বিলাসবহুল এসি বাসে ‘যেমন ইচ্ছা তেমন ভাড়া’
Published: 5th, June 2025 GMT
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের সড়কে ঝাঁ–চকচকে দামি ব্র্যান্ডের বাস নেমেছে। এসব বাসে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা (এসি), আরামদায়ক আসন। তবে ভাড়া নন-এসি বা সাধারণ বাসের তুলনায় দ্বিগুণ; ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি। এই বাড়তি ভাড়া কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন উঠেছে।
পুরোপুরি মেনে না চললেও নন-এসি বাসের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে দেয়। তবে এসি বাসের ভাড়ায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে একেক কোম্পানি, ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। ঈদের সময় এসি বাসের ভাড়া আরও লাগামহীন হয়ে ওঠে।
২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে বলা হয়েছে, সরকার গণপরিবহনের জন্য ভাড়ার হার ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণ করবে। সরকারের হয়ে এ কাজ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
আইনে এক জায়গায় বলা হয়েছে, বিলাসবহুল এসি ও বিশেষ সুবিধাসংবলিত গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে আইনের এই ধারা প্রযোজ্য হবে না। তবে আইনে এ–ও বলা আছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষ বিলাসবহুল এসি ও বিশেষ সুবিধাসংবলিত গণপরিবহনের ভাড়া যুক্তিসংগতভাবে নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে পারবে।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও যাত্রীদের মত হচ্ছে, আইনের নির্দেশনা মেনে এসি বাসের ভাড়াও বিআরটিএ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। এতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় কিছুটা হলেও কমতে পারে। কিন্তু বিআরটিএ তা না করে পুরোপুরি চাহিদার ওপর ছেড়ে দিয়েছে।যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও যাত্রীদের মত হচ্ছে, আইনের নির্দেশনা মেনে এসি বাসের ভাড়াও বিআরটিএ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। এতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় কিছুটা হলেও কমতে পারে। কিন্তু বিআরটিএ তা না করে পুরোপুরি চাহিদার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে অধিক মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে, সেখানে এভাবে পরিবহনমালিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া আসলেই যুক্তিযুক্ত কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
বিআরটিএর হিসাবে দেশে নিবন্ধিত এসি বাসের সংখ্যা ২ হাজার ৭৮৩। এর মধ্যে অল্প কিছু বাস রাজধানী ঢাকায় চলাচল করে। বাকি সবই দূরপাল্লার পথে চলে। সারা দেশে নিবন্ধিত বড় বাসের সংখ্যা ৫৬ হাজারের মতো। এর বেশির ভাগই দূরপাল্লার এবং এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চলাচল করে। কিছু কিছু বড় বাস শহরেও চলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নন–এসি বাসের আসনও আরামদায়ক হয়েছে। ভালো ব্র্যান্ডের নন–এসি বাসও চলাচল করে। কিন্তু দুই ধরনের বাসের ভাড়ার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এর মধ্যে কিছু কিছু কোম্পানি বাসে শুয়ে ভ্রমণের (স্লিপার কোচ) ব্যবস্থা আছে। আছে কিছু দ্বিতল বাসও। তবে এগুলোর অনুমোদন নেই।
পরিবহনমালিকদের তথ্যমতে, দেশে এসি বাসের যাত্রা শুরু হয় গত শতকের আশির দশকে। এরপর ধীরে ধীরে এসি বাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিলাসবহুল এসি বাসের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। এখন হুন্দাই, ভলভো, স্ক্যানিয়া, মার্সিডিজ বেঞ্জের বাস চলছে। অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল হিনো ও আশোক লিল্যান্ডের বাসও আছে অনেক। গ্রিনলাইন, সোহাগ, শ্যামলী, হানিফ, এনা, দেশ ট্রাভেলস, টিআর ট্রাভেলস, সৌদিয়া, সেন্ট মার্টিন, আগমনী এক্সপ্রেস, এসআর ট্রাভেলস, নাবিলসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিলাসবহুল বাস চলাচল করছে দেশের বিভিন্ন পথে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, খুলনা ও বরিশাল।
আরও পড়ুনঈদযাত্রায় বাসে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া, কোথাও দেড় থেকে দুই গুণ০৮ এপ্রিল ২০২৪একই দূরত্ব, ভাড়ায় তারতম্য
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে নন-এসি বাসের ভাড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু একই পথে এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। স্লিপার বাসে এই পথে দুই হাজার টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পথে নন–এসি বাসে গড়ে এক হাজার টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। এসি বাসে এই ভাড়া দুই হাজার বা এরও বেশি নেওয়া হয়। স্লিপার কোচে ভাড়া ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। নন-এসি বাসে স্বাভাবিক সময়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হয়। অবশ্য ঈদে অনেকেই বেশি ভাড়া আদায় করে। এসি বাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে কিলোমিটারপ্রতি সাড়ে ৬ টাকার বেশি ভাড়া নেওয়া হয়। অথচ দূরপাল্লার পথে নন-এসি বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ১২ পয়সা।
ঢাকা থেকে বগুড়ায় নন-এসি বাসের ভাড়া সাড়ে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু এসি বাসের ভাড়া আদায় করা হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে রংপুরে এসি বাসের ভাড়া ২ হাজার টাকায় ঠেকে। সেন্ট মার্টিনসহ কিছু পরিবহনে স্লিপার কোচে ভাড়া নেওয়া হয় তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এই পথে নন–এসি বাসের ভাড়া ৮০০ টাকার কমবেশি।
ঢাকা থেকে বরিশালের পথে নন–এসি বাসের ভাড়া আদায় করা হয় ৫০০ টাকা। পদ্মা সেতু চালুর পর এই পথে বেশ কিছু এসি বাসও নামানো হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার কিংবা অন্য বড় শহরে চলাচলকারী বাসগুলোর মতো এতটা অভিজাত নয়। এরপরও এই পথে এসি বাসের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। কিছু স্লিপার কোচে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা পথে বিআরটিসি, এশিয়া লাইন, তৃষা, রয়েল কোচসহ কয়েকটি কোম্পানির বাস যাত্রী পরিবহন করে। এই পথে নন–এসি বাসের ভাড়া ২০০ টাকার মতো। এসি বাসে নেওয়া হয় সাড়ে ৩০০ টাকা। ঈদ বা পার্বণে তা আরও বেড়ে যায়।
আসনসংখ্যায় কমবেশি
বিআরটিএ দূরপাল্লার পথের ৫২ আসনের বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। আরামদায়ক করার জন্য দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী বাসে এখন আসনসংখ্যা ৩৬ থেকে ৪০টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে আসনের আনুপাতিক হারে ভাড়া বাড়ে। এর সঙ্গে যোগ করা হয় সেতু ও সড়কের টোল। পরিবহনমালিকেরা বাড়তি খরচ ও আসন কমানোর ফলে যে ভাড়া আসে, তা ঠিক করে বিআরটিএ থেকে অনুমোদন করিয়ে নেয়।
অন্যদিকে আরামদায়ক এসি বাসগুলোর বেশির ভাগই ২৮ আসনে নামিয়ে আনা হয়েছে। কেউ কেউ সাধারণ এসি বাসে ৩২ কিংবা ৩৬ আসন পর্যন্ত বসিয়ে থাকে। দূরপাল্লার দ্বিতল এসি বাসে আসনসংখ্যা ৪৫ কিংবা তারও বেশি।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, সাধারণ বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস কেনার বিনিয়োগের বাইরে ১৬টি ব্যয়ের খাত বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর দৈনিক কত কিলোমিটার চলাচল করে এবং গড়ে কত যাত্রী হয়, তার ওপর ভিত্তি করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ব্যয় বিশ্লেষণ অনুসারে, ৫২ আসনের একটি বাসের পেছনে বিনিয়োগ ধরা হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ টাকা। আর প্রতিটি বাস ৭০ শতাংশ আসন পূর্ণ করে চলবে, এমনটা ধরা হয়েছিল।
পরিবহনমালিকদের সূত্র বলছে, নন-এসি বাসের চেয়ে এসি বাসের বিনিয়োগ প্রায় দেড় গুণ বেশি। তবে বিনিয়োগের হেরফেরের কারণে বাসের ভাড়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ নির্ভর করে জ্বালানি খরচের ওপর। সুতরাং নন-এসি বাসের সঙ্গে এসি বাসের জ্বালানি খরচ যুক্ত করে সহজেই ভাড়া নির্ধারণ করা সম্ভব।
তবে বিআরটিএ ও পরিবহনমালিকদের কারও কারও মত হচ্ছে, একেক ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল এসি বাসের ক্রয়মূল্যে পার্থক্য আছে। বাসের আসনসংখ্যাতেও কোম্পানিভেদে তারতম্য রয়েছে। সেবার পার্থক্যও আছে কোম্পানিভেদে। ফলে সব এসি বাসের জন্য একক ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া কঠিন। আবার সরকার ভাড়া নির্ধারণ করে দিলে এই খাতে বিলাসবহুল বাস নামানোর যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তা কমে যেতে পারে।
দ্বিতল–স্লিপারের অনুমোদন নিয়ে জটিলতা
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পথে নতুন সংযোজন স্লিপার ও দ্বিতল বাস। তবে এই বাসগুলো স্লিপার বা দ্বিতল হিসেবে বিআরটিএ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তাই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া এই বাসগুলো কতটা নিরাপদ, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
বাসের চেচিস বা ভিত্তি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এরপর দেশীয় কারিগরেরা বডি তৈরি করে বাসে পরিণত করেন। যেকোনো কোম্পানির চেসিস দেশে আসার পর বিআরটিএ থেকে এর ‘টাইপ অ্যাপ্রুভাল’ নিতে হয়। অর্থাৎ ওই চেসিসের ওপর কত সিটের কোন ধরনের বডি বানানো যাবে, তার অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিটি চেসিসের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপ থাকে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানুয়ালেও আসন ও বডি কেমন হবে, এর একটা ধারণা দেওয়া থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, যে চেসিসগুলোর ওপর স্থানীয় কারিগরেরা দোতলা বাস বানিয়েছেন, সেগুলো আমদানি করা হয়েছে একতলা বাস হিসেবে। স্লিপার কোচগুলোও করা হয়েছে সাধারণ বাসের চেসিসের ওপর। চেসিস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানুয়াল মানা হয়নি।
বিআরটিএ বলছে, তারা দ্বিতল বা স্লিপার বাস হিসেবে অনুমোদন দেয়নি। বরং একতলা বাস হিসেবেই নিবন্ধন দিয়েছে। মালিকেরা পরে নিজেদের মতো করে বডি তৈরি করে নিয়েছেন।
তবে বিআরটিএ বাস না দেখে কাগজের ওপর ভিত্তি করে নিবন্ধন দেওয়াতেই এই বিপত্তি। এ ছাড়া নিবন্ধনের পর ফিটনেস সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। সে সময়ও এটি চোখে পড়ার কথা। সরকারি সংস্থাটির অবহেলা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু স্লিপার ও দ্বিতল বাস চলাচল করছে, যাত্রী চাহিদাও আছে, তাই এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার পাশাপাশি এসব বাসেরও যাচাই-বাছাই করে নিরাপত্তাঝুঁকি না থাকলে অনুমোদন দেওয়া উচিত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব আরট এ থ ক ৫০০ ট ক পর বহন ন বন ধ এই পথ র বহন র ওপর সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।