল। তারা উল্টো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে আন্দোলন করছেন।’
শ্রীপুর থানার ওসি মহম্মদ আব্দুল বারিক সমকালকে বলেন, হেলপার আরিফুল ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। শ্রমিকরা এই গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করেছেন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের আশ্বাসে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যান।
চাঁদা না পেয়ে মারধর
এদিকে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় চাঁদা না পেয়ে নির্মাণশ্রমিকদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোববার রাতে ফুকুরহাটি ইউনিয়নের কান্দাপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে কান্দাপাড়া খালের ওপর সেতু নির্মাণকাজের সাব-ঠিকাদার মো.
ওই কাজের ঠিকাদার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, একই এলাকার সুকুমার রাজবংশী প্রায়ই চাঁদা চেয়ে শ্রমিকদের হুমকি-ধমকি দিতেন। কিছুদিন আগে শ্রমিকদের মারধর করেন। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসাও হয়। রোববার রাতে সুকুমার এসে ১ লাখ টাকা চাঁদা চান। না পেয়ে শ্রমিকদের মারধরের পর অফিসঘর ভাঙচুর করেন।
লিখিত অভিযোগে বাদী মো. বাবুল হোসেন বলেন, সুকুমার রাজবংশী নেশাখোর। সে মাঝেমধ্যেই শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাত। চাঁদা না দিলে মারধর করত। সেতু নির্মাণের কাজ শেষ দিকে। রোববার সে ১ লাখ টাকা চাঁদা চায়। না দেওয়ায় শ্রমিকদের পিটিয়েছে।
সুকুমার রাজবংশীর ঘটনার পর থেকেই পলাতক। যে কারণে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সাটুরিয়া থানার ওসি মো. শাহিনুল ইসলাম বলেন, রাতেই লিখিত অভিযোগ পেয়ে তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশ পাঠানো হয়। সে পালিয়ে গেছে। দ্রুতই সুকুমারকে গ্রেপ্তারের আশা করছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ম ন কগঞ জ হ স ন বল ন পর বহন র ইমন ম য় ল ইসল ম প রসভ র র ধ কর স মব র র বব র র কর ন চ লক ম প রক শ স এনজ আশপ শ এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।