রংপুরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরে হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘রংপুরে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন, তাঁকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে চাই, ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’

আজ মঙ্গলবার দুপুরে টাঙ্গাইলে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত পথসভায় নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন।

শহরের নিরালা মোড়ে আয়োজিত পথসভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘রংপুরের গঙ্গাচড়ায় আমাদের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাসভবনে বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে, লুটপাট চালানো হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের নবীজি (সা.

)–কে সেখানে কটূক্তি করা হয়েছে। আমাদের নবীজি (সা.)–কে যে কটূক্তি করে, আমাদের ধর্মকে যে অবমাননা করে, আমরা অবশ্যই তার বিচার চাই। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে আইনের আওতায়। আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি সেই সম্প্রদায়ের ওপর কেউ আঘাত হানে, সেই ঘটনাকে আমরা কখনোই মেনে নেব না। আমাদের ধর্ম এটাকে পারমিট করে না।’

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘নবীজি (সা.) সব সময় অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। ফলে এ ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়, তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, তাদের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক এবং তাদের উদ্দেশ্য লুটপাট করা।’ তিনি বলেন, ‘এ রাজনীতি শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং লুটপাটের রাজনীতি ও বিচার না করার রাজনীতি।’

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানীর মতো মহান রাজনীতিক পুরুষ, যাঁরা এ বাংলাদেশের স্থপতি, তাঁদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতির পিতা শুধু এক ব্যক্তিকে ঘোষণা করা হয়েছে। এক ব্যক্তিকে পূজা করা হয়েছে গত ৫৪ বছর ধরে। কিন্তু মাওলানা ভাসানী না থাকলে শেখ মুজিব সৃষ্টি হতে পারতেন না। যে ’৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিয়েছে, সেই অভ্যুত্থানের অন্যতম কারিগর নেপথ্যের পুরুষ ছিলেন মাওলানা ভাসানী। তিনি কৃষক–শ্রমিকের জন্য লড়াই করেছেন, গণমানুষের জন্য লড়াই করেছেন। আমরা মাওলানা ভাসানীর সেই আদর্শকে ধারণ করে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘মাওলানা ভাসানী শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন রাজনৈতিক দার্শনিক। আমরা ভাসানীকে বাংলাদেশের অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার মনে করি। বাংলাদেশে কোনো একজন জাতির পিতা নয়, বাংলাদেশে অনেকজন জাতির পিতা রয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম মাওলানা ভাসানী।’

সমাবেশে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কারী সারজিস আলম বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে ফ্যাসিবাদের পছন্দের কিছু জেলা বাদ দিয়ে, বাকি জেলাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাদের স্বকীয়তায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে এবং বহির্বিশ্বে যতটা গুরুত্বের জায়গায় থাকতে পারত, কিন্তু কিছু ব্যক্তিস্বার্থের মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এত বড় একটি ঐতিহ্যবাহী জেলার স্বার্থকে প্রতিনিয়ত বিসর্জন দিয়ে এসেছে।’

সারজিস আলম আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে আরেকটা কথা বলি, আমরা মিডিয়াকে কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর বা দলের দালাল হিসেবে দেখতে চাই না। এই মিডিয়া যেন কোনো ব্যক্তি বা দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজে না লাগে। এই মিডিয়া যেন প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়নের সেলের অংশ হিসেবে কাজ না করে।’ তিনি বলেন, “’২৪–পূর্ববর্তী সময়ে কয়েকটি মিডিয়া অন্ধভাবে দলের দালালি করেছে। তাদের সংবাদকর্মীরা আজ যে সেই চ্যানেলে কাজ করে, সেটা বলতেও লজ্জা পায়। আমরা চাই না ’২৪–পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো মিডিয়ার আর এই করুণ দশা হোক।’

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক নাহিদা সারওয়ার, জ্যেষ্ঠ সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সাইফুল্লাহ হায়দার, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) অলীক মৃ, সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) আজাদ খান ভাসানী, কেন্দ্রীয় সদস্য মেজর (অব.) সালাহউদ্দিন, জেলার প্রধান সমন্বয়কারী মাসুদুর রহমান প্রমুখ। সমাবেশে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত আবদুল্লাহ উপস্থিত থাকলেও অসুস্থতার কারণে বক্তব্য দেননি।

পদযাত্রার আগে সকালে শহরের একটি হোটেলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা জুলাই আন্দোলনে টাঙ্গাইলের শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এনসিপির এই পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সোমবার রাতে এনসিপির নেতারা টাঙ্গাইলে পৌঁছানোর পর সন্তোষে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কবর জিয়ারত করেন।

দুপুর ১২টার দিকে এনসিপি নেতারা শহরের শামসুল হক তোরণের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।

শহরের কেন্দ্রস্থল নিরালা মোড়ে এনসিপির সমাবেশের কারণে সকাল থেকেই ভিক্টোরিয়া সড়ক, কবি নজরুল সরণি ও মেইন রোডের কিছু অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে শহরের অন্যান্য সড়কেও যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দুর্ভোগে পড়তে হয় শহরবাসীকে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম পদয ত র এনস প র র জন ত আম দ র শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ