সিনেমা বন্ধ, পর্যটক হেনস্তা ও শাকিলের ‘আত্মহত্যা’
Published: 12th, June 2025 GMT
ঈদের ছুটিতে যখন সবকিছু বন্ধ, তখন খবর পেলাম, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘটনার পর কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এইবার ঈদুল আজহার ছুটি চলাকালে ঘটেছে এমন আরও তিনটি ঘটনা।
প্রথম চিত্র: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে নিরাপত্তার অভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে ঈদের দিন থেকে ‘তাণ্ডব’ সিনেমা দেখানো হচ্ছিল। পারকি ইউনিয়ন ওলামা পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের দাবি জানানো হয়। আন্দোলনকারীদের একজন মাওলানা আবদুল্লাহ বলেন, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া অসামাজিক কার্যকলাপ হতে পারে। সেই জন্য হলটিতে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন (সমকাল অনলাইন)।
দ্বিতীয় চিত্র: সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উৎমাছড়া এলাকায় পর্যটকদের হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুব জমিয়তের সহসভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী দলীয় কর্মীদের নিয়ে সেখানে যান। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘উৎমাছড়া কোনো পর্যটন কেন্দ্র নয়। কেউ ছবি আপলোড করবেন না।’ আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এলাকার মুরব্বিরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি– এখানে যাতে কেউ না আসেন। আমরা সম্মানের সঙ্গে বলছি– আপনারা এখানে আসবেন না।’ এ বিষয়ে রুহুল আমিন সিরাজী বলেন, ‘কিছু মানুষ এখানে মদপান ও অশ্লীল কার্যক্রম করছেন। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় আলেম-ওলামা ও মুরব্বি-যুবকদের নিয়ে ঈদের আগে বৈঠক করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা উৎমাছড়ায় পর্যটক যেতে নিরুৎসাহিত করছেন।’ তবে এখন উপজেলা যুব জমিয়ত বলছে, উৎমাছড়ায় তারা শুধু ধর্মের ‘দাওয়াত’ দিতে গিয়েছিলেন।
তৃতীয় চিত্র: মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ (২৪) আত্মহত্যা করেছেন। শাকিলের স্বজন জানিয়েছেন, ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে চারটি পোস্ট দিয়েছিলেন শাকিল। সর্বশেষ পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে, আমি নবী মুহাম্মদকে কোনো কটূক্তি করিনি। আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক গর্ব করত, গ্রামের সবাই আমাকে অনেক সম্মান করত। আজ আমি আমার নিজের আপন মানুষের কাছে আমার সম্মান হারিয়েছি। আগামীকাল আমার বাবাকে সবাই গালি দিবে, আমার মাকে সবাই অসম্মান করবে, এই লজ্জা আমি কখনও সহ্য করতে পারব না। একটা ছেলে হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মানসম্মান আমি এভাবে নষ্ট করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারব না। কোনো দিন আমি গ্রামে মাথা তুলে চলতে পারব না। আত্মহত্যা মহাপাপ– আমি জানি। আমি অনেক পাপ করেছি, আজ আর একটা শেষ পাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’
দক্ষিণ জামশা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের কয়েকশ লোক শাকিলদের বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন হুমকি দেন। এর পর রাত ২টার দিকে বাড়িতে নিজ ঘরের ভেতর ফাঁস নিয়ে শাকিল আত্মহত্যা করেন। দক্ষিণ জামশা গ্রামের নাসিরউদ্দিন আহমেদের ছেলে শাকিল। কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন মুহসীন হলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শাকিল। বড় দুই ভাই দেশের বাইরে থাকেন। ভাইদের মধ্যে শুধু তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ‘শাকিলের চিরবিদায়ে পুরো পরিবার শোকস্তব্ধ। আমরা এখন আর কিছু বলতে চাই না। আমরা তো আর তাকে ফেরত পাব না! তাকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার শ্বশুর শাকিলকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন– ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি এখন পাগলের মতো হয়ে গেছেন। শুধু বলছেন, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। বিচার একমাত্র আল্লাহই করবেন। মানুষের কাছে আমার কোনো বিচার নাই’ (ডয়চে ভেলে, ১১ জুন ২০২৫)।
কিছুদিন ধরে আলাপ শুনছি– ‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ রচিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত হতে পারে না। কারা এই আলাপ করছেন, সেটা বুঝতে সহায়ক হতে পারে ওপরের তিনটি ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয়েছে– মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতার ঘাটতি রয়েছে। দেশের সর্বত্র যে কোনো ভিন্নমতের ওপর অনায়াসে হামলা হচ্ছে, মাজারে হামলা হচ্ছে, নারী নিপীড়ন হচ্ছে, ভিন্ন জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, এসব সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার পুনরাবৃত্তি ঘটনাগুলো প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
বাংলাদেশ বহু জাতি-ধর্ম-বর্ণের এক ভূখণ্ড। এখানে বহু মত ও পথের মানুষ একত্র হয়ে বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এখানকার মানুষ উগ্র পন্থাকে কোনোদিন গ্রহণ করেনি। এখানে ঋতুবৈচিত্র্য ও বহমান নদীর স্বভাবের মতো মানুষও সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাই এখানে কোনো একক মত, একক পথ কখনও মানুষের এগিয়ে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। মানুষের বিপক্ষে গিয়ে এখানে পরাক্রমশালী শাসক টিকতে পারেননি। যার সর্বশেষ নজির আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। তাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল– কোনো উগ্র পন্থাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এমন কোনো গোষ্ঠীর কাছে নতজানু হয়ে পড়ছে। সরকারকে দ্রুত এই অবস্থা থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর যটক পর ব র সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কেমন হতে পারে ইরানের জবাব
ইসরায়েলের হামলার পর কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ও ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি বলেন, এই গল্পের শেষ ইরানের হাতেই লেখা হবে। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে সিংহের লেজ নিয়ে খেলা করা। এই ধরনের হামলার মুখে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রয়োজন অনুভব করতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
পাল্টা হামলায় প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলে ১০০ ড্রোন ছুড়েছে ইরান। প্রতিবেশী দেশ ইরাক জানিয়েছে, ইরানি ড্রোনগুলো তাদের আকাশসীমা অতিক্রম করে ইসরায়েলের দিকে ছুটে গেছে। তবে ইসরায়েল নিজ ভূখণ্ডের বাইরে এসব ড্রোন ঠেকিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে। জর্দান জানিয়েছে, তাদের দেশে ইরানি ড্রোন বিস্ফোরণের আশঙ্কায় তারা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের আবাসিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করেছে। হামলায় নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। তিনি এর জবাবে সামরিক ও কূটনৈতিক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর অঙ্গীকার করেছেন।
এদিকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক স্থাপনায় হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করছে ওয়াশিংটন। তবে ইরানি নেতারা সম্ভবত মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন কেবল এই হামলা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল না, বরং গোপনে ইসরায়েলকে সমর্থনও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা এই হামলায় জড়িত ছিল না। তবে তেহরান মনে করে, হামলাটি ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিত হামলা। দেশটি এও মনে করে, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সম্পূর্ণরূপে মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল।
ইরান ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই বিবৃতিতে ইসরায়েলকে সন্ত্রাসবাদের জন্য অভিযুক্ত করেছে। দেশটি জোর দিয়ে বলেছে, হামলাটি প্রমাণ করে, ইসরায়েল কোনো আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে না। তারা মাতালের মতো প্রকাশ্যে সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের সমৃদ্ধি, পারমাণবিক প্রযুক্তি ও ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির বিষয়টি বিশ্ব এখন ভালোভাবে অবগত। কারা আগ্রাসী, কোন দেশ এই অঞ্চলের জন্য হুমকিস্বরূপ তাও বিশ্বের দেশগুলো এখন জানে।
ইরান জোর দিয়ে বলেছে, পারমাণবিক বোমা তৈরির কোনো গোপন পরিকল্পনা তাদের কখনও ছিল না। ইরানসহ পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব দেশের বেসামরিক উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি আছে– এমন কোনো প্রমাণ নেই। চলতি সপ্তাহে দেওয়া আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনেও তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’ তবে আইএইএ জানিয়েছে, ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে করছে কিনা, তা প্রমাণ করা সম্ভব না।
বিশ্লেষণে বল হয়, তেহরান ধারাবাহিকভাবে যুক্তি দিয়ে আসছে, বারাক ওবামার সময় করা চুক্তি অনুসারে তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ধারবাহিক আলোচনা করে যাচ্ছে। ইরানের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানতেন, ইরানের পদক্ষেপ নিয়ে ইসরায়েল ক্রমশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তবে আরব কূটনীতিকদের আশা ছিল, ওয়াশিংটন-তেহরান অবশেষে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। তারা মনে করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হামলার অনুমতি ইসরায়েলকে সহসাই দেবে না।
গত ২৩ এপ্রিল ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের চলমান আলোচনায় সন্তুষ্ট নয় ইসরায়েল। তারা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে ইরানের কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা পরিষেবাগুলো উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।
তবে আরাগচির এই বক্তব্য ভুল প্রমাণিত করে ইসরায়েল সফল হামলা চালিয়েছে। ইরানের কাছে থাকা রাশিয়ার তৈরি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
ইরানের অর্জন মূলত একটি। তা হলো, সম্প্রতি আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দেশটি সম্পর্ক উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে যে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছিল তেহরান, ইসরায়েল সেই প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো যৌথভাবে কোনো সামরিক পদক্ষেপের দিকে অগ্রসর হবে না।