ভারতের হয়ে প্রক্সি যুদ্ধ করলে যে বিপদ তালেবানের
Published: 16th, October 2025 GMT
আফগানিস্তান আবারও সেই পরিচিত ও বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। দেশটি আবারও প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে পড়তে যাচ্ছে, যেখানে দেশটির সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বৈধতা দুর্বল হচ্ছে।
ইতিহাস খুব কঠিন সতর্কবার্তা দেয়। শেষবার যখন আফগানিস্তান বিদেশি শক্তির দাবার বোর্ডের ছক হয়ে উঠেছিল, তখন দেশটি কয়েক দশক ধরে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। গভীর ক্ষত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। আজকের লক্ষণগুলো খুবই পরিচিত। এ লক্ষণগুলো যদি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে ফল হবে ভয়াবহ।
সম্প্রতি আফগান ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলায় হামলা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লি সফরে ছিলেন। এ দুটি ঘটনা একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।
আরও পড়ুনতালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে ২৯ এপ্রিল ২০২৫কাবুল এখন আর পাকিস্তানের নিরপেক্ষ প্রতিবেশী নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবে আফগানিস্তান এখন বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ইসলামাবাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে ধারণা করা হচ্ছে, এসব হামলা হয়তো ভারতের সমন্বয়ে বা সহযোগিতায় হয়েছে। এসব প্রতিবেদন যে আশঙ্কার সতর্কঘণ্টা বাজাচ্ছে, সেটি হলো আফগানিস্তানকে আবারও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানকে প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিপদ শুধু তত্ত্বগত বিষয় নয়। আশি ও নব্বই দশকে আফগান ভূখণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর শক্তি পরীক্ষার মাঠে পরিণত হয়েছিল। প্রথমবার সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়। দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অভিযানের সময়। ফল হলো কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধ, দুর্বল শাসনব্যবস্থা আর একটি অস্থিতিশীল অঞ্চল।
শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও উগ্র মতাদর্শের বিস্তারের প্রতিবর্তী প্রভাব পাকিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য জায়গাতেও পড়েছিল। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতে দেওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়াকে তার খেসারত দিতে হয়েছে।
আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। এগুলো রক্ষা করা শুধু আফগানদের দায়িত্ব নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ারও এক জরুরি দায়িত্ব। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর তার ভয়াবহ প্রভাব কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।আজও সেই একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আফগান বাহিনী যখন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলায় হামলা চালাচ্ছে, ঠিক সে সময়ে ভারত স্যার ক্রিক ইস্যু উত্থাপন করছে এবং ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে বাগাড়ম্বর জোরদার করছে।
ভারত ও তালেবানের মধ্যকার এ সমন্বয় এ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দেয় যে আফগানিস্তানকে এমন একটি কৌশলগত পরিস্থিতিতে টেনে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে নিজের দেশের জনগণের চেয়ে বিদেশি ক্রীড়নকেরাই লাভবান হবে। কাবুল যদি অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তালেবানের শাসন দুর্বল হবে, নাগরিকদের আস্থা হারাবে। এমন একটি সংঘাতের চক্রের দুয়ার খুলে যাবে, যা কয়েক দশক স্থায়ী হতে পারে।
আরও পড়ুনতালেবান ও আরএসএস যে ইস্যুতে এক১৫ অক্টোবর ২০২৫পাকিস্তানের জন্য ফল এখানে স্পষ্ট। সীমান্তের উসকানি মোকাবিলায় মনোযোগ ও সম্পদ ব্যয় করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দুর্বল হবে, সামরিক বাহিনী তার প্রস্তুতি নিয়ে চাপের মুখে পড়বে এবং পূর্ব সীমান্তে (ভারত সীমান্তে) প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা হ্রাস পাবে। পাকিস্তানকে যদি দুই সীমান্ত নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, তাহলে সেটা সরাসরি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দেয়।
পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ করে পাকিস্তান যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব সীমান্ত থেকে আসা চাপের মুখে দেশটি নাজুক অবস্থায় পড়বে। আফগানিস্তানের প্রক্সি ভূমিকা ইসলামাবাদের সামরিক ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলে।
সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে আফগানিস্তানকেই। আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে নিজেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে দেশটি তার বৈধতা হারাবে। আন্তর্জাতিক দাতা ও বিনিয়োগকারীরা এমন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দ্বিধা, যারা নিজেদের সার্বভৌমের বদলে বিদেশি রাষ্ট্রের খেলার পুতুল হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুনভারতের একের পর এক উসকানি, পাকিস্তান এখন কী করবে১৪ অক্টোবর ২০২৫আফগানিস্তানে নাগরিকেরা তাদের সরকারের কতটা স্বাধীনতা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এটি শেষ পর্যন্ত অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ইতিহাস বলে, প্রক্সি হিসেবে ব্যবহৃত জাতি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য সংগ্রামের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ঝুঁকিও অনেক বেশি। অস্থিতিশীল আফগানিস্তান শুধু নিজ সীমান্তের ভেতরে নয়, পুরো অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলবে। শরণার্থী স্রোত, জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও অর্থনৈতিক সংকট পাকিস্তান, ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আঞ্চলিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হবে।
পাকিস্তানকে অবশ্যই পরিষ্কার কৌশলগত স্বচ্ছতার পথ ধরতে হবে। পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিশোধ সংঘাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে বিদেশি ক্রীড়নকদের স্বার্থ সিদ্ধিতে সুবিধা করে দেবে। ইসলামাবাদের উচিত কৌশলগত সংযম প্রদর্শন করা। আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কার্যকর প্রস্তুতি রাখতে হবে।
আরও পড়ুনভারত কি পাকিস্তান–তালেবান দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে১৫ জানুয়ারি ২০২৫ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, আফগানিস্তানকে বারবার অন্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফল দীর্ঘস্থায়ী হয়। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটা শুধু কল্পনা নয়। যদি কাবুল আবারও এমন অবস্থায় পড়ে, তাহলে গোটা অঞ্চল দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্থিতিশীল, সংঘাতপূর্ণ ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।
আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। এগুলো রক্ষা করা শুধু আফগানদের দায়িত্ব নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ারও এক জরুরি দায়িত্ব। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর তার ভয়াবহ প্রভাব কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।
মাজহার সিদ্দিক খান পাকিস্তানের লাহোর হাইকোর্টের আইনজীবী
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন র দ বন দ ব ক শলগত প রক স র জন য দ র বল ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্বেগ কেন
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব, যেখানে ২০২৩ সালে প্রতিদিনের পণ্য ও সেবার লেনদেন দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ)। যুক্তরাষ্ট্রের মোট পণ্য বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ আসে কানাডা থেকে। কানাডার ৭৫ শতাংশ রপ্তানি পণ্য যায় যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিপক্ষীয় এ বাণিজ্যের মূল খাত অটোমোটিভ, জ্বালানি, কৃষি। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল আমদানির ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে কানাডা। দুই দেশের মধ্যে গাড়ির যন্ত্রাংশ সীমান্ত অতিক্রম করে একাধিকবার।
কিন্তু এ পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্কটি বাণিজ্যিক টানাপোড়েন থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, শিল্প পুনর্গঠন এবং বৈশ্বিক নীতির নতুন পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের টানাপোড়েন আরও ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ আমাদের চোখে আনে উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা। আবার একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্রদেশগুলোর মধ্যকার প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিস্থাপকতার দিকটিও স্পষ্ট করে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–বিরোধ ইস্যুটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও যা ভাবা দরকার ১৩ আগস্ট ২০২৫যদিও জনসমক্ষে আলোচনায় প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা প্রাধান্য পায়। তবু কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ইতিহাসে নানা বিরোধ দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে, যা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে সামনে আসেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৬০-এর দশকের তথাকথিত ‘চিকেন ওয়ার’ এবং দীর্ঘস্থায়ী সফটউড লাম্বার নিয়ে বিরোধ। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল, অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ অর্থনৈতিক নীতির যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড এক্সপানশন অ্যাক্টের সেকশন ২৩২–এর আওতায় জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কানাডিয়ান ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেকশন ২৩২-এর আওতায় কানাডিয়ান ইস্পাতের ওপর ২৫ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নির্বাচিত পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এ পদক্ষেপগুলো বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করে এবং দুই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ফলে উভয় দেশ সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
চার দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এ বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—কানাডা তার সফটউড লাম্বার খাতকে ভর্তুকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার কানাডার ডেইরি, ডিম ও মুরগির জন্য চালু করা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নীতিকে সমালোচনা করেছে এবং একে বাজারে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখিয়েছে। দুই দেশের এ টানাপোড়েনে দেখা দিয়েছে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামে দামের অস্থিতিশীলতা। সফটউড লাম্বারে শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শুধু ২০১৮ সালেই কানাডায় প্রায় ২৩ হাজার চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
একই প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রেও, বিশেষত কানাডিয়ান মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে। কাঠামোগত কারণ ও কৌশলগত স্বার্থ কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য–বিরোধের স্থায়িত্ব ও বিবর্তনকে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি ও উদীয়মান কারণে আকার দিচ্ছে।
যেমন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান। ২০১৬ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও শিল্প বিচ্ছিন্নকরণের (ইন্ডাস্ট্রি ডিকাপ্লিং) প্রবণতা জোরদার হয়েছে। ‘বাই আমেরিকান’ তথা ‘আমেরিকান পণ্য কেনো’ ধরনের নীতি উত্তর আমেরিকার সাপ্লাই চেইন সংহতকরণের মডেলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা২৮ জুলাই ২০২৫এসব ঘটনার পরও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—যেমন জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট), ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এবং নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা), পরে যার পরিবর্তে আসে ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট (ইউএসএমসিএ)—দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে, যা কানাডার কোটার বণ্টন পদ্ধতির কিছু দিককে চুক্তির শর্তাবলির সঙ্গে অসংগত ঘোষণা করে এবং নীতি সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এতে কঠোরতর উৎস নিয়ম, একটি ‘সানসেট ক্লজ’ ও পুনর্গঠিত বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়। এসব পরিবর্তন নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারদের জন্য কৌশলগত পুনর্গঠন অপরিহার্য করে তোলে।
কিন্তু একাধিক বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়ায় আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায়নি; বরং জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কানাডিয়ান সফটউড লাম্বারের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং শুল্ক বজায় রাখে, যার গড় ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অস্থিরতার ঝুঁকির কারণে কানাডা রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে এবং পদ্ধতিগত ঝুঁকি হ্রাস করা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে সিপিটিপিপি এবং সিইটিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক ও ইউরোপীয় অঞ্চলে বহুপক্ষীয়, বহুমুখী ও বহুখাতীয় চুক্তির আওতায় রপ্তানি বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্য–বিরোধের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত শিক্ষা পাওয়া যায়, যা অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য।
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একতরফা শুল্ক আরোপ ও বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা বাজার আস্থাকে ক্ষুণ্ন করে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীল মিত্রদেশগুলোর মধ্যেও বাণিজ্যিক উত্তেজনা উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে। অভিযোজন, বিচক্ষণ নীতি ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এ সম্পর্কের স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য।
আগামী দিনে জলবায়ু-সম্পর্কিত বাণিজ্যনীতি, ডিজিটাল বাণিজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ভূরাজনীতি বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভিযোজন ক্ষমতাকে পরীক্ষা করবে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন উভয়ের সরকারি বক্তব্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহযোগিতার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। যদিও দেশীয় ও বৈশ্বিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায়ই অর্থনৈতিক সংহতির মডেল হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি নিয়মিত বিরোধ ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বিরোধ উত্তর আমেরিকার বাণিজ্যকাঠামোর শক্তি ও দুর্বলতা উভয়কেই স্পষ্ট করেছে। নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের জন্য এ অভিজ্ঞতা শিক্ষা দেয় যে এক অনিশ্চয়তার যুগে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, প্রমাণভিত্তিক নীতি এবং দূরদর্শী অর্থনৈতিক কূটনীতি অপরিহার্য।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক উন্মাদনায় এলোমেলো বিশ্ববাণিজ্য১০ এপ্রিল ২০২৫উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের সংগঠন ফোবানা তার ২০২৫-এর সম্মেলনের আয়োজন করে মন্ট্রিয়ল শহরে। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন শুরু হয় গত ২৯ আগস্ট। ৩০ আগস্ট নির্ধারিত ছিল সেমিনার সিরিজ।
রঙ্গরসপ্রিয় বাঙালি গানবাজনা-নৃত্যের বিনোদন বাদ দিয়ে সম্মেলনের একটি অংশ রেখেছে সেমিনারের জন্য এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এর মানে হলো আয়োজকেরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।
এর প্রধান কৃতিত্ব সেমিনার সিরিজের সমন্বয়ক অণুজীব বিজ্ঞানী ড. শোয়েব সাঈদের, যিনি অনেক দিন ধরে এ কঠিন কাজটি করে আসছেন। কিন্তু সেমিনারের কার্যকরী পর্ষদের সদিচ্ছা-সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। পর্ষদের সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া, মেম্বার সেক্রেটারি ইকবাল কবীর, কালচারাল ডিরেক্টর শামসাদ রানা, ফোবানার কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান, নির্বাহী সচিব নেহাল রহিম, কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা বেদারুল ইসলাম বাবলাসহ অসংখ্য মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনুষ্ঠানটি সফল হতে পেরেছে।
চারটি সেশনের একটির আলোচ্য বিষয় ছিল ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের যুগে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বাণিজ্যযুদ্ধ’। এই সেশনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি-নোট স্পিচ দেওয়ার জন্য। সেশন চেয়ার ছিলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কানাডিয়ান ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন গ্যালব্রেইথ। বিষয় নির্ধারণ থেকেই বোঝা যায়, কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বাণিজ্যযুদ্ধে উদ্বিগ্ন।
এ নিবন্ধ আমার বক্তৃতার অংশ। বক্তৃতায় আমি বলেছি, এ উদ্বিগ্ন হওয়াটা ভালো লক্ষ্মণ। তাঁদের পরামর্শ দিয়েছি, কানাডার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিয়ে কানাডার চাকরির বাজারে ঢুকে যেতে এবং রাষ্ট্রের আদর্শ, সমাজের মূল্যবোধ ধারণ করে মনেপ্রাণে কানাডার নাগরিক হয়ে গিয়ে অবদান রাখতে। বাংলাদেশে বৈধ পন্থায় অর্থ পাঠানো বা বিনিয়োগ করার পরামর্শও দিয়েছি।
কানাডা সরকার জানে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে কী করতে হবে। তারপরও আমি কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছি, যা নীতিনির্ধারকের আলোচনার বা কর্মপরিকল্পনায় চোখে পড়ে না। সব খাতে নিজস্ব শিল্প গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেল শোধনে বা গাড়ির যন্ত্রাংশ ভাগাভাগির নীতি বাদ দিতে হবে। প্রতিটি খাতে ৫০ বছরের পুরোনো নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এই নীতি বর্তমান সময়ের সঙ্গে হালনাগাদ করতে হবে। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ ও সরকারি তত্ত্বাবধানে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
[email protected]
মতামত লেখকের নিজস্ব