এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।

আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

২.

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।

আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৩.

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।

এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্‌স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।

বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ব চ র আটক ম নব ধ ক র র ব যবহ র কর স ব ধ নত কর ত ত আইন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

এইচএসসি পরীক্ষা: ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্রে ভালো করতে হলে

এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টি সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক হওয়ায় ভালো ফল অর্জন করতে অবশ্যই অধ্যায়ভিত্তিক মৌলিক বিষয়গুলো ভালোভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে ভালো ফল অর্জনের কৌশলগত বিষয়টি তোমরা নিশ্চয় জানো। এরপরও বলে রাখছি, যে করেই হোক পুরো নম্বরের উত্তর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু সৃজনশীল অংশের জন্য সময় বরাদ্দ ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট অর্থাৎ ১৫০ মিনিট তাই জ্ঞানমূলক অংশের জন্য ২ মিনিট, অনুধাবনমূলক অংশের জন্য ৩ মিনিট, প্রয়োগমূলক অংশের জন্য ৭ মিনিট, উচ্চতর দক্ষতা অংশের জন্য ৮ মিনিট। একটি প্রশ্ন তোমাকে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট সময় নিয়ে লিখতে হবে।

বহুনির্বাচনি অংশ—

১. বহুনির্বাচনি অংশে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য বিভিন্ন বছরের বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সমাধান করবে,

২. ভালো কলেজগুলোর নির্বাচনি প্রশ্নপত্র বহুনির্বাচনি অংশটা মনোযোগসহকারে সমাধান করা,

৩. বহুনির্বাচনি অংশের উত্তর সঠিকভাবে বৃত্ত ভরাট করবে।

সৃজনশীল অংশ—

এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথমে জ্ঞান ও অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তর আগে দেওয়াটা ভালো। পরে সময় নিয়ে উদ্দীপক নির্ভর প্রশ্ন যেমন প্রয়োগ মূলক ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নের উত্তর করাটা দেওয়াটা ভালো। এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই বুঝে লিখবে। অপ্রাসঙ্গিক কোনো ধরনের কিছু লিখবে না। নিচে দেখে নাও কোন কোন অধ্যায়ের প্রশ্নের ওপর গুরুত্ব দেবে।

আরও পড়ুনঅষ্টম শ্রেণিতে আবারও বৃত্তি পরীক্ষা ফিরছে, আছে প্রশ্নও২৮ জুলাই ২০২৫

অধ্যায়-১ (ব্যবস্থাপনার ধারণা):

ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি, ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তর এই দুটি বিষয় দিয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন থাকতে পারে। তা ছাড়া ব্যবস্থাপনার উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ বহুনির্বাচনি অংশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যায়-২ (ব্যবস্থাপনা নীতি):

হেনরি ফেয়লের ১৪টি ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহ সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন দিয়েও সৃজনশীল প্রশ্ন আসতে পারে।

অধ্যায়-৩ (পরিকল্পনা প্রণয়ন):

পরিকল্পনার প্রকারভেদ, উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য, পরিকল্পনা প্রণয়নের ধাপ।

অধ্যায়-৪ (সংগঠিতকরণ):

সংগঠন কাঠামোর প্রকারভেদ ও সংগঠনের নীতিমালা সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে।

অধ্যায়-৫ (কর্মী সংস্থান):

কর্মী সংগ্রহের উত্স, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যায়-৬ (নেতৃত্ব):

নেতৃত্বের প্রকারভেদ দিয়ে সব সময় সৃজনশীল প্রশ্ন থাকে। এটি ভালোভাবে আত্মস্থ করতে হবে। আদর্শ নেতার গুণাবলি ও পরামর্শমূলক নির্দেশনা।

আরও পড়ুনপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়ছে১৪ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনজাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে তিনটি ডিপ্লোমা কোর্স, সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে২৩ জুলাই ২০২৫

অধ্যায়-১০ (নিয়ন্ত্রণ):

নিয়ন্ত্রণের বৈশিষ্ট্য, নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ও নীতিমালা সৃজনশীলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সৃজনশীল অংশে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য ক ও খ অংশের উত্তর যথাযথভাবে লেখা। অর্থাৎ সময়ক্ষেপণ না করে অতিরিক্ত কোনো কিছু না লেখা। উদ্দীপকনির্ভর প্রশ্ন ‘গ’ অংশে প্রথমে উত্তরের মূল অংশ প্রথম প্যারায় লিখতে হবে। এরপর দ্বিতীয় প্যারায় জ্ঞান অংশের ব্যাখ্যা করা এবং তৃতীয় প্যারায় উদ্দীপককে সামনে রেখে বা হাইলাইট করে উত্তর লেখা। একইভাবে ‘ঘ’ অংশের জন্য প্রথমে মূল উত্তর নির্ধারণ করতে হবে, এরপর মূল উত্তরের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ, মূল উত্তরের পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ মতামত তুলে ধরে উপস্থাপন করতে হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মাজেদুল হক খান, সহযোগী অধ্যাপক, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুনজার্মানির ডাড স্কলারশিপে স্নাতকোত্তর, মাসে ৯৯২ ইউরোর সঙ্গে বিমান টিকিট-বাড়িভাড়াসহ নানা সুবিধা২৮ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এইচএসসি পরীক্ষা: ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্রে ভালো করতে হলে