স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা থেকে যে শিক্ষা নেওয়া দরকার
Published: 27th, July 2025 GMT
২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরার একটি স্কুলের ওপর বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণ হারাতে হয়েছে আমাদের, যাদের বেশির ভাগই শিশু। গুরুতর আহত মানুষের সংখ্যা আরও বেশি, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই দুর্ঘটনা সারা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও শোকে বিহ্বল করেছে। তবে এটি একই সঙ্গে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনা-পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য স্কুলগুলোর প্রস্তুতিমূলক অনুশীলনের ব্যাপারটি সামনে এনেছে।
প্রস্তুতিমূলক অনুশীলন বলতে বোঝায় প্রকৃত দুর্যোগ-দুর্ঘটনার আগেই করণীয় বিষয়গুলো ঠিক করে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী মহড়া দেওয়া। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় নিরাপত্তা ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকেও যুক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। এই মহড়ায় তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তা শেখানো হয়।
আরও পড়ুনআবারও মৃত্যুর মিছিল: আমরা ভুলে যাই, মায়াকান্নায় প্রতিকারও হারিয়ে যায়২২ জুলাই ২০২৫যেমন অগ্নিদুর্ঘটনার সময় শিক্ষার্থীরা আগুন নেভানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেবে, কীভাবে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে আসবে, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কোন নম্বরে যোগাযোগ করবে—এগুলোর প্রশিক্ষণ জরুরি। স্কুলের অনুশীলনমূলক মহড়ার সময় তারা সরাসরি ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও হাসপাতালের সঙ্গেও যোগাযোগ করবে। স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব প্রতিটি ক্লাসরুমেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা। তা ছাড়া ওপরতলার শিক্ষার্থীরা জরুরি প্রয়োজনে কীভাবে নিরাপদে বের হয়ে আসবে, তার জন্য বিকল্প পথের ব্যবস্থা করা।
বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কথা আছে। এসব দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় কীভাবে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করতে হবে, সে কথাও আছে। কিন্তু এগুলো হাতে–কলমে অনুশীলন করানো হয় না। ফলে, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীরা আসলে দিগ্বিদিকশূন্য হয়েই দৌড়াতে থাকবে। নিয়মিত মহড়া ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগনো সম্ভব নয়, এটা সহজেই বোধগম্য।
মানতেই হবে, কিছু দুর্ঘটনা মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। কিন্তু মানুষ সচেতন হলে অনেক দুর্ঘটনাই কমানো সম্ভব। যেমন স্কুলের সামনের রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং থাকলে শিক্ষার্থীরা অধিক নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারে। এমনকি বাস-গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমবে। এ ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের কাজ হবে রাস্তার নিয়ম-শৃঙ্খলা মানার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা।
কিছু দুর্ঘটনা আবার নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যেমন উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের আগের ও পরের প্রস্তুতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে অধিক বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার উপায় জানাতে হবে। বজ্রপ্রবণ এলাকায় ঝড়বৃষ্টির সময়ে বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় শেখাতে হবে।
এ ছাড়া ভাঙনপ্রবণ নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয় গাছ লাগানোর ব্যাপারে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সরাসরি অংশগ্রহণ করানো যায়। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে গাছ লাগানোর ব্যাপারেও শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে নেওয়ার প্রয়োজন হবে। তবে শুধু গাছ লাগানো নয়, এসব গাছের যত্ন নেওয়াও তাদের শেখাতে হবে। গাছ, পাখি আর প্রাণীদের বিপন্ন করে মানুষের পক্ষে যে বাঁচা সম্ভব নয়, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।
দুর্ঘটনার কিছু মর্মান্তিক ও ভয়ংকর দৃশ্য শিশুদের চোখের সামনে চলে আসে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে তারা সেগুলো দেখে, কখনো দেখে টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব দৃশ্য তাদের মন থেকে মুছে ফেলা সহজ নয়। এগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য শিশুদের ট্রমাচ্ছন্ন করে রাখতে পারে। সুতরাং কীভাবে মনের যত্ন নিতে হয়, সে শিক্ষাও জরুরি। এ জন্য স্কুলগুলোয় মনোবিদদের এনে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়।আগুন ও অ্যাসিডে ঝলসে গেলে কী করতে হবে, কাটাছেঁড়া ও হাড় ভাঙার প্রাথমিক চিকিৎসা কী হবে, সেগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শেখাতে হবে। তা ছাড়া শ্বাসকষ্ট, মৃগীরোগ, চোখে আঘাত, পানিতে ডোবা, সাপে কাটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানটুকু কেবল পাঠ্যপুস্তকে থাকলে হবে না; দক্ষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে সরাসরি এগুলোর অনুশীলন করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলগুলোয় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফার্স্টএইড বাক্স থাকাও জরুরি। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে রোগীকে নেওয়ার পদক্ষেপগুলোও জানানো দরকার।
দুর্ঘটনার কিছু মর্মান্তিক ও ভয়ংকর দৃশ্য শিশুদের চোখের সামনে চলে আসে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে তারা সেগুলো দেখে, কখনো দেখে টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব দৃশ্য তাদের মন থেকে মুছে ফেলা সহজ নয়। এগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য শিশুদের ট্রমাচ্ছন্ন করে রাখতে পারে। সুতরাং কীভাবে মনের যত্ন নিতে হয়, সে শিক্ষাও জরুরি। এ জন্য স্কুলগুলোয় মনোবিদদের এনে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ স্কুলের অবস্থান সংকীর্ণ রাস্তায়। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে গিয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের পক্ষে পানি সংগ্রহ করাও কঠিন হয়। ভবিষ্যতে স্কুল অনুমোদনের আগে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তা ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ভিড় ঠেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির কাজ করতেও বেগ পেতে হয়। অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াত করা সহজ হয় না। এসব ক্ষেত্রে জাতীয় ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনাও জরুরি।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রতি দুই মাস অন্তর বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার মহড়া অনুশীলন বাধ্যতামূলক করা উচিত। দুর্ঘটনার প্রস্তুতিমূলক মহড়া বাস্তব ক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা কমাতে পারে। সেই সঙ্গে সংকটকালীন কাজে শৃঙ্খলা বাড়াতে পারে।
• তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব যবস থ দ র ঘটন র প রস ত ত র জন য ত ম লক
এছাড়াও পড়ুন:
হামাসকে অস্ত্রত্যাগে ও গাজার শাসন ছাড়তে সৌদি, কাতার, মিসরের আহ্বান
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধে এ ভূখণ্ডে হামাসের শাসনের অবসান ঘটানো এবং সংগঠনটিকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে কাতার, সৌদি আরব ও মিসরসহ একাধিক আরব দেশ।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বি–রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রস্তাব পুনরুজ্জীবিত করতে গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের উদ্যোগে নিউইয়র্কে সংস্থাটির সদর দপ্তরে একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানেই গৃহীত সাত পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্রে এ আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণাপত্রটিকে সমর্থন করেছে ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ।
ঘোষণায় বলা হয়, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে অবশ্যই তার শাসন (এ উপত্যকায়) শেষ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। এটি একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এতে যুদ্ধ শেষে গাজায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিদেশি সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়। সম্মেলনে ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।আগের দিন, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদল ইসরায়েল ও হামাস উভয়কে গাজা ত্যাগ করার আহ্বান জানায়; যাতে সাগর উপকূলবর্তী এ অঞ্চলটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে।
আরও পড়ুনগাজায় ত্রাণপ্রত্যাশী ৯৩ জনকে হত্যা ইসরায়েলি বাহিনীর, যুদ্ধের বর্বরতার নিন্দায় পোপ২১ জুলাই ২০২৫ঘোষণায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলারও নিন্দা জানানো হয়। তবে এ বিষয়ে এখনো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা জানায়নি। সম্মেলনের সহআয়োজক ফ্রান্স ঘোষণাপত্রটিকে ‘ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেছে।
আরও পড়ুনগাজায় হামলার নিন্দা জানালেও ইসরায়েলের সঙ্গে কেন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এসব দেশ১৮ ঘণ্টা আগেফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো বলেন, ‘প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো হামাসের নিন্দা জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি শাসন থেকে তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ও ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে।’
প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো হামাসের নিন্দা জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি শাসন থেকে তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ও ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে।জ্যাঁ-নোয়েল বারো, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এতে যুদ্ধ শেষে গাজায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিদেশি সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়। সম্মেলনে ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।
আরও পড়ুনগাজায় ‘এখনই যুদ্ধ থামাতে’ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ২৮ দেশের আহ্বান২২ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনইসরায়েলের স্নাইপাররা এমনভাবে গুলি ছুড়ছিলেন, যেন পশু শিকার করছেন: গাজার বাসিন্দা২১ জুলাই ২০২৫