কোরবানির ঈদের পাঁচ দিনের মধ্যেই চামড়া সংরক্ষণের কাজ প্রায় শেষ। এখন আড়তদারেরা চামড়া বিক্রির জন্য ট্যানারি ব্যবসায়ীদের ডাকের অপেক্ষায় আছেন। সরকার–নির্ধারিত দাম পাওয়ার প্রত্যাশা তাঁদের। কারণ, এবারের ঈদে গত বছরের তুলনায় সারা দেশে পশু কোরবানি কমেছে প্রায় ১৩ লাখ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোরবানির পশুর সংখ্যা ১২ লাখ থেকে কমে ৬ লাখে নেমেছে। তাই এবারের ঈদে কোরবানি কম হওয়ার কারণে চামড়ার দাম বাড়তে পারে বলে আশা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আজ বুধবার সরেজমিনে পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তা মোড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণের কাজ প্রায় শেষ। এখন আড়তগুলো ট্যানারিগুলোর কাছে চামড়া বিক্রির অপেক্ষায় আছে।

আড়তদার সুমন প্রথম আলোকে জানান, এবার তিনি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা দামে চামড়া কিনেছেন। লবণশ্রমিক মিলিয়ে প্রতিটি চামড়ায় আরও ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো ব্যয় রয়েছে। প্রতিটি চামড়ায় খরচ হয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। ফলে এই চামড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা করে বিক্রি করতে হবে। দাম নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ রাখা হলে চাহিদা বাড়বে। দাম পামু। নয়তো আমরা ট্যানারির মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই।’

সরকার এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। সাধারণত মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ বর্গফুটের হয়। তাতে মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬২৫ টাকা।

এবার সরকার–নির্ধারিত দাম পাবেন বলে আশা করেন পুরান ঢাকার কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মঞ্জুরুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমাদের টার্গেট ছিল এক লাখের বেশি চামড়া সংগ্রহ করার; কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কারণ, কোরবানি কম হয়েছে। ৭০ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ করেছি আমরা। তাই দাম বাড়বে। আশা করছি, সরকার–নির্ধারিত দাম পাব এবার।’

এদিকে এ বছর ঈদুল আজহায় দেশে ৯১ লাখের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৩ লাখ কম। গত বছর ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। এবার ৩৩ লাখ ১০ হাজারের বেশি কোরবানির পশু অবিক্রীত ছিল।

কোরবানি কম হওয়ায় চামড়ার সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন পোস্তা এলাকার আড়তদার ইমতেয়াজ। ৫০ বছর ধরে চামড়া ব্যবসায়ে নিয়োজিত এই ব্যবসায়ী বলেন, ট্যানাররা চাহিদামতো চামড়া না–ও পেতে পারেন। ভালো চামড়ায় সরকারি দাম পাওয়া গেলেও ২০–২৫ শতাংশ চামড়া বাদ দিতে হয়। তখন গড় দাম কম পড়ে।’ প্রক্রিয়াকরণ খরচ বেশি হওয়ায় লাভ কম হবে। তা ছাড়া মাসের পর মাস বাকি টাকার জন্য ট্যানারির মালিকদের পেছনে ঘুরতে হয়। আবার ব্যাংকের ঋণসুবিধাও পাওয়া যায় না। সে জন্য অনেকেই এ ব্যবসা ছেড়ে গেছেন।

খরচের হিসাব দিতে গিয়ে এ ব্যবসায়ী ইমতেয়াজ জানান, ৭টা চামড়ার জন্য এক বস্তা লবণ লাগে। এক বস্তা লবণের দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা, পরিমাণ ৭৪ কেজি। প্রতিটি চামড়ায় ৮–১০ কেজি লবণ লাগে, অর্থাৎ ১০০ টাকার মতো ব্যয় হয়। বাইরে থেকে চামড়া ঘরে আনতে প্রতিটি চামড়ায় শ্রমিককে ২০ টাকা করে দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিটি চামড়ায় ন্যূনতম ৩০০ টাকা খরচ পড়ে। তাই ইউরোপের বাজার না খুললে শুধু দাম বেঁধে দিয়ে এ শিল্প টিকানো যাবে না।

ট্যানারির মালিকদের সূত্রে জানা গেছে, এ বছর তাঁরা ৮৫ থেকে ৯০ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। গত বছর চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন ৯৫ লাখ। এবার কোরবানি কম হওয়ায় ১০ থেকে ১৫ লাখ কম চামড়া পেতে পারেন তাঁরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানি কম হওয়ায় এবার ৮০ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা যাবে। ঢাকায় এ লক্ষ্যমাত্রা আট লাখের মতো। ইতিমধ্যে চার লাখ চামড়া আমাদের ট্যানারিগুলোতে ঢুকেছে। সরকার–নির্ধারিত দামে প্রতি বর্গফুট চামড়া ঢাকায় ৬০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৫০ টাকায় কেনা হচ্ছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র ন র ধ র ত দ ম ব যবস য় কম হওয় গত বছর আড়তদ র ক রব ন হওয় য় ম হওয়

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ

রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।

এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।

আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।

দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’

* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।
* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।

আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।

সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।

আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।

মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।

৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সামুদ্রিক মাছে ভরপুর আড়ত, দাম কেমন
  • মেঘনার পাড়ে ‘আড়াই ঘণ্টার হাট’, দৈনিক বেচাকেনা ২৫-২৬ লাখ টাকার টাটকা মাছ
  • দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ